১
বৈশাখে দেই না ডালি
জ্যৈষ্ঠদিনে করিনে ক্ৰন্দন
দুই হাতে ছিঁড়েখুঁড়ে জন্মের বন্ধন
লাঙল চালাই বেগে অকর্ষিত ক্ষেতে।
আমি এক ক্ষ্যাপা চাষা
শ্রীমন্ত দক্ষিণ হয়ে অনন্ত ভরসা
রাশি রাশি প্রাণভরা বীজ
কুমারী মাটির বুকে অনুরাগে ঢালি।
আগামী আষাঢ়ে
ঘন নীল মেঘ চোঁয়া জলধারা প্রাণদ সঞ্চারে
শস্যের শিশুর কানে করে যাবে মন্ত্র উচ্চারণ
সবুজ সদর্পে ঊর্ধ্বে বাড়াবে মস্তক।
অঘ্রাণে কনক বৰ্ণ সুপক্ক ফসল
দেখব রেখেছে মাথা আলের শিথানে
বিস্তীর্ণ দিগন্ত জুড়ে আনন্দের ধান
আমার প্রাণের প্রাণ স্বপ্নের বিস্তার।
মনে হবে আমি যেন সেই মাতামহ
দৌহিত্রের মুখ দেখে আচানক যার
হঠাৎ ননীর স্রোতে
প্রবীণ প্রাণের প্রান্তে জন্ম লয় স্নেহ।
২
রবীন্দ্রনাথের কাছে ঋণী নই আমি
নজরুল কিংবা কোন ফসিলের স্তরে
হৃদয়ে পাথর বসে। আমি তো নিশ্চিত জানি
বাস করি ভিন্ন ভূমণ্ডলে
বন্দী আমি, মুক্ত আমি আপন সমাজে।
কম্পাসের মত, আমার মনের কাঁটা ঘুরে বারবার
অভিযাত্রী সন্তানের দিকে তাক্ করে।
তা দেয়া কুক্কুটি প্রায় স্বপ্নে বাঁচি বলে
অসীম সাহসী আমি
লোহার লাঙল দিয়ে পাথুরে মৃত্তিকা চাষ করি।
এই হৃদয় দ্রবণী শ্রমে কি তীব্র আস্বাদ
দূর ভবিষ্যৎ কান্তিমান বিশ্ব ফেলে রূঢ় বর্তমানে
যেমন আকাশ ভাসে জলের হৃদয়ে।
আমি তাই তাজা ডিনেমাইটের মত শব্দে
প্রতিদিন বিস্ফোরণ আনি
প্রচণ্ড উত্থানযন্ত্রে যৌবনের উজাগর ধ্বনি
তীব্রবেগে ঊর্ধ্বে ছুঁড়ে মারি।
যে কবি বৈশাখে জন্মে বঙ্গদেশে
বিগ্রহের আসনে আসীন- তাঁর কণ্ঠ নিঃসৃত সঙ্গীত
মাতৃগর্ভে শোনা অস্ফুট নিঃশ্বাস মনে হয়।
যে কবি বস্ত্র-পুষ্প নীলকণ্ঠে করেছে ধারণ
নব নির্মিতির রাজ্যে তাঁর কণ্ঠধ্বনি
কখনো শুনিনি আমি।
জানি আমি জানি
কথার সাগর বটে রবীন্দ্রঠাকুর,
কি লাভ আমার তাতে
আমি তো পরের ধনে করিনে পোদ্দারি;
খোঁড়া হই, অন্ধ হই জ্ঞাত আছি বিলক্ষণ
আমি তবু স্বতন্ত্র ঈশ্বর
আমারো ধ্যানের গাড়ে প্রতিদিন জাগে নয়া চর।
বিদ্রোহীর অগ্নিকুণ্ডে মৃত অঙ্গারের লোভে
চপল শিশুর মত কখনো যাইনি আমি
বরং করেছি ঘৃণা
অপ্রকাশ দুঃখ-স্রোতে অপরের স্থূল হস্তক্ষেপ।
আমার জীবনক্ষেত্রে ফেলেছে এই ভাষা
লোহিত মাংসের মত ভীষণ রসালো
গিঠ গিঠ অস্থিময় কখনো বা ভাঙ্গা কাঁচ
প্রাণের আলোক লেগে করে ঝলমল।
বৈশাখ জ্যৈষ্ঠেতে গড়া বাঙালির
সাধের মিনার, চেতনার স্তরে স্তরে
খসে খসে যায় সময়ের নিষ্ঠুর প্রহারে
জীর্ণ অট্টালিকা হতে যেন চুন বালি ঝরে।
আকণ্ঠ গানের তৃষ্ণা, বুকে জ্বলে অগ্নিবর্ণ কথা
বাঙলার বারোটি মাস ওড়ায় পাতাকা
দুই হাতে ভরে নিয়ে শোণিত অঞ্জলি
নব কাব্যসুন্দরীর রাঙা পায়ে ঢালি।