ঘোষণাপত্র

[আল মাহমুদ সমীপে]

আপনি সংবাদ জানতে চান?
তাহলে শুনুন
এরই মধ্যে একটা চমৎকার কাজ করে ফেলেছি
বুঝিয়ে না বললে ঠিক ধরতে পারবেন না।

গত রাতের আকাশে বাঁকা সুন্দর চাঁদ ছিল
তারাগুলো হীরকখণ্ডের মত জ্বলছিল ঝক্‌ঝক্‌
আঁকাবাঁকা হাওয়া মশারিতে ঢেউ খেলছিল
প্রকৃতিতে স্তব্ধ হয়ে এক ঘনায়মান তাণ্ডব।

আমার শরীর তাতছিল, মন যাচ্ছিল লাগিয়ে
জিভের আগায় মারাত্মক সব শব্দরাজি
পাকা ফলের আবেগে বোমার মত
প্রবল দোলায় দুলছিল।

সে এক অদ্ভূত অনুভূতি
আমি ঠিক আমাতে ছিলাম না
বুকের খাপে তলোরারের ঝন্‌ ঝন্
কানে সর্বনাশের সঙ্কেত
তারপরেও কি স্থির থাকা যায়!

হঠাৎ করে এক কাত করে বসলাম
পয়লা একটু হকচকিয়ে গিয়েছিলাম,
কি জানি কি ঘটে, বিপদ তো সেয়ানা
ভালুকের মত ওঁতপেতে থাকে।

শেষ পর্যন্ত আপন মস্তকের ওপর দণ্ডায়মান হয়ে
মধ্যরাত সাক্ষী রেখে
আস্ত একটা যুদ্ধ বেবাক দুনিয়ার বিরুদ্ধে
ঘোষণা করে দিলাম।
তাছাড়া আর কি করবার ছিল-
আমার মত বেপরোয়া হঠাৎ কবি
যে নাম যশের ধার ধারে না, রেডিও টিভির
পরোয়া করে না, আপন রক্তিম হৃদয়
নিয়ে বেঁচে আছে বলে গর্বিত, দাঁতখসা
অধ্যাপকদের বুড়ো আঙ্গুল দেখায়,
মানুষের মনে ছানা দিয়ে জায়গা করে নিতে জানে
তার দিন কেমন করে কাটে?

দেশটা যেন বদ্ধজলা
এদিকে মরণ- ওদিকেও তেমন
দুয়ারে দারোয়ান, অন্দরমহলে খোজাদের চীৎকার
তাদের গায়ে চাপকান, গলায় চাদর
বিশ্রী বোঁটকা রামছাগলের গন্ধ
কাহাতক সহ্য করা যায়
তাই মধ্যরাতে যুদ্ধ লাগিয়ে বেঁচে গেলাম।

জিভের ডগা থেকে শব্দগুলো নীরব বিস্ফোরণে
ফেটে পড়ল, এই মাসের, এই বাছরের
এটাই সেরা খবর;
কোন খবরের কাগজে ব্যানার হয়নি
রয়টার রিপোর্ট করেনি
টিভি কভারেজ দেয়নি
ওরা সবাই খবরের চোকলা নিয়ে ব্যস্ত
রাজস্থানে ভারতীয় মুরণি পরমাণুর ডিম পেড়েছে
এই নিয়ে হৈ চৈ করে ঝিম মেরেছে
এরা সাগ্রহে প্রত্যাশা করে একটা কিছু ঘটুক
অন্যরকম- যাতে হেডলাইনে চীৎকার করতে পারে।
কিন্তু এই সংবাদ কীটেরা জানে না
দুনিয়ার সেরা বিস্ফোরণগুলো নীরবেই ঘটে।
যেমন ধরুন যৌবন প্রাপ্তির গোপন মধুর সংবাদ
প্রথম প্রেমে পড়ার বিস্মিত পুলক
আইনস্টাইনের মস্তকে আপেক্ষিক তত্ত্বের উদয়
কার্লমার্কসের মনে নতুন বিশ্বের উদ্ভাসন
অথবা রবীন্দ্রনাথের মনের সৃষ্টি যন্ত্রণার
ক্ষমাহীন আকুলি বিকুলি;
কোন্ বাপের বেটা খবরঅলা এসবের খোঁজ রেখেছে;
অথচ এসবই হল সব খবরের গ্র্যান্ড ফাদার।

সে যাকগে
আমি যাকে বলেছি বিশ্বের মহত্তম বিস্ফোরণ
কিন্তু এমন নীরবতায় ঘটিয়েছি যে
কাউকে টের পাবার কোন অবকাশই দিইনি।

গতকাল মধ্যরাতে
আমি একাকী বেবাক কিছুর বিরুদ্ধে
একটা আস্তযুদ্ধ ঘোষণা করেছি।
সারারাত কাগজে খস খস করে ঘোষণাপত্র লিখেছি
তারাগুলো সভয়ে আমাকে এ অসমসাহসী কাজ করতে দেখেছে।

আমি ধ্রুবনক্ষত্রের প্রতি নির্দেশ জারি করেছি
বারোমাস এ্যাটেনশনের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকবে
একচুল এদিক ওদিক হটতে পারবে না।

চাঁদকে পরিষ্কার বলে দিয়েছি
পুরনো কথা মনে কাঁটার মত বিঁধে আছে
এরপরেও যদি স্বৈরিণীর মত আচরণ দেখি
আমার সুদক্ষ গোলন্দাজ দল
বেপরোয়া শব্দের কামান দেগে
রূপোলি অহংকার ফালা ফালা করে
তোমাকে উলঙ্গ করে ছাড়বে।

সূর্যের কাঁধে রসদ জোগাবার ভার দিয়েছি
বহুকালের বিশ্বস্ত সেবক, চাকুরিটাও উত্তম
কিন্তু আমার আলোকপিয়াসী শব্দসৈনিকদের
ভাগে আলোর যদি কমতি পড়ে
দুনিয়ার চারকোণ ঢুঁড়ে
রাশি রাশি ব্যাকরণ পুস্তক এনে জ্বালামুখ সীল করে দেব।
ছয় ঋতু বারোটি মাসের প্রতি নির্দেশ
থিয়েটারের নিপুণ নটির মত
নিখুঁত সাজ পোষাকে
মাইনে পাও না পাও
ঠিক সময়ে আসবে যাবে।

দুনিয়ার গ্রন্থালয়গুলোতে আমার সৈনিকদের ছড়িয়ে দিয়েছি
অতীত কবিদের আত্মা যেখানে কালি এবং কাগজের
পটভূমিকায় বন্দী;
আমি মূৰ্চ্ছাহত আত্মাদের জাগিয়ে তুলতে নির্দেশ দিয়েছি
এবং বলেছি তারা যেন আবাবিল পক্ষীর মত
ভূমণ্ডলে চক্রমন করেন।
কেননা এরই মধ্যে পৃথিবীর কলকব্জায় প্রচুর জং ধরেছে
ঘুরতে ফিরতে বিশ্রী আওয়াজ দেয়
শরীরের ভাঁজে ভাঁজে পুঁজ-পুষ্ট ঘা
চীৎকারে প্রতিদিন বাতাস পর্যন্ত কাঁদে।
ধনন্তরী আত্মাদের প্রতি
প্রেরণার মত ওয়ারলেস ম্যাসেজ রিলে করেছি-
সারিয়ে তুলুন পৃথিবীকে, সুন্দরীর হৃত
যৌবন ফিরিয়ে দিন।
আপনাদের বিদ্যে জাহির করুন
তা নইলে হাতের পরে তুলে নিলাম লেখনী
মহত বৃহতের খাতা থেকে ঘস ঘস কেটে দিচ্ছি
ঢোলা ঢোলা সব নাম।

যুবতীদের প্রতি রঙীন প্ররোচনা
কৃষ্ণচূড়ার বন লুট করে খোপায় কেশে
আগুনবরণ ফুল গুঁজে, জোছনা রাতের
আবছা আঁধারে মনের মানুষের হাত ধরে
বেরিয়ে পড়, বেরিয়ে পড় সব
পথে পথে অমৃত নির্ঝর, পেয়ালা
ভরো আর পান কর
২২ আহমদ ছফার কবিতা সমগ
রক্তিম মদের ফেনার মত লোহিত যৌবন উপচে উঠুক।
প্রেমিকদের কানে মুখ রেখে বলেছি,
বেদনার গভীর নির্জন তার স্পর্শ কর
ব্যথাকে ঘষে ঘষে তীক্ষ্ণ এবং চোখা করে
প্রতিটি ভাব অনুভব বিজুলি শিখায় যেন জ্বলে।
তোমাদের ভাগ্য চেকন সুতোয় ঝুলছে
অন্যথা শরীরে দোকান খোলা
মহিলাদের সঙ্গে ছেদবিহীন দাম্পত্য জীবন;
মাংসের কারাগারে বন্দী হিসেবে কাটাবে।

নিনাদিত হুকুম সেনানিদের প্রতি
ধর্মগুরুদের শখের আলখাল্লাগুলো খুলে ফেল
হাজির কর তাগোরে আমাগো থিয়েটার হলে
আর কবিতা পাঠের আসরে, নিপুণ অভিনয়
দেখে মানুষ মুগ্ধ হয়ে বিশ্বেস করুক
আর কবিতার আগুনে অন্তর শিক কাবাবের
মত সেঁকতে থাকুক।

বুড়ো পণ্ডিত মশাইদের প্রতি অনুরোধ
আপনারা নাসিকাযন্ত্রে ফুসফুসের ঘর্ঘর শব্দ তুলে
যখন নিদ্রিত হবেন, অনুগ্রহ করে সেই ঘুমের মধ্যে
মরে থাকবেন, এই যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতেও
বীরের সম্মান পাবেন। আমারই নির্দেশে
আগামীকাল সকালে পৃথিবীর নবযৌবন প্রাপ্তি ঘটছে।
বেঁচে ওঠার অপচেষ্টা করে
আপনারা ডাইনোসরের উত্তর পুরুষদের মত
হ্যাংলামো করবেন না।

আমার অক্ষৌহিনী সৈনিকদের
অস্ত্র শিক্ষা দেয়ার স্কুলে আমি অনেক গহন গভীর
মারাত্মক এবং প্রয়োজনীয় বিষয় শিক্ষা দিচ্ছি
দুনিয়ার সেরা প্রতিভাবান বলে কথিত মানুষটিও
এসবের নাগাল পাবে না কোনদিন।
আমার দূর পাল্লার যুগ অতিক্ৰমী কামান
আন্তঃমহাদেশীয় নতুন মূল্যচিন্তার ক্ষেপণাস্ত্র
এবং চিরঞ্জীব ট্যাংক কারখানায়
দিনরাত হরদম তৈরি হচ্ছে
নিঃশ্বাস ফেলবার অবকাশ নেই।
ইচ্ছে ছিল আপনাদের সকলকে ডেকে
মিটিং করে কাজটা করব।
পরে দেখলাম, সাত কুকুরে শেয়াল পাকড়ায়
কথাটা শুনতে চমৎকার, কিন্তু তাতে সত্যের
ছিঁটে ফোঁটাও নেই।

তাই আমার কাজ আমি একা করে ফেলেছি
নিন্দে প্রশংসা দুই-ই আমার।
কেউ যদি গাইগুই করে, নামঠিকানা
পাঠিয়ে দেবেন, দেখে নেব হালাই কেমন বাপের বেটা।
আমি একজন কবি জেনারেল কোন্‌ শালারে কেয়ার করি
কারাগারের চৌহদ্দীতে ঢাক পিটিয়ে জানিয়ে দেবেন
আমি মানে জনাব অমুক আস্ত লড়াইর ডাক দিয়েছি।