মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কোথায় জন্মায়

১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর লোকেরা আমাদের গ্রামের সাতষট্টিজন মানুষকে একই দিনে গুলি করে মেরে ফেলে। তার মধ্যে শিশু ছিল; যুবক, বুড়া এবং নারীও ছিল। এছাড়া গোটা যুদ্ধকালীন সময়টাতে আমাদের গ্রামের পনেরজন মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। এই পনেরজন মানুষ সরাসরি পাকিস্তানি সৈন্যের হাতে মারা মায়নি, রাজাকার এবং আলবদরদের হাতে নিহত হয়েছিল।

আমি দুটো খুনের ঘটনা জেনেছি। এক রাতের বেলা বাপবেটায় খুব দূরের একটা হাট থেকে একসঙ্গে ফিরছিল। চার মাইল রাস্তা হেঁটে আসার পর যখন বাড়ির একেবারে কাছে এসে বড় রাস্তা ছেড়ে আলপথটিতে উঠেছে, ঠিক সেই সময় বাপবেটা দুজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। গ্রামের মানুষ এই হত্যাকারীর নাম এবং পরিচয় জানতে পেরেছিল। এই দুজন হাটফেরত মানুষকে যে লোকটি খুন করেছিল সে ছিল নিহত দুজনের মধ্যে একজনের ভাগ্নে। মামা-ভাগ্নের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে সম্পত্তি নিয়ে মামলা চলছিল। ভাগ্নেটি মামা এবং মামাত ভাইয়ের ওপর ক্ষোভ নিয়ে জমি দখল করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে রাজাকার বাহিনীতে ভর্তি হয়েছিল। দেশে যখন একটা বড় ধরনের ঘটনা ঘটে তার প্রভাবে গ্রামবাসীর মধ্যে পারস্পরিক বিরাজমান সম্পর্কগুলোর পক্ষে এবং বিপক্ষে মেরুকরণ ঘটে। আমার শত্রু মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করছে, সুতরাং আমাকে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করতে হবে, এরকম দৃষ্টান্তও পাওয়া যাবে।

গোটা যুদ্ধের সময়টা আমি দেশের বাইরে ছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের পর যখন গ্রামে ফিরলাম, এই ন’মাস সময়ের মধ্যে কি ধরনের নিষ্ঠুর কর্মকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে ঘুরে ঘুরে সেগুলোর একটা তালিকা তৈরি করতে চেষ্টা করেছিলাম। সবচাইতে বেশি মানুষ খুন করা হয়েছে পালপাড়ায়। আমাদের গ্রামের একেবারে দক্ষিণপূর্ব সীমায় এ পাড়াটির অবস্থান। পালপাড়ার ক্ষেত্রমোহনের সঙ্গে স্কুলে পড়াশুনা করেছি। ক্ষেত্রমোহন নানান ধরনের মজার মজার গল্প বলে লোক হাসাতে পারত। অত্যন্ত তুচ্ছ জিনিসও সে এত মজা করে পরিবেশন করত যে হাসতে হাসতে আমাদের পেটে খিল ধরে যেত। ক্ষেত্রমোহনের সঙ্গে আমার গভীর বন্ধুত্ব ছিল। অনেক সময় আমি তাদের বাড়িতে রাত কাটাতাম। ক্ষেত্র সময়বিশেষে আমাদের বাড়িতে থেকে যেত। আমার এবং ক্ষেত্রমোহনের সম্পর্ক উপলক্ষ করে আমাদের দু’বাড়ির মধ্যে একটা সখ্যের সৃষ্টি হয়েছিল। আমি বাড়ি আসার পরদিনই পালপাড়ায় গেলাম। আমার ইচ্ছা ছিল একটা তালিকা তৈরি করব। কারা কারা মারা গেছে, কাদের কাদের ঘরবাড়ি জ্বালান পোড়ান হয়েছে।

আমি যখন গেলাম ক্ষেত্রমোহন বাড়িতে ছিল না। পাড়ার অন্যলোকদের কাছে আমি জানতে পারলাম কিভাবে ক্ষেত্রমোহনের বউ আগুনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। আত্মহত্যার বয়ানটি সংক্ষেপে একরকম। পাকিস্তানি সৈন্য এসে বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়ে যুবতী মেয়েদের ধরে টানাটানি করছিল- এই দৃশ্য সচক্ষে দর্শন করে ক্ষেত্রমোহনের বউ জ্বলন্ত আগুনে সরাসরি ঝাঁপ দিয়ে বসে এবং পুড়ে মারা যায়।

যুদ্ধের সময় অনেক মৃত্যু আমাকে একেবারে কাছ থেকে দাঁড়িয়ে দেখতে হয়েছে। এমন সময় গেছে জীবন-মৃত্যুর সীমারেখাটি আমার দৃষ্টি থেকে মুছে গিয়েছিল। কিন্তু যেভাবে ক্ষেত্রমোহনের বউটি আত্মহত্যা করেছিল সে সংবাদ শোনার পর আমাকে স্তব্ধ হয়ে যেতে হয়েছিল। এই মহিলাকে যখন ক্ষেত্রমোহন বিয়ে করতে যায় বরযাত্রী হিসেবে আমারও যাওয়ার কথা ছিল। কি কারণে জানি যাওয়া হয়নি। এ নিয়ে ক্ষেত্র আমার সঙ্গে অনেক রাগারাগি করেছিল। আমি গ্রামের বাড়িতে গেলেই অন্তত একবার ক্ষেত্রমোহনের বাড়িতে যেতাম। আমার গলার আওয়াজ শুনলেই ক্ষেত্রের বউ চুলায় চায়ের কেটলি চাপাত। ক্ষেত্রের বউয়ের সঙ্গে আমি অনেক দিন অনেক সুখদুঃখের কথা বলেছি।

আমি বলেছি আমি যখন পালপাড়ায় গিয়েছিলাম ক্ষেত্রমোহন বাড়িতে ছিল না। আধঘন্টা পর ক্ষেত্র ফিরে এসে আমার দেখা পেয়ে প্রথমেই জিজ্ঞেস করল- তোর কি চা খাওয়া হয়েছে? তাঁর স্ত্রীর আত্মহত্যা, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া এসব নিয়ে একটি কথাও সে উচ্চারণ করেনি। বরঞ্চ পুরনো দিনের মত রসিকতা করতে চেষ্টা করল। ক্ষেত্রের এই প্রয়াস দেখে আমার নিজেরই চোখ ফেটে কান্না বেরিয়ে আসতে চাইছিল।

আমার আরেক বন্ধু ছিল সাধন। পুরা নাম সাধনকুমার ধর। একেবারে ছোটবেলা থেকেই একটা চিকন ফ্রেমের চশমা পরত সে। তাকেও পাকিস্তানি সেনাবাহিনী খুন করে গেছে। সাধন থাকত তার কাকা শিবচরণবাবুর বাড়িতে। শিবচরণবাবুকেও খুন করা হয়েছে। বাড়ির আর যাঁরা বেঁচেছিলেন তাঁদের কাছে আমি অনুরোধ করলাম সাধনের চিকন ফ্রেমের চশমাটি যদি কাছে থাকে আমাকে দেখালে খুবই খুশি হব। বাড়ির লোকজন জানালেন চশমাটাসহই তাকে নিয়ে গিয়েছিল। সে আর ফিরে আসেনি।

১৯৭২ সাল থেকে শুরু করে যতবারই আমি গ্রামে গেছি, গ্রামের মানুষদের একটি বিষয়ে রাজি করাতে বারবার চেষ্টা করেছি। গ্রামের মেম্বার, চেয়ারম্যান এবং মাতব্বর-স্থানীয় মানুষদের একটা বিষয়ে রাজি করাতে বারবার চেষ্টা করেছি। আমি তাঁদের বোঝাতে চেষ্টা করেছিলাম- আমাদের গ্রামের প্রায় একশ মানুষ পাকিস্তানি সৈন্য এবং রাজাকার আলবদরদের হাতে প্রাণ হারিয়েছে। আমাদের গ্রামের মাঝ দিয়ে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রাস্তাটি চলে গেছে। আমি প্রস্তাব করেছিলাম গ্রামের প্রবেশমুখে মুক্তিযুদ্ধে নিহত এই শখানেক মানুষের নাম একটি বিলবোর্ড লিখে স্থায়ীভাবে রাস্তার পাশে পুতে রাখার জন্য।

আরো একটা বাক্য লেখার প্রস্তাব আমি করেছিলাম। সেটা ছিল এরকম- হে পথিক, তুমি যে গ্রামের ওপর দিয়ে যাচ্ছ সে গ্রামের একশত জন সন্তান দেশের স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিয়েছে। আমি আমার এই প্রস্তাবটি ১৯৭২ সাল থেকে করে আসছি। প্রথম প্রথম মানুষ আমার কথা মন দিয়ে শোনার চেষ্টা করত। তিন চার বছর অতীত হওয়ার পরও যখন প্রস্তাবটা নতুন করে মনে করিয়ে দিতাম লোকে ভাবত আমি তাদের অযথা বিব্রত করতে চাইছি। আমার ধারণা, বর্তমান সময়ে যদি আমি প্রস্তাবটা করি লোকে মনে করবে আমার মাথাটা সত্যি সত্যি খারাপ হয়ে গেছে।

উত্তরবঙ্গ, দক্ষিণবঙ্গ এবং মধ্যবঙ্গের প্রায় আট দশটি জেলায় আমাকে কার্যোপদেশে বিস্তর ঘোরাঘুরি করতে হয়েছে। আমি যেখানেই গিয়েছি লোকজনের কাছে জিজ্ঞেস করেছি, এখানে মুক্তিযুদ্ধের সময় কোন ঘটনা ঘটেছিল কিনা। অনেক গ্রামের লোক আমাকে জানিয়েছে, আমাদের গ্রামে পাঞ্জাবিরা একেবারেই আসেনি। অনেক গ্রামের লোক জানিয়েছে পাঞ্জাবিরা এসেছিল, ঘরবাড়ি জ্বালিয়েছে এবং অনেক খুনখারাবি করেছে। আমি জিজ্ঞেস করতাম যেসব মানুষ মারা গেছে তাদের নাম পরিচয় আপনারা জানেন কিনা। গ্রামের লোক উৎসাহসহকারে জবাব দিতেন- জানব না কেন। অমুকের ছেলে, অমুকের নাতি, অমুকের ভাই ইত্যাদি ইত্যাদি।

আমি তখন বলতাম, মুক্তিযুদ্ধে নিহত এই মানুষদের নাম আপনারা রাস্তার পাশে লিখে রাখেন না কেন। কোন লোক যখন আপনাদের গ্রামের ওপর দিয়ে যাবে এবং নামগুলো পড়বে তখন সেই পথিকের মনে আপনাদের গ্রাম সম্পর্কে একটা শ্রদ্ধাবোধ জন্ম নেবে। গ্রামের লোকেরা আমার মুখের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকত। যেন আমি কি বলছি সেটার মর্মগ্রহণ করতে একেবারে অক্ষম। বাংলাদেশের যে সমস্ত অঞ্চলে আমি গিয়েছি কোথাও দেখিনি মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের নাম যত্ন এবং সম্মানের সঙ্গে লিখে রাখা হয়েছে। এ ধরনের একটি কাজ করার জন্য আহামরি কোন উদ্যোগের প্রয়োজন ছিল না। দেশের প্রতি এটুকু ভালবাসা এবং মুক্তিযুদ্ধের কারণে নিহত মানুষদের প্রতি এটুকু শ্রদ্ধাবোধই যথেষ্ট ছিল।

ডিসেম্বর মাস এলেই ঢাকা শহরে মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে যায়। ফরসা কাপড়চোপড় পরা যে সকল ভদ্রমহিলা এবং ভদ্রলোক কাঁপা কাঁপা গলায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বয়ান করেন তারা কি জানেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কোথায় জন্মায়?