শেখ মুজিব: ইতিহাসের নিরিখে

একজন বড় মানুষের মূল্যায়ন একদিন, এক বছর বা একযুগে করা অনেক সময় অসম্ভব। মৃত্যুর অনেকদিন পর পর্যন্ত ইতিহাসে তাদের ভূমিকা নিয়ে আলােচনা সমালােচনা চলতে থাকে। নেপােলিয়ানের ভূমিকা সম্পর্কে বিতর্ক এখনও সমানে চলছে। জর্জ ওয়াশিংটনের বাপারে বির্তকের এখনও অবসান হয়নি। ফরাসি বিপ্লবের নায়ক রোবস্ পিয়ার এবং দাঁতোর পক্ষে বিপক্ষে ঐতিহাসিকরা এখনও নানারকম রায় দিয়ে যাচ্ছেন।

আমার ধারণা শেখ মুজিবুর রহমান এই ধরনের একজন বড় মাপের মানুষ। এ অঞ্চলের ইতিহাসে তিনি যে বিরাট ভূমিকা পালন করে গেছেন তা ভারত উপমহাদেশের পূর্বদিকের ভূখন্ডসমূহে অনেকবার পরিবর্তন এবং রূপান্তর ঘটাবে। শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক সংগ্রামের মধ্যদিয়ে ভারত উপমহাদেশের ইতিহাসের একটি ভিন্নমুখি প্রক্রিয়া ক্রিয়াশীল এবং জোরদার হয়েছে। শেখ মুজিবের রাজনৈতিক অনুসারীরা এটা সমর্থন করবেন কি করবেন না সেটা বড় কথা নয়। বিরােধীরা শেখের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের কতদূর স্বীকৃতি দেবন সেটাও ধৰ্তব্যের বিষয় নয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে যে সমস্ত ঘটনা এ উপমহাদেশে ঘটছে, নিরপেক্ষ বিচারেও সেগুলাের সঙ্গে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের প্রতিক্রিয়া জড়িত না করে উপায় নেই।

বাংলাদেশের প্রনিধানযােগ্য পরিচয় হল বাংলাদেশ একটি ভাষাভিত্তিক জাতীয় রাষ্ট্র। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পরে প্রত্যেকটি সরকার জাতীয় রাষ্ট্র পরিচয় পাশ কাটিয়ে নানারকম পরিচয় চিহ্ন আবিষ্কার করতে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তার কোনটিই ধোপে টেকেনি। ভাষাভিত্তিক জাতীয় রাষ্ট্র- এ পরিচিত এড়িয়ে গিয়ে অন্যকোন পরিচয়ে বাংলাদেশকে চিহ্নিত করার উপায় নেই। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে এ উপমহাদেশে বাংলাদেশই হচ্ছে যথার্থ অর্থে একটি রাষ্ট্র যা ইউরােপের জাতীয় রাষ্ট্রসমূহের মত অনেকটা একই রকম বৈশিষ্ট্যের ধারকবাহক। ভারত-পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভিত্তিমূল যথেষ্ট রকমের সূদৃঢ় নয়। আজ পর্যন্ত ভারত এবং পাকিস্তান সেসব দেশের সর্বসাধারণের বােধগম্য একটি জাতীয় ভাষা চালু করতে পারেনি। ভারতের শিক্ষিত জনসাধারণ ইংরেজির মাধ্যমেই পরস্পরের সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা করেন। এ ভাষাটা ভারতের কোন অঞ্চলেরই জনগণের মুখের ভাষা নয়। সুতরাং যােগাযােগ রক্ষার এ পদ্ধতিটা সম্পূর্ণভাবেই কৃত্রিম। শেষ পর্যন্ত বিচ্ছিন্নতার শক্তিকে প্রতিহত করে ভারত জাতীয় অখণ্ডত্ব কিভাবে রক্ষা করে তা সকলেরই আগ্রহ এবং অনুসন্ধিৎসার বিষয়। পাকিস্তান ঘােষিতভাবে ধর্মতান্ত্রিক রাষ্ট্র। ইসলামই হল পাকিস্তানের জাতীয় ঐক্যের প্রতীক। কিন্তু ইসলামি সৌভ্রাতৃত্ববােধ পাকিস্তানের জাতীয় ঐক্যকে সূদৃঢ় করছে না। সেখানে জাতিগত বিরােধ মাঝে মাঝে এমন প্রবল আকার ধারণ করে মনে হয় এই বুঝি পাকিস্তান টুকরাে টুকরাে হয়ে ভেঙে পড়ল। ভারত পাকিস্তানের জাতিগত দাঙ্গা-হাঙ্গামা বিদ্রোহ এগুলো কমবেশি রাষ্ট্রের কৃত্রিম ভিত্তির প্রমাণ বহন করে।

সেসব কথা থাকুক। আমরা শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা নিয়ে আলােচনা করছিলাম। শেখ মুজিবুর রহমান হয়ত জানতেন, হয়ত জানতেন না তিনি একটি ভাষাভিত্তিক জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করছেন। আমরা দেখেছি তাঁর সে সংগ্রাম জয়যুক্ত হয়েছে। তথাপি বাংলাদেশকে পুরােপুরি ভাষাভিত্তিক জাতীয় রাষ্ট্র হিসেবে মেনে নিতে অনেকেরই আপত্তি আছে। তার সঙ্গত কারণও রয়েছে। এক সময় হিন্দু মুসলমান জনসংখ্যার ভিত্তিতে ভারতবর্ষ দ্বিখণ্ডিত হয়েছিল। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তান রাষ্ট্রেরই একটি দূরবর্তী অংশ ছিল। এখানে ইসলাম একটি রাজনৈতিক শক্তি সেকথা অস্বীকার করার উপায় নেই। ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রদর্শনটি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত হলেও তার সবটা প্রাণশক্তি এখনও বােধ করি অবসিত হয়নি। তাই ভাষাভিত্তিক জাতীয় রাষ্ট্র বাংলাদেশেও ধর্মীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জিগির লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু সে ধরনের আরেকটি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা একরকম অসম্ভব। ভাষাভিত্তিক জাতীয় রাষ্ট্র বলার আরও একটা বিপদ আছে। এখানকার জনসাধারণের এক মুষ্টিমেয় অংশ (অর্থাৎ উপজাতীয়রা) বাংলাভাষায় কথা বলেন না। আবার বাংলাভাষী জনগণের এক বিরাট অংশ বাংলাদেশের বাইরে বসবাস করেন। এসব সত্য, বাংলাদেশের কিছু মানুষ বাংলায় কথা বলেন না। বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মের আবেদন বেশ সক্রিয় এবং জোরাল। বাংলাভাষাভাষী সব মানুষ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বাস করেন না। তারপরেও বাংলাদেশকে ভাষাভিত্তিক জাতীয় রাষ্ট্র বলে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। হতে পারে সবগুলাে বৈশিষ্ট্য সমানভাবে পরিস্ফুট নয়। এ ভাষাভিত্তিক জাতীয় রাষ্ট্রটির সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের নামটি যুক্ত হয়ে গেছে। ইতিহাসে পাঁচ দশ কিংবা বিশ বছর অধিক সময় নয়। কালে কালে এ জাতীয় রাষ্ট্রের প্রভাবে ভারতের পূর্বাঞ্চল, পূর্বাঞ্চল কেন, সমগ্র ভারত উপমহাদেশ জুড়ে ভাষাভিত্তিক জনগােষ্ঠীর একটা আশ্চর্য উত্থান লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এর পরিণতি কি হবে এখনও তা কেউ বলতে পারে না। কোন কোন দূরদর্শী ব্যক্তি এ গােটা উপমহাদেশ জুড়ে একটা কনফেডারেশন গঠনের সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখছেন। আবার কেউ কেউ বলছেন ভাষার পরিচয়ই হয়ে দাঁড়াবে ভৌগােলিক সীমানা নির্ধারণের মুখ্য পরিচয় চিহ্ন। পরিস্থিতি যেদিকেই যাক না কেন, বাংলাদেশ আধুনিক অর্থেই একটি আধুনিক জাতীয় রাষ্ট্র সেকথা মেনে নেয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই এবং শেখ মুজিবুর রহমান এ রাষ্ট্রটির স্থপতি। বাংলাদেশের লিখিত ইতিহাস যতদূর জানা যায় তাতে স্বাধীন সার্বভৌম কোন রাষ্ট্রীয় অস্তিত্বের প্রমাণ মেলে না। প্রসঙ্গক্রমে আমরা দার্শনিক হেগেলের সে মতটির কথা উল্লেখ করতে পারি। মানুষের যাবতীয় সৃষ্টির মধ্যে রাষ্ট্রই হচ্ছে তার সৃষ্টিশক্তির সর্বশ্রেষ্ঠ প্রকাশ। বাঙালি কোনদিন একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রযন্ত্রের চালক হতে পারেনি। বাঙালি চরিত্রের যে অসম্পূর্ণতা এবং অসঙ্গতির কথা অনেক সময় বিজ্ঞজনেরা উল্লেখ করে থাকেন, একটি স্বাধীন রাষ্ট্রযন্ত্রের অধিকারী না হওয়ার জন্য তার চরিত্রে এ সমস্ত অবগুণ্ঠন আশ্রয় করেছে। ১৯৭১-এর মুক্তি সংগ্রামের পরে এ অঞ্চলে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ইতিহাসের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা। যদিও রাষ্ট্র সবগুলাে প্রতিশ্রুতি এবং সম্ভাবনা মূর্ত করে তুলতে পারেনি, তথাপি এর ভৌগােলিক অবস্থানের বিশেষ একটি মূল্য রয়েছে। কল্পনা করতে দোষ কি? যদি ভূমিকম্প কিংবা কোন প্রাকৃতিক দুর্বিপাক দুর্যোগে এ ভূখণ্ড তলিয়ে না যায় তাহলে এ রাষ্ট্রের অস্তিত্ব কেউ পয়মাল করতে পারবে না। শেখ মুজিবুর রহমানের সংগ্রামের মধ্যদিয়ে প্রথম বাঙালি জনগােষ্ঠীর একটি জাতীয় রাষ্ট্র অস্তিত্ববান হয়ে উঠেছে। ভারতবর্ষের আধুনিক ইতিহাসে এটা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা না হলেও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাসমূহের একটি।

ইতিহাস ব্যক্তির সংগ্রাম এবং আকাঙ্ক্ষার ভেতর দিয়ে এমনভাবে কাজ করে যা অনেক সময় ব্যক্তিও ইতিহাসের গতিধারাটি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকেন না। এটা তাে সত্য, প্রতিটি মানুষ-তিনি ক্ষুদ্র অথবা বিরাট যাই হােন, সকলেই তো ইতিহাসের হাতের পুতুল। ছােট-বড় সকলের কর্মকাণ্ডের মধ্যদিয়েই ইতিহাস তার গতিধারা প্রসারিত করছে। ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সেটা আগাম বলে দেয়া সম্ভব নয়। ক্রমবিকাশের মাধ্যমে ঐতিহাসিক গতিধারায় কতিপয় সম্ভাবনা মূর্ত না হওয়া পর্যন্ত, অনেক সময় একেকজন বড় মানুষের চরিত্রের উজ্জ্বল দিকটা অনুদঘাটিত থেকে যায়। আমার মনে হয় বাঙালি জাতীয় রাষ্ট্রের স্থপতি হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান সবচেয়ে বড় আসনটি অধিকার করে থাকবেন। যতই দিন যাবে বাঙালির জনগোষ্ঠীর ইতিহাসে শেখ মুজিবুর রহমান দীর্ঘতর ছায়া প্রসারিত করতে থাকবেন।

উত্তরণ ১৯-২৫ আগস্ট, ১৯৯০।