ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রভাব বোঝার অক্ষমতা

বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রসার ও তার প্রতিক্রিয়ার বিষয়ে উৎসাহ এবং উদ্বেগ দুই-ই আছে। গত কয়েক মাসে এ নিয়ে আলাপ-আলোচনায় দেশের ইতিহাসে বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক দল বা ইসলামপন্থীদের উত্থান ও শক্তি সঞ্চয়ের বিষয়টিকে কেবল দেশের ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করাই যথেষ্ট নয়। গত কয়েক দশকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ইসলামপন্থীরা শক্তি সঞ্চয় করেছে। তার পেছনে কাজ করেছে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন, বিশেষত রাজনৈতিক আদর্শ হিসেবে সমাজতন্ত্রের আবেদন হ্রাস। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি। ১৯৮০-এর দশকে আফগানিস্তান থেকে শুরু করে ২০১৩ সালে সিরিয়া পর্যন্ত অনেক দেশেই মার্কিন নীতি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ইসলামপন্থীদের শক্তি জুগিয়েছে। বিভিন্ন দেশে নির্বাচনের মাধ্যমে ইসলামপন্থীরা ক্ষমতায় এসেছে। ফিলিস্তান প্রশ্নে পশ্চিমা দেশগুলোর দুমুখো নীতি সাধারণ মানুষের কাছে ইসলামপন্থীদের আবেদন তৈরি করেছে। দেশে দেশে সেক্যুলার রাষ্ট্র এবং তাদের নেতারা জনসাধারণের ন্যূনতম চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হওয়ার কারণে, তাঁদের দুর্নীতির কারণে ইসলামপন্থীরা নিজেদের বিকল্প হিসেবে উপস্থাপনের সুযোগ লাভ করেছে।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মধ্যপ্রাচ্য এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার (যেমন মালয়েশিয়া) কিছু দেশের সঙ্গে সামাজিক ও অর্থনৈতিক যোগাযোগ। একদিকে স্বল্প মেয়াদের জন্য মধ্যপ্রাচ্যে/ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যাওয়া মানুষের মধ্যে তৈরি হয়েছে একধরনের ধর্মীয় রাজনীতির আকাঙ্ক্ষা, অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যের কোনো কোনো দেশের পক্ষ থেকে দেওয়া আর্থিক সহযোগিতায় দেশের ভেতরে সামাজিক ও শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছে, যেগুলো একধরনের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক কাঠামোর পক্ষে মানসিকতা তৈরি করেছে। ক্ষেত্রবিশেষে কোনো কোনো রাজনৈতিক দল এই সুবিধা লাভ করে তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভিত্তি তৈরি করেছে। আজ তাদের আর এই বিদেশি সাহায্যের দরকার না হলেও অতীতে সেগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বিশ্বায়নের যে সুযোগে বাংলাদেশ তার অর্থনৈতিক ভিত্তি জোরদার করেছে, সে পথেই ধর্মভিত্তিক রাজনীতির চিন্তা দেশের ভেতরে প্রসারিত হয়েছে। তা কেবল দরিদ্র মানুষের মধ্যে সীমিত আছে বলে মনে করার কারণ নেই। বাংলাদেশের বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সমর্থনের মাত্রা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর চেয়ে খুব কম নয়।

বর্তমান পরিস্থিতি
বিভিন্ন কারণে ও প্রক্রিয়ার ফসল হিসেবে বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রসার ঘটেছে। বাংলাদেশের সমাজে এই রাজনীতির প্রতি আকারে ছোট হলেও সমর্থন রয়েছে। তবে লক্ষণীয় হলো, গত চারটি নির্বাচনে এটাও প্রমাণিত হয়েছে যে এই সমর্থনের পরিমাণ অত্যন্ত কম; নির্বাচনী হিসাবে সব ইসলামপন্থী দল মিলে গড়ে ৮ শতাংশের বেশি ভোট পায়নি। বাংলাদেশের মানুষ এখনো ধর্মকে ‘রাজনৈতিক আদর্শ’ হিসেবে বিবেচনা করে না। তাদের কাছে সামাজিক জীবনে ধর্ম গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রভাবশালী; কিন্তু সেই গুরুত্ব যত বিশালই হোক না কেন, রাজনীতিতে তারা ধর্মের ব্যবহার দেখতে চায় না; ধর্মভিত্তিক দলকে তাদের যথাযথ প্রতিনিধিও মনে করে না। এ ধরনের অবস্থা সত্ত্বেও সাম্প্রতিক কয়েক মাসে আমরা দেখেছি যে জামায়াতে ইসলামী এবং সম্প্রতি তাদের পক্ষে হেফাজতে ইসলামের সহিংস ঘটনা। এসবের পেছনে আস্তিকতা-নাস্তিকতার প্রশ্ন, ধর্মের অবমাননা, সংবিধানে আল্লাহর ওপর বিশ্বাসের ঘোষণা পুনঃস্থাপনের কথা যতই বলা হোক, প্রকৃতপক্ষে এই অবস্থার কারণ হলো চলমান যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও বিরাজমান রাজনৈতিক সংকট। সাময়িক রাজনৈতিক সংকট থেকে এর উদ্ভব ঘটলেও এ বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণার অভাব ও সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের ঘাটতি থাকলে এটি কেবল এই সময়ের মধ্যে সীমিত থাকবে না। এই পরিস্থিতি যথাযথভাবে মোকাবিলা করতে না পারলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির ওপর তার বিরূপ প্র্রভাব পড়বে।

ধর্মভিত্তিক দল শক্তিশালী হলে কী হয়?
ধর্মভিত্তিক দলের লক্ষ্য আর দশটা রাজনৈতিক দলের চেয়ে ভিন্ন কিছু নয়। তারা চায় রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে। কিন্তু রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার জন্য রাজনৈতিক আদর্শ প্রচারের ক্ষেত্রে ধর্মভিত্তিক দলগুলো ব্যক্তির সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি দেয় না। লিবারেল গণতন্ত্রের একটা অন্যতম ভিত্তি হচ্ছে ব্যক্তির সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন। ইসলামপন্থী দলগুলো মনে করে, ব্যক্তির সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি আল্লাহর সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে এবং সে কারণেই তা অগ্রহণযোগ্য। (এই ধারণা একসময় খ্রিষ্টান সমাজেও বিরাজমান ছিল; এখনো যুক্তরাষ্ট্রের ইভাঞ্জেলিক্যালদের মধ্যে এই ধারণা রয়েছে)। দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, যেকোনো ধর্মেরই রয়েছে চূড়ান্ত সত্যের (আলটিমেট ট্রুথ) দাবি; ফলে যে বিষয়ে চূড়ান্ত সত্য ইতিমধ্যে নির্ধারিত হয়ে গেছে, তা নিয়ে আলোচনার পথ বন্ধ হয়ে যায়। যদি সমাজ ও রাষ্ট্রের বিষয়ে ধর্মের অনুশাসনে কিছু বলা হয়ে থাকে, তা নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্কের দরজা ধর্মভিত্তিক দল বন্ধ করে দিতে কেবল উৎসাহীই নয়, বাধ্যও বটে। এসবই সমাজে বহুত্ববাদিতার (প্লুরালিটি) প্রতিকূল ধারণা। এখানে স্মরণ করা যেতে পারে, ধর্মভিত্তিক দলগুলো ধর্মীয় সহিষ্ণুতার (টলারেন্স) কথা বললেও ধর্মীয় বহুত্ববাদিতার (প্লুরালিজম) বিষয়ে নীরবতা পালন করে; ক্ষেত্রবিশেষে তার বিরোধিতাও করে থাকে। ধর্মভিত্তিক দলগুলো যখন রাজনীতিতে প্রবেশ করে, তারা কি এ কথা স্বীকার করে, তাদের রাজনৈতিক আদর্শ হচ্ছে একটি ধর্মভিত্তিক মতামত, কিন্তু তা সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়; আর দশটা রাজনৈতিক মতবাদের মতোই এটিও পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ভুলভ্রান্তির জন্য প্রস্তুত একটি মতবাদ কিংবা সাধারণ সাংবিধানিক কাঠামোর প্রতি শ্রদ্ধাশীল একটি রাজনৈতিক আদর্শ মাত্র? যদি এর কোনোটাই ধর্মভিত্তিক দল মেনে নিতে অসম্মত হয়, তবে তার বুঝতে হবে যে ওই রাজনীতি গণতান্ত্রিকতার বিরোধী।

ধর্মভিত্তিক দলের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার সবচেয়ে বড় নেতিবাচক দিক হলো নাগরিকের সমান অধিকারের ধারণার অবসান। রাষ্ট্র যখন কোনো ধর্মের প্রতি পক্ষপাত দেখায়, তখন সেই রাষ্ট্র আইনের চোখে নাগরিকের সমতার ধারণাকে জলাঞ্জলি দেয়। এটা যে ধর্মভিত্তিক দল কেবল ক্ষমতায় গেলেই ঘটে, তা-ই নয়; রাজনীতিতে ধর্মভিত্তিক দল যখন প্রভাবশালী হয়ে ওঠে, তখনো সেটা ঘটে। পাকিস্তানে ধর্মভিত্তিক দলগুলো ১৯৭৪ সালে দেশের সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে আহমাদিয়া গোষ্ঠীকে ‘কাফের’ বলে চিহ্নিত করতে বাধ্য করেছে। বাংলাদেশের ইসলামপন্থী দলগুলো অনেক দিনে ধরেই সেই দাবি তুলে আসছে এবং সম্প্রতি হেফাজতের ১৩ দফা দাবিতেও এটা রয়েছে, ধর্মভিত্তিক অন্য যে দল ও সংগঠন তাদের বিরোধিতা করেছে, তারাও এই দাবির বিষয়ে একমত। বাংলাদেশে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলাম অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ফলে নাগরিকের সমতার প্রশ্ন ইতিমধ্যেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে আছে, এখন চাপ দিয়ে সে পথে ঠেলে দেওয়ার জন্যই ইসলামপন্থীরা চেষ্টা করছে।

পাকিস্তানে জিয়াউল হকের সময় ১৯৭৯ সালে চালু হওয়া হুদুদ আইনের কথা অনেকেরই জানা আছে। নারীদের নিরাপত্তা ও জীবন এই আইনের কারণে বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ২০০৬ সালে পাস হওয়া নারী সুরক্ষা বিল এই হুদুদ আইনের সংশোধন করলেও হুদুদের বিপজ্জনক অবস্থার সম্পূর্ণ অবসান হয়নি। বাংলাদেশে আজ যারা হেফাজতে ইসলামের পতাকাতলে সমবেত হয়েছে, তারা প্রথম ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে নারী উন্নয়ন নীতিমালার বিরোধিতার মধ্য দিয়ে। নারীর অধিকারের প্রশ্নটি ইসলামপন্থীদের জন্য একটা বড় বিষয়। ইসলামপন্থীদের একাংশ নারীর সীমিত অধিকারের সমর্থক হলেও তা সীমিত মাত্র; অন্য পক্ষে হেফাজতের মতো ইসলামপন্থীরা নারীর স্বাভাবিক চলাফেরার ওপরও বাধা-নিষেধের পক্ষপাতী।

ধর্মভিত্তিক দল রাষ্ট্রের আইন প্রণয়নে তাদের প্রভাব বিস্তার করতে পারলে তারা যে ব্লাসফেমি আইন প্রচলনে উৎসাহী হবে, তা আমরা কমবেশি সবাই জানি। পাকিস্তানে প্রচলিত এই আইনের আদলে ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশে একটি আইন চালুর জন্য সংসদে আইনের প্রস্তাব করেছিলেন জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে মতিউর রহমান নিজামী। হেফাজতের ১৩ দফায়ও ভিন্ন ভাষায় একই দাবিই তুলে ধরা হয়েছে। পাকিস্তানে ব্লাসফেমি আইনের পরিণাম বলা বাহুল্য। এই আইনের আওতায় এক হাজার ২০০-এর বেশি লোক অভিযুক্ত হয়েছে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরাই মিথ্যা অভিযোগে হয়রানির শিকার হয়েছে এবং অনেক ক্ষেত্রে মৃত্যুবরণ করেছে। এই আইনের বিরোধিতা করে একজন গভর্নর ও একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আততায়ীর হাতে প্রাণ দিয়েছেন। এসব কয়েকটি উদাহরণ মাত্র। ধর্মরাষ্ট্র বা থিওক্রেটিক স্টেট প্রতিষ্ঠিত হলে কী পরিস্থিতি দাঁড়াবে, তা বোঝার জন্য ইরানের দিকে তাকানোই যথেষ্ট। ধর্মীয় অনুশাসনের ব্যবহার করে রাষ্ট্র পরিচালনার আরেক উদাহরণ সৌদি আরব নিশ্চয়ই ইতিবাচক সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয় না।

বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক দল যতই শক্তি প্রদর্শন করেছে, বাংলাদেশের প্রধান দলগুলো ততই সেই চাপের মুখে পশ্চাদপসরণের পথ বেছে নিয়েছে। সর্বসাম্প্রতিককালে হেফাজতের দাবিদাওয়ার মুখে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক কোরআন শরিফের প্রতিকৃতির সামনে বসে সাক্ষাৎকার প্রদান, হেফাজতের দাবি বিবেচনার, অংশত মেনে নেওয়ার এবং মদিনা সনদের ভিত্তিতে দেশ পরিচালনার ঘোষণা তার প্রমাণ। অন্যদিকে বিএনপি হেফাজতের দাবিদাওয়ার বিষয়ে কোনো রকম ধারণা ছাড়াও (এমনকি সংগঠনের নামের বিষয়ে খালেদা জিয়ার অজ্ঞতা সত্ত্বেও) আশু রাজনৈতিক স্বার্থে এই সংগঠনকে ব্যবহারের যে চেষ্টা করেছে, তা থেকে বোঝা যায় যে দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও সমাজজীবনে ধর্মভিত্তিক দলের প্রভাবকে বিবেচনায় না নিয়েই রাজনীতিবিদেরা এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিচ্ছেন।

প্রকাশকালঃ মে ৩১, ২০১৩।