মিসরে সিজারতন্ত্রের উদ্ভব!

মুসলিম ব্রাদারহুডের কর্মী-সমর্থকদের অব্যাহত অবস্থান ধর্মঘটের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর রক্তক্ষয়ী অভিযানের পর দেশে এক মাসের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। অনেক জায়গায় কারফিউ জারি করা হয়েছে, আটক করা হয়েছে ব্রাদারহুডের আরও অনেক নেতাকে। মিসরের বর্তমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপট কমবেশি সবার জানা। ব্রাদারহুডের নেতা মোহাম্মদ মুরসির নেতৃত্বাধীন নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে ‘তামারোদ’ বা ‘বিদ্রোহ’ বলে পরিচিত নতুন এক রাজনৈতিক মোর্চার কয়েক দিনের বিক্ষোভের পরিপ্রেক্ষিতে সেনাবাহিনী ৩ জুলাই মুরসিকে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে ক্ষমতাচ্যুত করে, তাঁকেসহ শীর্ষস্থানীয় ব্রাদারহুড নেতাদের আটক করে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে এবং একটি বেসামরিক সরকার নিয়োগ দেয়। এর পর থেকেই ব্রাদারহুডের কর্মীরা মুরসিকে ক্ষমতায় পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবিতে অব্যাহতভাবে বিক্ষোভ করে আসছিল।

গত প্রায় দেড় মাসে কয়েক দফায় সেনাবাহিনীর সঙ্গে এবং অনেক জায়গায় সেক্যুলারপন্থী বলে পরিচিত রাজনৈতিক কর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়; তাতে মৃতের সংখ্যা সব মিলিয়ে ১০০-এরও বেশি। ব্রাদারহুডের ডাকে সেই থেকেই রাজধানী কায়রোতে দুটো জায়গায় কার্যত অব্যাহত অবস্থান ধর্মঘট চলছিল। ব্রাদারহুডের সমর্থকেরা সেনাবাহিনীর দেওয়া নির্বাচন অনুষ্ঠানের নতুন সময়সীমা প্রত্যাখ্যান করে এবং তাদের নেতার পুনঃপ্রতিষ্ঠার কম কোনো রকম ব্যবস্থা মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায়। বিভিন্ন দেশের পক্ষ থেকে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে, বিবদমান সেনাবাহিনী-সমর্থিত বেসামরিক সরকার এবং ক্ষমতাচ্যুত ব্রাদারহুডের নেতাদের মধ্যে আপসরফার চেষ্টা চালানো হলেও এটা বোঝা যায় যে সেটা শেষাবধি সফল হয়নি। বরং উভয় পক্ষই তাদের অবস্থানে অনড় থেকেছে।

তবে সেনা অভিযান শুরু হওয়ার পর বার্তা সংস্থা রয়টার্সের পরিবেশিত খবরে বলা হয়েছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি বার্নাডিনো লিও বলেন, তাঁরা একটি সমাধানের পথেই এগোচ্ছিলেন এবং মিসরীয় সেনা কর্তৃপক্ষকে অভিযান পরিচালনা থেকে বিরত থাকতে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু সেনাবাহিনী এই আবেদনে সাড়া দেয়নি, পরিণতিতে বুধবারের সেনা অভিযান, যাতে মৃতের সংখ্যা সরকারি হিসাবে ২৩৫ জন, ব্রাদারহুডের দাবি মোতাবেক কয়েক শ, এমনকি হাজারেও পৌঁছতে পারে। সেই সেনা অভিযানের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে ক্ষমতাসীন বেসামরিক সরকারের যে কোনো রকম ভূমিকাই ছিল না তা বোঝা যায়, যখন ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ এল বারাদি এই বলে পদত্যাগ করেন যে এই রক্তপাতের দায় তিনি নেবেন না। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি এই অভিযানের নিন্দা করেছেন। ৩ জুলাই সেনাবাহিনীর নেওয়া ব্যবস্থাকে যাঁরা সেনা অভ্যুত্থান বলতে রাজি ছিলেন না, তাঁরা এখন আর কোন যুক্তিতে একে অন্য কিছু বলে বর্ণনা করবেন, সেটাই দেখার বিষয়।

২০১১ সালে হোসনি মোবারকের সরকারের পতনের পর এবং কয়েক দফা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে মিসরের রাজনীতিতে চারটি শক্তির অবস্থান তৈরি হয়েছে। এগুলো হলো, ক্ষমতাসীন ইসলামপন্থী (মুরসি ও ব্রাদারহুড যার প্রধান প্রতিনিধি); নির্বাচনে পরাজিত সেক্যুলার দলগুলো (এল বারাদি ও অন্যরা যার প্রতিনিধিত্ব করছে); সাবেক মোবারক সরকারের অবশিষ্টাংশ (আদালত যার অন্যতম প্রতিনিধি) এবং সেনাবাহিনী। ২০১২ সালের শেষ নাগাদ প্রেসিডেন্ট মুরসি যখন ডিক্রি জারি করে তাঁর ক্ষমতা সংহত করে এবং তা বাড়িয়ে প্রায় একনায়কী পর্যায়ে নিয়ে যেতে চান, তখন আমরা দেখতে পাই যে নীতিগতভাবে তিনটি শক্তি নিজ নিজ অবস্থান থেকে তার বিরোধিতা করে। মুরসিকে তখন বাধ্য হয়েই পিছিয়ে আসতে হয়।

সেই পটভূমিকায় আমি ৩ ডিসেম্বর ২০১২ সালে আমার এই ধারণা ব্যক্ত করেছিলাম যে সেনাবাহিনী ‘পেছন থেকে সুতো টানছে কিংবা সময়ের অপেক্ষায় বসে আছে’ (‘মিসরের রাজনৈতিক সংকট: চার ব্যাখ্যা’ ২ ডিসেম্বর ২০১২, বিডিনিউজ২৪ডটকম)। আমার ধারণা হয়েছিল, এরা প্রত্যেকেই চায় নিজ নিজ পক্ষের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করতে। এ লড়াইয়ে যার হাতে যে অস্ত্র আছে, সে তা-ই ব্যবহার করছে। যতক্ষণ না একটি শক্তি অন্যের ওপর আধিপত্য নিশ্চিত করতে পারছে, কিংবা শক্তিগুলোর মধ্যে একধরনের মেরুকরণের মধ্য দিয়ে নতুন পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত সংকট কাটানো যাবে না।

২০১৩ সালের জুন মাস নাগাদ এই শক্তিগুলোর মধ্যে প্রত্যক্ষ সমঝোতার ইঙ্গিত দেখা যায়। এই সমঝোতা কেবল এ কারণে তৈরি হয়নি যে এই তিন শক্তি ক্ষমতায় যেতে বা ক্ষমতাকে প্রভাবিত করতে চাইছে, বরং এই কারণেও যে ক্ষমতাসীন ব্রাদারহুড তাদের নির্বাচনী বিজয়কে বিভিন্নভাবে অপব্যবহার করতে শুরু করে। দল এবং রাষ্ট্রের মধ্যে পার্থক্য কার্যত অপসারিত হয় এবং সমাজ, রাজনীতি, প্রশাসনের ইসলামীকরণের চেষ্টা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তবে মনে রাখা দরকার, মুরসির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের প্রতিবাদের প্রধান কারণ ছিল শাসক দল হিসেবে ব্রাদারহুডের রাজনৈতিক শাখা ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টির ব্যর্থতা। দল পরিচালনা ও সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে যে পার্থক্য, তা বুঝতে দলের নেতাদের ব্যর্থতার মাশুল গুনতে হয়েছে দলটিকে।

বুধবার যে সেনা অভিযান চলেছে তার পাশাপাশি কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, যা থেকে এই ধারণা বদ্ধমূল হচ্ছে যে সেনাবাহিনী শিগগিরই ক্ষমতা থেকে সরে যাবে না। মিসরের সেনাবাহিনী ক্ষমতা ছাড়ার ব্যাপারে যে কখনোই খুব আগ্রহী ছিল তা নয়। মনে রাখা দরকার, ২০১১ সালে মোবারক সরকারের পতনের পর ১৭ মাস ধরে সেনাবাহিনী ক্ষমতায় ছিল এবং তারা গণতন্ত্রায়ণের পথে বিভিন্ন ধরনের শর্তারোপের মাধ্যমে একে বিলম্বিত করেছে। যেসব ব্যবস্থা ক্ষমতায় সেনাবাহিনীর দীর্ঘমেয়াদি অবস্থানের ইঙ্গিত দেয়, তার অন্যতম হলো দেশের ২৫টি প্রদেশে নিয়োগ দেওয়া গভর্নরদের তালিকা। এর মধ্যে ১৯ জনই প্রতিরক্ষা বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত, ১৭ জন সেনাবাহিনীর এবং দুজন পুলিশের। বাকিদের মধ্যে দুজন বিচারক, যাঁরা মোবারকের আমলেই শুধু নিয়োগপ্রাপ্ত তা-ই নয়, তাঁরা মোবারকের প্রতি অনুগত বলেও পরিচিত। মুরসির আমলে নিয়োগ করা ১১ জন ইসলামপন্থীর কেউই টেকেননি, কিন্তু ওই আমলে নিয়োগ দেওয়া নয়জন জেনারেলের ছয়জনকেই ক্ষমতায় রাখা হয়। সেনাবাহিনী-সংশ্লিষ্টদের টিকে থাকা যে কাকতালীয় কিংবা সৌভাগ্যের ব্যাপার নয়, তা নিশ্চয়ই বোঝা যায়।

জুলাই মাসে সেক্যুলারপন্থীদের বিক্ষোভ সামনে রেখে সেনাবাহিনী ক্ষমতা গ্রহণ করেছিল। সেক্যুলারপন্থী রাজনীতিবিদেরা সম্ভবত আশা করেছিলেন, তাতে করে সংকটের সমাধান হবে, কেননা তাঁরা ইসলামপন্থীদের ওপরে আধিপত্য তৈরি করতে পারবেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এর আগে থেকে কিংবা তখন থেকে এখন পর্যন্ত সেনাবাহিনী এবং সাবেক মোবারক-অনুগতদের সঙ্গে সেক্যুলারপন্থীদের যে সমঝোতা ছিল তা এখন ভেঙে পড়েছে কি না। এর উত্তর এখনই নিশ্চিত করে বলা যাবে না, তবে এল বারাদির পদত্যাগ সে রকম ইঙ্গিত দেয় বৈকি।

ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী ও সেক্যুলারপন্থীদের মধ্যে ঐক্য গড়ে ওঠার বিষয়ে অনেক আগে থেকেই একধরনের আশঙ্কা ব্যক্ত করেছিলেন কোনো কোনো বিশ্লেষক। মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকাবিষয়ক বিশেষজ্ঞ মারিনা ওটোওয়ে ২০১১ সালের শেষ নাগাদ কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর পিসের এক প্রকাশনায় মন্তব্য করেছিলেন, আগামী কয়েক মাসের মধ্যে ইসলামপন্থী ও উদারপন্থীরা যদি একসঙ্গে কাজ করার একটা উপায় (মোডাস ভিভেন্ডি) বের করতে না পারে, তা হলে তার সম্ভাব্য পরিণতি র‌্যাডিক্যাল ইসলামপন্থীদের ক্ষমতা দখলের চেয়ে বেশি হলো সেনাবাহিনী ও (তাঁর ভাষায় তথাকথিত) লিবারেলদের মধ্যে একধরনের মোর্চা, যা জন্ম দেবে নতুন কর্তৃত্ববাদী শাসন। জুলাই মাসের গোড়ায় সেনাবাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে মিসর সেই পথেই এগোচ্ছিল কি না এবং এখন তা-ই প্রতিষ্ঠা লাভ করল কি না, সেটাই ভাবার বিষয়।

এ কথা বলার উদ্দেশ্য এই নয় যে বর্তমান পরিস্থিতির পুরো দায়ভার উদারপন্থী বা সেক্যুলারপন্থীদের ওপরেই বর্তায়। ক্ষমতাসীন ব্রাদারহুড নেতৃত্বের কার্যকলাপ ও দেশ শাসনে তাঁদের ব্যর্থতাই এই সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছিল। পাশাপাশি সেক্যুলারপন্থীরা যে এখনই মুরসিকে ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্য সেনাবাহিনীর দ্বারস্থ হলেন, সেটা কতটা বিবেচকের কাজ, সেটাও অনেকের কাছে প্রশ্নসাপেক্ষ। এর বাইরে আর কোনো বিকল্প তাঁদের হাতে ছিল কি না, সেটা এখনো অনেকের মনেই প্রশ্ন। নাকি ব্রাদারহুডের শাসনকে এখনই মোকাবিলা না করলে তাঁদের ভবিষ্যতে আর কোনোভাবেই মোকাবিলা করা যেত না, এমন উপসংহারেই পৌঁছেছিলেন দেশের সেক্যুলারপন্থীরা?

মিসরে ইসলামপন্থী ও সেক্যুলারপন্থীদের মধ্যকার সংঘাতের পরিণতি হিসেবে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণের ঘটনা, তাদের ক্ষমতাকে সংহত করার জন্য প্রশাসনকে সাজিয়ে নেওয়ার পদক্ষেপ এবং লিবারেলদের সঙ্গে মতপার্থক্যের ইঙ্গিতের কারণে এই পরিস্থিতিকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায়? সে ক্ষেত্রে ইতালীয় সমাজবিজ্ঞানী আন্তনিও গ্রামসির সাহায্য নেওয়া যেতে পারে।

গ্রামসি যখন ‘সিজারিজম’ বা সিজারতন্ত্রের কথা বলেছিলেন, তখন সম্ভবত এ ধরনের পরিস্থিতির দিকেই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন প্রগতিশীল ও পশ্চাদমুখী দুটি পক্ষের মধ্যে বিবাদে এটা হতে পারে যে এক পক্ষ অন্য পক্ষকে পরাস্ত করবে। এই বিবাদে পক্ষ ‘ক’ পক্ষ ‘খ’-কে পরাজিত করতে পারে; আবার তার বিপরীতও হতে পারে। কিন্তু এর বাইরেও একটা সম্ভাবনা থাকে যে কোনো পক্ষই কাউকে পরাস্ত করতে পারল না কিন্তু পরস্পরের এতটা রক্তক্ষরণ ঘটাল যে বাইরে থেকে এসে তৃতীয় পক্ষ উভয়কেই তার অধীনস্থ করল। মিসরে আমরা ‘সিজারতন্ত্র’ই দেখতে পাচ্ছি কি না সেটাও বিবেচ্য।

গ্রামসি বলেছেন যে সিজারিজম প্রগতিশীল হতে পারে, আবার প্রতিক্রিয়াশীলও হতে পারে; সেটা নির্ভর করে সুনির্দিষ্ট ঐতিহাসিক অবস্থার ওপরে। মিসরে যে সিজারতন্ত্রের উদ্ভব হয়েছে বলে আমার আশঙ্কা, তার চরিত্র কী হবে, সেটা আমরা অচিরেই দেখতে পাব। আর অন্যদিকে এই সেনা অভিযানের ফলে ইসলামপন্থীরা আরও শক্তিশালী হয়ে উঠল কি না, সেটাও বিবেচনায় নেওয়া দরকার। এ ধরনের অভিযানের পর সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়বে এবং সেই সুযোগে ব্রাদারহুড আরও কঠোর অবস্থান নেবে, না সমঝোতার পথকে শ্রেয় বলে বিবেচনা করবে, সেটাও দেখার বিষয়।

প্রকাশকালঃ আগস্ট ১৫, ২০১৩।