সেনাবাহিনীর ওপর ভর করছে তুর্কি সরকার?

তুরস্কে চলমান গণবিক্ষোভের মুখে দেশের ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আন্দোলন দমাতে প্রয়োজনে সেনাবাহিনী, এমনকি দরকার হলে বিমানবাহিনী ব্যবহার করা হবে। রাজনীতির প্রয়োজনে সেনাবাহিনীর ব্যবহারের এই বক্তব্য যাঁরা সামরিক বাহিনী নিয়ে পঠনপাঠন করেন এবং যাঁরা তুরস্কের ইতিহাসের সঙ্গে পরিচিত, উভয়েরই মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। তার কারণ কেবল এই নয় যে এই বক্তব্য তুরস্কের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের চলমান ঘটনার সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ, তার কারণ তুরস্কের নিজস্ব ইতিহাসও।

তুরস্কে গত চার দশকে সেনাবাহিনী চারটি সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিয়েছে, ১৯৬০ সালে নির্বাচিত একজন প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতা থেকেই কেবল উৎখাত করেনি, তাকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝোলানোর কাজেও দ্বিধান্বিত হয়নি সেনাবাহিনী। ১৯৬০-৬১, ১৯৭০-৭৩ ও ১৯৮০-৮৩ এই তিন দফায় সেনাবাহিনী রাজনীতি ও ক্ষমতা দুই-ই নিয়ন্ত্রণ করেছে। একার্থে ১৯৮৩ সালের নির্বাচন পর্যন্ত ক্ষমতা কার্যত সেনাবাহিনীর হাতেই ছিল এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের মাধ্যমে তা প্রয়োগ করা হতো। সমাজের বিভিন্ন দিক, যেমন: বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ এমনকি শিক্ষকদের চাকরি ও বদলি, বেসরকারি প্রশাসনকে রাজনীতিমুক্ত রাখা, রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা প্রভৃতি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিত জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ। ১৯৯৭ সালে সেনাবাহিনী প্রধানমন্ত্রী নেকমতিন এরবাকানকে পদত্যাগেই কেবল বাধ্য করেনি, ইসলামপন্থীদের ওপরে কড়া নিয়ন্ত্রণও আরোপ করেছিল। এসবই একসময় সেনাবাহিনীর অভাবনীয় শক্তির প্রমাণবাহী। দেশের সংবিধানের অভিভাবক বলে চিহ্নিত সেনাবাহিনীর যে সাংবিধানিক ক্ষমতা ছিল, তার অনেকটাই গত এক দশকে অবসিত হয়েছে; রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর প্রভাব ও শক্তি দুই-ই হ্রাস পেয়েছে। দেশের রাজনৈতিক অবস্থারও পরিবর্তন ঘটেছে।

সেনাবাহিনীর ক্ষমতা হ্রাসে গত কয়েক বছরে সবচেয়ে বেশি উৎসাহী ও সক্রিয় পদক্ষেপ নিয়েছে ক্ষমতাসীন দল একেপি বা জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি; এখন তার নেতারাই রাজনীতিতে সেনাবাহিনীকে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত করার কথা তুলেছেন। ২০০৩ সালে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান সেনাবাহিনী-নিয়ন্ত্রিত সিকিউরিটি কাউন্সিলের যে সমান্তরাল ক্ষমতাকেন্দ্র ছিল, তাকে কার্যত বিলোপ করেছেন। অভ্যুত্থানের অভিযোগে কয়েক ডজন জেনারেলকে আটক করেছেন এবং একজন সাবেক সেনাপ্রধান এখন কারাগারে দিন যাপন করছেন। তবে সেনাবাহিনীর এই ক্ষমতা হ্রাসে কেবল যে একেপির উদ্যোগ ছিল তা নয়, এতে সবচেয়ে বেশি কাজ করেছে তুরস্কের ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদানের আগ্রহ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেওয়া শর্তাবলি। ১৯৯৯ সালের ‘কোপেনহেগেন ক্রাইটেরিয়া’ বলে যে দলিল, তা-ও সেনাবাহিনীর ক্ষমতাকে হ্রাস করেছে। এই দলিলেই বলা হয়েছিল, নিরাপত্তা পরিষদ বেসামরিক ব্যক্তির নেতৃত্বাধীন হতে হবে এবং বছরে ছয়বারের বেশি বৈঠকে মিলিত হতে পারবে না। ফলে, দৈনন্দিন কার্যকলাপে সেনাবাহিনীর প্রভাব কমে যায়। তার সঙ্গে যুক্ত হয় এই ব্যবস্থা যে প্রতিরক্ষা বাহিনীর সব ব্যয় কোর্টস অব অ্যাকাউন্টসের নজরদারিতে থাকবে।

এ কথাও অনেকের জানা যে ইসলামপন্থী রাজনীতির কারণে এরদোয়ানকে কারাগারে কাটাতে হয়েছে এবং ২০০২ সালে সংবিধানের সংশোধনী না হলে তাঁর পক্ষে প্রধানমন্ত্রীও হওয়া সম্ভব হতো না। ব্যক্তি হিসেবে এরদোয়ান এবং দল হিসেবে একেপি ইসলামপন্থী অবস্থানে পরিবর্তন ঘটালেও গত এক দশকে সেনাবাহিনীর সঙ্গে টানাপোড়েন একেবারে শেষ হয়ে যায়নি। ২০০৭-০৮ সালে নারীদের মাথায় স্কার্ফ পরার সাংবিধানিক বিতর্কে একেপি ও এরদোয়ানের ভূমিকা কেবল যে সেক্যুলারপন্থী ও সেনাবাহিনীর অবস্থানের বিপরীতেই ছিল তা-ই নয়, এ বিষয়ে ইউরোপিয়ান মানবাধিকার আদালতের দেওয়া রায়ের ব্যাপারে তাঁর ভিন্নমতও উল্লেখযোগ্য। দেশের ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রশ্নেও ক্ষমতাসীন একেপি ও এরদোয়ানের সঙ্গে অনেকেরই মতবিরোধ রয়েছে এবং ২০১২ সালে দেশের যে শিক্ষা সংস্কার করা হয়, তার পেছনে ইসলামপন্থীদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যকেই প্রধান বলে মনে করে দেশের সেক্যুলারপন্থীরা। এই সংস্কার ১৯৯৭ সালে সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে করা ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটায় এবং ধর্মীয় শিক্ষা প্রসারের সুযোগ তৈরি করে। আবদুল্লাহ গুলকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় ২০০৭ সালে সেনাবাহিনী তাদের অপছন্দের কথা ব্যক্ত করতে দ্বিধা করেনি; অন্য পক্ষে এরদোয়ানের দল সেনাবাহিনীকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে গণতন্ত্রে সেনাবাহিনী রাজনীতির বাইরে থাকে।

গত এক দশকে সেনাবাহিনী রাজনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ায় এবং রাজনীতিতে প্রভাব হারিয়ে ফেলার ঘটনা দেশে গণতন্ত্রের জন্য ইতিবাচক বলেই মনে হওয়ার কথা। আপাতদৃষ্টে তুরস্কের ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে সেনাবাহিনীর প্রভাবমুক্ত রাজনৈতিক দলের শাসন নিঃসন্দেহে দেশের অধিকাংশেরই কাম্য, যে কারণে গত তিনটি নির্বাচনে তারা একেপিকে সমর্থন জুগিয়েছে। কিন্তু গত এক দশকে এরদোয়ানের শাসনামলে দেশের গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো আরও শক্তিশালী হওয়ার বদলে আরও বেশি ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে বলেই তুরস্কের অনেক মানুষ মনে করে। অনেকের ধারণা, একেপি তাদের ইসলামপন্থী রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে কেবল সেক্যুলার মতাদর্শের ধারক সেনাবাহিনীকেই কেবল দুর্বল করেনি, দেশের অন্য ভিন্নমতাবলম্বীদের মতপ্রকাশের অধিকারকেও সংকুচিত করেছে। এই মতের প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায় ১৭ জুন প্রকাশিত একটি জনমত জরিপে। এই জরিপের উত্তরদাতাদের ৫০ শতাংশ বলেছেন, তাঁরা মনে করেন যে এরদোয়ানের সরকার কর্তৃত্ববাদী; ৩৬ শতাংশ মনে করেন, তুরস্ক আরও বেশি গণতান্ত্রিক হয়েছে; ১৪ শতাংশ এ বিষয়ে কোনো মতামত দেননি। একই জরিপে দেখা যায়, ৫৪ শতাংশ মনে করেন, তাঁদের দৈনন্দিন জীবনে সরকারের প্রভাব বেড়েছে, ৫০ শতাংশের বেশি মনে করেন, দেশের গণমাধ্যম স্বাধীন নয়। এই জনমত জরিপের উত্তরদাতারা সবাই চলমান আন্দোলনের সমর্থক কিংবা জরিপ ত্রুটিপূর্ণ বলার অবকাশ থাকে না, যখন আমরা জানতে পারি, ৪৫ শতাংশ মনে করেন, বিক্ষোভকারী ব্যক্তিদের প্রতিক্রিয়া যথাযথ নয়, ৪৪ শতাংশ মনে করেন, আন্দোলনকারীরা ঠিকভাবেই তাদের প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। ইস্তাম্বুলের একটি পার্ককে কেন্দ্র করে এখনকার এই আন্দোলনের সূচনা হলেও এখন এটা স্পষ্ট যে পার্ক তুলে দেওয়ার ব্যাপারে সরকারি সিদ্ধান্ত বদলালেই এই আন্দোলনের শেষ হবে না।

এর পাশাপাশি গত কয়েক দিনের ঘটনায় এটাও স্পষ্ট, সরকারের পক্ষে যে সমর্থন নেই, তা নয়। এরদোয়ানের সাম্প্রতিক জনসভায় লক্ষাধিক মানুষের সমাবেশ প্রমাণ করে যে তাঁর পেছনেও জনসমর্থন রয়েছে। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তুরস্কে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে যে বিভাজন তৈরি হচ্ছিল, তা-ই প্রকাশিত হয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। একদিকে দেশের প্রধানত গ্রামাঞ্চলের মানুষ, যারা ইসলামপন্থীদের পক্ষে, যার প্রতিনিধি হলো একেপি এবং তার নেতা এরদোয়ান, অন্যদিকে প্রধানত নগরকেন্দ্রিক সেক্যুলারপন্থীরা, এই মুহূর্তে তাকসিম স্কয়ারের বিক্ষোভকারীরাই যার প্রতিনিধি। যেকোনো বিভাজনই যেমন একেবারে অঙ্ক মেপে হয় না, তুরস্কের এই বিভাজনও একেবারে সাদা-কালো বিভাজন নয়। এটাও অবশ্য বলা দরকার যে এই বিভাজনকে কেবল ইসলামপন্থীদের সঙ্গে সেক্যুলারপন্থীদের বললেও তার পুরো চরিত্রটা ধরা যায় না। কেননা, একই সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের বক্তব্যে এটা স্পষ্ট যে তারা সরকারের নিয়ন্ত্রণহীন ক্ষমতার বিরুদ্ধে। বোস্টন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও তুরস্কবিষয়ক গবেষক জেনি হোয়াইট বলছিলেন, কেবল নির্বাচনে ৫০ শতাংশের বেশি সমর্থনের কারণে কোনো সরকারই যে তার ইচ্ছামতো সবকিছু করার অধিকার লাভ করে না, এই বিক্ষোভ সে বিষয়টি সামনে নিয়ে এসেছে। কেননা, গত কয়েক বছরে তুরস্কের সরকারের আচরণ থেকে অনেকেই মনে করছে, ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা সেভাবেই আচরণ করে এসেছেন। আরও লক্ষণীয় যে এরদোয়ানের একসময়কার সমর্থকদের মধ্যেও তাঁর সমালোচনা ও প্রতিবাদ উঠতে শুরু করেছে। দেশের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ফতুল্লা গুলান- একসময়কার এরদোয়ান-সমর্থক- এখন স্বেচ্ছানির্বাসনে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী। তাঁর নেতৃত্বাধীন গুলাম আন্দোলন দেশের অন্যতম সিভিল সোসাইটি আন্দোলন এবং এরদোয়ানের উত্থানের পেছনে তাঁর অবদান অসামান্য। তিনি বলেছেন, একটি ভুল ঢাকতে গিয়ে আরও ৫০টি ত্রুটি করা হয়েছে, যা তৈরি করেছে আরও বেশি ক্ষোভ ও ঘৃণা।

গত কয়েক সপ্তাহের ঘটনায় এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়, এই ধূমায়িত ক্ষোভ এখন তাকসিম স্কয়ারের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। এই আন্দোলনের ফলে এরদোয়ান সরকারের পতন হবে বলে মনে করার মতো কারণ বা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে সরকার কেন সেনাবাহিনীকে রাজনীতিতে ভূমিকা রাখার জন্য উৎসাহী করছে, সেটাই বিবেচনার দাবি করে। আগামী বছর দেশের প্রথম সরাসরি প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। সংবিধানে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা বৃদ্ধির ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং আগামী নির্বাচনে এরদোয়ান একেপির প্রার্থী হবেন বলেই এত দিন ধারণা দেওয়া হয়েছে। এই আন্দোলনের ফলে সেই জনপ্রিয়তায় কতটা ক্ষতি হয় এবং তা শেষ পর্যন্ত ক্ষমতায় একেপির একচ্ছত্র আধিপত্যের অবসান ঘটানোর কাজে ভূমিকা রাখে কি না, সেটাই দেখার বিষয়। সে পর্যন্ত তুরস্কের এই আন্দোলন বিভিন্নভাবে তার উপস্থিতির জানান দেবে বলেই অনুমান করতে পারি।

প্রকাশকালঃ জুন ১৮, ২০১৩।