অন্ধ অরণ্যে আরও কিছু রোদন

রবীন্দ্রনাথের মতো চির-আশাবাদী মানুষও একবার আত্মহত্যার কথা ভেবেছিলেন। ওই সময় তাঁর ভয়ংকর মাথাব্যথার রোগ হয়েছিল, নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি-উত্তর বিষাদ ভর করেছিল তাঁকে। সবচেয়ে বড় কথা, আসন্ন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অশনিসংকেত তাঁকে অসহায় করে তুলেছিল। ১৯১৫ সালে পুত্র রথীন্দ্রনাথকে এক চিঠিতে লেখেন, ‘দিনরাত্রি মরবার কথা এবং মরবার ইচ্ছা আমাকে তাড়না করেছে। মনে হয়েছে আমার দ্বারা কিছুই হয়নি এবং হবে না, আমার জীবনটা যেন আগাগোড়া ব্যর্থ,…কাল সন্ধ্যার সময়ে ক্ষণকালের জন্য এই অন্ধকারের ভেতর দিয়ে একটা আলোর আবির্ভাব দেখতে পেয়েছি। আমার বিশ্বাস এইবার থেকে আমি এই ভয়ংকর মোহজাল থেকে নিষ্কৃতি লাভ করে আবার আমার প্রকৃতি ফিরে পাব। আমি ডেলিবারেটলি সুইসাইড করতেই বসেছিলুম, জীবনে আমার লেশমাত্র তৃপ্তি ছিল না। যা কিছু স্পর্শ করছিলুম সমস্ত যেন ছুড়ে ফেলছিলুম। এ রকম একেবারে উল্টো মানুষ যে কি রকম করে হতে পারে এ আমার একটা নতুন এক্সপেরিয়েন্স, সমস্তই একেবারে দুঃস্বপ্নের ঘন জাল। তোদের ভয় নেই, তোদের ভয় নেই, এ আমি ছিন্ন করব- ওষুধ আমার অন্তরেই আছে। মৃত্যুর যে গুহার দিকে নেবে যাচ্ছিলুম তার থেকে আবার আলোকে উঠে আসব কোনো সন্দেহ নেই।’

কারণ তিনি দেখেছিলেন, ‘সমস্ত ইউরোপ জুড়ে আজ এক মহাযুদ্ধের ঝড় উঠেছে। কত দিন ধরে গোপনে গোপনে এই ঝড়ের আয়োজন চলছিল। কোনো রাজমন্ত্রী কূট-কৌশলজাল বিস্তার করে যে সে আগুন নেভাতে পারবে তা নয়; মার খেতে হবে, মানুষকে মার খেতেই হবে।’ (মা মা হিংসী, ৫ আগস্ট ১৯১৪, ২০ শ্রাবণ ১৩২১)।

আজকের পৃথিবীর দিকে তাকালেও আশাবাদী হওয়ার মতো কিছু দেখি না। মানুষকে মার খেতেই হবে, মানুষকে মার খেতেই হবে।

আমরা দেখেছি, কীভাবে ‘তোর গণবিধ্বংসী অস্ত্র আছে’ বলে ইরাকের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল যুক্তরাষ্ট্র আর তার মিত্ররা। ইরাককে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা হলো। আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েতদের তাড়াতে তালেবানদের তৈরি করে সেই তালেবানদের হটাতে আবার আফগানিস্তানকে পোড়োভূমিতে পরিণত করা হলো। অরুন্ধতী রায় তাঁর সর্বশেষ উপন্যাসে তার বর্ণনা দিয়েছেন শ্লেষের ভাষায়, মশা যেমন করে ভনভন করে, তেমনিভাবে আফগানিস্তানের আকাশ ভরে গেল বোমারু বিমানের ভনভনানিতে। আরব বসন্তের নামে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হলো বহু আরব দেশ, বিশ্বমোড়লদের স্বার্থের সংঘাতে পড়ে কেবল মানুষ মরছে আর মানুষ মরছে। ভালোবাসার শহর নামে কলকাতার একটা ছবিতে পরিচালক ইন্দ্রনীল রায় চৌধুরী দেখিয়েছেন কীভাবে সিরিয়ার একটা হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী শহর হোমস একেবারে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হলো। বাংলাদেশের জয়া আহসানও অভিনয় করেছেন সেই ছবিতে। ওই ছবিতে সিরিয়ার ওই শহরের বোমাবিধ্বস্ত ভবনের প্রান্তরগুলো দেখলে বুকের ভেতরটা বিরান হয়ে যায়। আমাদের হৃদয় বিদীর্ণ হয়, মনে হয় শত শত গুলি ভেদ করে যাওয়া একটা শার্ট হয়ে গেছে আমাদের এই হৃদয়, আমাদের বোধ, আমাদের বিবেক।

এর নাম সভ্যতা! এর নাম তৃতীয় সহস্রাব্দ!

জাতিসংঘ নামের একটা প্রতিষ্ঠান না বানানো হয়েছিল পৃথিবীতে, যাতে আর কোনো দিন যুদ্ধ না হয়, শান্তি নেমে আসে, সে জন্য। এবার শান্তিতে নোবেল দেওয়া হয়েছে পারমাণবিক অস্ত্র নিরোধ আন্দোলনের সংস্থাকে। পারমাণবিক বোমায় লাখ মানুষের মৃত্যুর শঙ্কা আজও রয়ে গেছে। কিন্তু জাপানের দুই শহরে বোমায় নিযুত মানুষের মৃত্যুর পরে আরও কত লাখ লাখ মানুষ মারা গেল সভ্য মানুষদের চাপিয়ে দেওয়া বেখেয়ালি যুদ্ধে।

এই বিশ্বব্যবস্থা, এই জাতিসংঘ, এই মানবাধিকারের বুলি যে পরিহাস মাত্র, তার ঘটমান চলমান জ্বলন্ত উদাহরণ মিয়ানমারের জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপরে দিনের পর দিন পরিচালিত নৃশংসতা। নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতন চালিয়ে মারা হয়েছে মানুষ, নৃশংসভাবে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ঘরবাড়ি, ধর্ষণ করা হয়েছে নারীদের, ধর্ষণ করা হয়েছে শিশুদের, গর্ভবতী নারীদের, পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ফসলের খেত, ধনসম্পদ, গবাদিপশু, গাছপালা। তারও আগে, বছরের পর বছর, জাতিগত সংখ্যালঘু জনগণকে তাদের নিজ দেশে চলাচলের অধিকার দেওয়া হয়নি, শিক্ষার অধিকার দেওয়া হয়নি, টিকা, ওষুধ, চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে। লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে জোর করে ঠেলে দেওয়া হয়েছে প্রতিবেশী বাংলাদেশের সীমান্তের দিকে, আর তারা যাতে ফিরে যেতে না পারে সে জন্য পুঁতে রাখা হয়েছে স্থলমাইন। জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তরের নিজের প্রতিবেদনেই স্পষ্ট করে লেখা হয়েছে এই নৃশংসতার বিবরণ।

অথচ কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই। বিশ্ববিবেক বলতে যে একটা কথা ছিল, সেটা ঘুণে খেয়ে ফেলেছে। বড় শক্তিগুলোর নিজেদের স্বার্থই বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে। চীনের স্বার্থ আছে মিয়ানমারের সঙ্গে, রাশিয়ার আছে, ভারতের আছে, আমেরিকার আছে।

একজন নয়, দুজন নয়, লাখ লাখ রোহিঙ্গা দিশেহারা। মানবতার এত বড় অবমান, মানুষের এত কষ্ট। আহা, শিশু আর নারীরা অন্ধকার রাতে নৌকায় উঠে পড়ছে প্রাণটুকু রক্ষার আকুলতায়। নৌকা ডুবে গেছে, উঠে আসছে শিশুর লাশ। শিশু আয়লানের জন্য আমরা কাঁদি। ওমরানের জন্য আমরা কাঁদি। কিন্তু রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য কাঁদবারও কেউ নেই।

বাংলাদেশ যথেষ্ট মানবিকতা দেখিয়েছে। যখন রোহিঙ্গা নারী-শিশুরা নৌকায় করে আসত আমাদের সীমান্তে, আর আমাদের সীমান্তরক্ষীরা তাদের ফেরত পাঠিয়ে দিত, তখন একবার লিখেছিলাম, কবে আমরা এত নিষ্ঠুর হলাম যে প্রাণ বাঁচাতে আসা নারী-শিশুদের আমরা ফিরিয়ে দিই। এবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে অবস্থান নিয়েছেন, তা মানবিকতার দিক থেকে সঠিক, আবার রাজনৈতিকভাবেও যথাযথ। তাঁর বক্তব্যের মূল ছিল- ১. নিজেরা এক বেলা কম খেয়েও আশ্রয়প্রার্থীদের আমরা খাওয়াব। ২. ওরা মিয়ানমারের নাগরিক। মিয়ানমারকে ওদের ফিরিয়ে নিতে হবে। ৩. কোনো রকমের জঙ্গি তৎপরতা প্রশ্রয় দেওয়া হবে না।

কিন্তু মিয়ানমারে তো ঘটনা হঠাৎ করে ঘটে যায়নি। এটা পূর্বপরিকল্পিত। রোহিঙ্গাদের সবাইকে স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়াই মিয়ানমারের লক্ষ্য। তারা সবাইকেই পাঠিয়ে দিতে চাইবে, আর কোনো দিনও এদের ফেরত নিতে তো চাইবেই না, এরা যাতে ফিরে না যায়, সেই লক্ষ্যে কাজ করে যাবে। জাতিসংঘের প্রতিবেদনেও এই ব্যাপারটা স্পষ্ট। ফলে বাংলাদেশ যদি ওদের সাদরে স্বাগত জানায়, তাহলে মিয়ানমারের অসদুদ্দেশ্য কামিয়াব হওয়া সহজ হয়ে যায়।

আর বাংলাদেশই কীভাবেই-বা এত মানুষের ভার নেবে? আমাদের নাজুক পরিবেশ কীভাবে এত মানুষের চাপ সইবে? আর লাখ লাখ মানুষ পাহাড়ে বস্তিঘরে থাকবে, তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নাগরিক অধিকার, কাজ, ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা থাকবে না, চলাচলের স্বাধীনতা থাকবে না, সেটাও তো মানবিক নয়; সেটা তাই কোনো সমাধানও নয়। কাজেই মিয়ানমারকে বাধ্য করতে পারতে হবে মানবতার বিরুদ্ধে এই অপরাধ সংঘটন বন্ধ করতে। যে ভয়াবহ অপরাধ তারা করেছে, তাদের বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে, যেমন করে বসনিয়া-হার্জেগোভিনা বনাম সার্বিয়া মন্টেনেগ্রো মামলার ক্ষেত্রে করা হয়েছিল। রোহিঙ্গারা তাদের আপন দেশে পূর্ণ মর্যাদা আর নিরাপত্তা নিয়ে ফিরে যাবে। করতে হবে বটে, কিন্তু করবেটা কে?

দেশত্যাগী আশ্রয়সন্ধানী রোহিঙ্গাদের জন্য সাহায্য পাঠিয়ে বিবেকের দাগ মুছে ফেলার মতো দেশ হয়তো কিছু পাওয়া যাবে। কিন্তু লাখ লাখ রোহিঙ্গার মানবাধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেবে কে? যে রোহিঙ্গারা কেবল তাদের এথনিক পরিচয়ের জন্য দশকের পর দশক মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত রইল; শিক্ষা, চিকিৎসা, কাজ পেল না; নৃশংস অমানবিক শারীরিক নির্যাতনের মধ্য দিয়ে মৃত্যুর শিকার হলো, ধর্ষিত হলো, উদ্বাস্তু হলো; তাদের প্রতি সংঘটিত অন্যায়ের বিচার করবেটা কে? অন্যায়কারীকে নিবৃত্ত কে করবে? অন্যায়কারীকে শাস্তি কে দেবে?

আমি কল্পনা করার চেষ্টা করি: আমি একটা রোহিঙ্গা শিশু। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে আমার একটা ঘর ছিল, বাড়ি ছিল, খেত ছিল, জীবন ছিল। আমরা ওই এলাকার বাইরে যেতে পারতাম না। স্কুলে যেতাম না, হাসপাতাল চিনতাম না। টিকা পাইনি। তবু আমার বাবা ছিলেন, মা ছিলেন, ভাইবোন ছিল। আর ছিল ভয়। সেই ভয়ংকরেরা এল একদিন। এল রোহিঙ্গা মিলিটারি, এল সশস্ত্র আরও কিছু মানুষ, আমার বাবাকে হত্যা করল, মাকে ধর্ষণ করল, আর আমরা প্রাণভয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে একটা নৌকা জোগাড় করে ভাসতে শুরু করলাম অজানার উদ্দেশে। আমার কী অপরাধ? আমার জন্ম আমি বেছে নিইনি। আমি যে রোহিঙ্গা শিশু, এটা তো আমি বেছে নিইনি। এই সংকট সমাধানের কোনো আশু আশা নেই, কেউ মিয়ানমারকে বাধ্য করতে চেষ্টা করবে না, মিয়ানমার আমাকে কোনো দিনও আমার জন্মভূমিতে স্বাগত জানাবে না, বাংলাদেশও কোনো দিন আমাকে বাংলাদেশে মিশে যেতে দেবে না।

এইভাবে যখন ভাবি, তখন হতাশা এসে চেপে ধরে। শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। মানবতা, মানবাধিকার, সভ্যতা, জাতিসংঘ, গণতন্ত্র- এই ধরনের শব্দগুলোকে হাস্যকর বলে মনে হয়। মনে হয়, ওরে আশা নাই, আশা শুধু মিছে ছলনা।

কিন্তু হতাশায় হতবুদ্ধি হয়ে বসে থাকলে চলবে না। আশার কথা হলো, বাংলাদেশের তরুণেরাও যে যাঁর মতো করে রোহিঙ্গা মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছেন। অনেক প্রবাসীকে দেখছি, তাঁরা দিনরাত পরিশ্রম করছেন তহবিল সংগ্রহের জন্য, বিশ্ববিবেক জাগ্রত করার জন্য।

জানি না বিশ্ববিবেক বলে আসলে কিছু আছে কি না। যদি থেকে থাকে, প্রিয় ভাই ও বোনেরা, তাহলে আসুন, যে যার মতো করে সেই বিশ্ববিবেকের দরজায় কড়া নাড়ি। যে যার অবস্থানে থেকে এবং যতটা পারি, বিশ্ববাসীকে সঙ্গে নিয়ে। আজকে বোধ হয় কনসার্ট টু স্টপ জেনোসাইড ইন মিয়ানমার আয়োজনের সময় এসেছে। জাতিসংঘের সদর দপ্তর কিংবা জাতিসংঘ মানবাধিকার দপ্তর অভিমুখে বিশাল শোভাযাত্রা নিয়ে যাওয়ার সময় এসেছে।

প্রকাশকাল: ১৩ অক্টোবর ২০১৭