বিদ্রোহের নতুন পরিচয়: ‘আমরা ৯৯%’

‘আমরা ৯৯%’ এই পরিচয় নিয়ে এবং দখল করার ডাক দিয়ে নারী-পুরুষ, শিক্ষার্থী-শিক্ষক, শ্রমিক, লেখক-শিল্পী, বেকার, দরিদ্র, নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত এবং সংবেদনশীল নিপীড়ন-বৈষম্য অন্যায়বিরোধী মানুষের বিক্ষোভ ক্রমেই দেশ থেকে দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। সমাবেশে উপস্থিতি শত ছাড়িয়ে হাজার, হাজার ছাড়িয়ে লাখ অতিক্রম করছে। ইতিমধ্যে বিশ্বের প্রায় এক হাজার শহরে এই বিক্ষোভ-সমাবেশ সম্প্রসারিত হয়েছে। কোথাও কোথাও পুলিশ বাধা দেওয়ায় তার সঙ্গে সংঘাত তৈরি হয়েছে। রক্তাক্ত হয়েছে নিরস্ত্র বিক্ষুব্ধ মানুষ। কয়েক দিন আগে বিক্ষোভকারীরা একটি ছোট্ট ভিডিওতে প্রকাশ করেছে, ওবামা ও হিলারি যখন সিরিয়া, লিবিয়া বা মিসরকে উপদেশ দিচ্ছেন মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষায় দমন-পীড়ন বন্ধ করতে, যখন তরুণ প্রজন্মকে নতুন ইতিহাস নির্মাণে অভিনন্দন জানাচ্ছেন, তখন তাদেরই পুলিশ যুক্তরাষ্ট্রের শহরে শহরে নিরস্ত্র বিদ্রোহী তরুণদের ওপর বর্বর হামলা পরিচালনা করছে। তরুণ বিক্ষোভকারীরা প্রত্যয়ী, তাদের সংখ্যা ও দৃঢ়তা বাড়ছেই।

কারা এই বিক্ষোভের লক্ষ্য? কারা এর প্রতিপক্ষ? আর কারা এই আন্দোলনের পক্ষে? এই আন্দোলনের গতিমুখ কোন দিকে? কেন এই দুটি স্লোগানের সঙ্গে সবাই নিজের আকাঙ্ক্ষা মেলাতে পারছে? ‘আমরা ৯৯%’ স্লোগানের মধ্য দিয়ে সর্বত্র শতকরা ৯৯ ভাগ মানুষের জীবন ও স্বার্থের ঐক্য-সংহতি প্রকাশ করা হয়েছে। এটি আরও স্পষ্ট হয় যখন বিক্ষোভকারীরা বলে, ‘শতকরা ১ ভাগ আমাদের সম্পদ দখল করে রেখেছে।’ মাইকেল প্যারেন্টি বলছেন, ‘এটি সরাসরি শ্রেণীযুদ্ধের আওয়াজ।’ সেই এক ভাগের খুব গুরুত্বপূর্ণ অংশ একচেটিয়া পুঁজির প্রতিনিধি বৃহৎ বহুজাতিক সংস্থা, ব্যাংক, বিমা এবং নানা অর্থকরী প্রতিষ্ঠানের স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কিত। তাদেরই কেন্দ্র নিউইয়র্কের বাণিজ্যিক এলাকা ওয়াল স্ট্রিট। এক পোস্টারে এর নাম দেওয়া হয়েছে, ওয়ার স্ট্রিট। কেননা, এদের স্বার্থেই যুক্তরাষ্ট্র দেশের পর দেশ দখল ও সন্ত্রাসে তার সর্বশক্তি নিয়োজিত রেখেছে গত ছয় দশক। আরেক পোস্টারে লেখা, ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট, নট আফগানিস্তান’।

এক পোস্টারে বলা আছে ‘ওয়াল স্টিট গ্রিড=হাংরি কিডস’। ১%-এর লোভের জন্যই সারা বিশ্বে অনাহার, দারিদ্র্য, অকালমৃত্যু- যাদের বড় অংশ শিশু। সারা বিশ্বের সর্বজনের সম্পদ উন্নয়নের নামে গ্রাস করেছে কতিপয় গোষ্ঠী কিংবা করপোরেশন। তাদের মুনাফার লোভ মেটাতে গিয়ে অনিশ্চয়তা, সন্ত্রাস, অপমানে জর্জরিত শতকরা ৯৯ ভাগ মানুষ।

যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ কেন অনাহারে এবং চিকিৎসার অভাবে বিপর্যস্ত হবে? কেন আশ্রয়হীন থাকবে? এটা অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হওয়ার কথা। কেননা, বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর, নিজ দেশ শুধু নয় সারা বিশ্বের বিশাল সম্পদ কতিপয় মার্কিন গোষ্ঠী আর তাদের শাগরেদদের দখলে। একটি ছোট ঘোষণা ভিডিওতে প্রথম কর্মসূচি ঘোষণা করা হয় ১৪ জুন। বলা হয় ‘ডেমোক্র্যাটরা ব্যর্থ, রিপাবলিকানরা ব্যর্থ। এখন আমাদের স্বার্থ আমাদেরই দেখতে হবে, তোমার স্বার্থ তোমাকেই দেখতে হবে।’ আরও বলা হচ্ছে, ‘যারা পরিকল্পিতভাবে আমাদের সম্পদ লুট করে নিজেদের সম্পদের পাহাড় গড়েছে তাদের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে।’ আমরা ৯৯% কর্মসূচির নাম দেওয়া হয়েছে, ‘অপারেশন এম্পায়ার স্টেট’।

যুক্তরাষ্ট্রের কেন এই হাল? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার কেন্দ্র ইউরোপ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে সরে যায়। তার পর থেকে আধিপত্য বিস্তার এবং তেল কোম্পানি, অস্ত্র কোম্পানিসহ বৃহৎ ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে বিশ্বজুড়ে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ, সহিংসতা, সামরিক শাসন, গণহত্যা বিস্তৃত করেছে। নোয়াম চমস্কি, জোসেফ স্টিগলিজ, নাওমি ক্লেইন, উইলিয়াম ব্লুমসহ অনেকেই তথ্য-উপাত্ত দলিল দিয়ে দেখিয়েছেন কীভাবে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের নামে যুক্তরাষ্ট্র হয়ে উঠেছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী শক্তি। কোনো দেশ পারমাণবিক গবেষণা করলে যুক্তরাষ্ট্র তার বিরুদ্ধে নানা প্রতিরোধ তৈরি করে কিন্তু নিজের পারমাণবিক স্থাপনা রক্ষণাবেক্ষণের জন্যই তাকে প্রতিবছর খরচ করতে হয় বিশাল অর্থ।

এক হিসাবে দেখা গেছে, শুধু এই কাজে যুক্তরাষ্ট্রের যে অর্থ ব্যয় হয় তা যদি এক ডলারের নোট দিয়ে দড়ি বানানো হয় তাহলে তার দৈর্ঘ্য এমন হবে যে, সেই দড়ি দিয়ে চাঁদে গিয়ে ফেরত আসা যাবে। যখন যুক্তরাষ্ট্রে কখনো না কখনো অনাহারে থাকেন এমন মানুষের সংখ্যা সাড়ে ৪ কোটি, বেকার শতকরা প্রায় ১৩ ভাগ, যখন শিক্ষা-চিকিৎসার অর্থ পাওয়া যাচ্ছে না, তখন যুদ্ধ, গোয়েন্দাগিরি, চক্রান্ত ইত্যাদি কাজে এই একই রাষ্ট্রের বার্ষিক খরচ এক হাজার বিলিয়ন ডলার বা এক ট্রিলিয়ন ডলার। অনাহারী মানুষের খাদ্য জোগানের খরচ মাত্র ১০ বিলিয়ন ডলার!

কৃত্রিম জৌলুশ, বিশ্বব্যাপী দখল সন্ত্রাস ও একচেটিয়া পুঁজিকে সম্পদ জোগাতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এখন সবচেয়ে ঋণগ্রস্ত দেশ। বার্ষিক জাতীয় আয়ের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে তার ঋণ। রাষ্ট্র, পরিবার এবং ব্যক্তি- সবই এখন ঋণে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। রাষ্ট্রীয় ঋণের সীমা যখন অতিক্রম করতে যাচ্ছে, তখন গত মাসে, কংগ্রেসে ঋণসীমা বৃদ্ধির অনুমতি নিয়েছে ওবামা সরকার। গৃহঋণ ধস থেকে পরিষ্কার হয়েছে যে পরিবারের পর্যায়ে আয়ের তুলনায় ঋণ এত বেশি যে তা শোধ করার সীমা তারা পার হয়ে গেছে অনেক আগেই। এই জায়গায় এসে ফুলে ফেঁপে ওঠা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও ধসে পড়ে। আবার বেইলআউটের নামে জনগণের করের টাকায় ট্রিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করা হয় তাদের উদ্ধারের জন্য। যাদের জন্য মানুষ ও অর্থনীতির দৈন্য তাদের শাস্তি না দিয়ে, হাতে আরও টাকা তুলে দেওয়া হয় ‘চুইয়ে পড়া তত্ত্ব’ অনুযায়ী; যে তত্ত্ব বলে ধনীদের হাতে যত টাকা যাবে তত তারা বিনিয়োগ করবে, তত কর্মসংস্থান বাড়বে। বাড়েনি, বেকারত্ব বেড়েছে। কারণ, সম্পদ কেন্দ্রীভূত যাদের হাতে, অধিক মুনাফার জন্য তারা এমন বিনিয়োগে আগ্রহী যাতে উৎপাদনশীল তৎপরতা বরং ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কাজ আয় এমনকি খাদ্য যখন অনিশ্চিত তখন বড় বড় করপোরেশনের, যাদের জালিয়াতির জন্য অর্থনীতির ধস, কর্মকর্তারা বেইলআউটের টাকায় আয় করেছে কোটি ডলার বোনাস, বেতন।

এই ছবি শুধু যুক্তরাষ্ট্রের নয়, সারা বিশ্বের অধিকাংশ দেশের। যুক্তরাষ্ট্র যাদের সম্পদ দিয়ে একটা কৃত্রিম সচ্ছলতার ঘোর তৈরি করে মার্কিনদের বহুদিন বুঁদ করে রাখতে পেরেছিল, সেই সব প্রান্তস্থ দেশে লড়াই বহুভাবে বহুদিন ধরেই চলছে। সেই লড়াই দমনে বুদ্ধিবৃত্তিক ও সামরিক জোগানদার ছিল যুক্তরাষ্ট্রই। এখন কেন্দ্র প্রত্যক্ষ করছে বিদ্রোহ। এখন শোষণ-নিপীড়নের বিশ্বায়নের মোকাবিলা করতে জোরদার হচ্ছে প্রতিরোধের বিশ্বায়নের ঐতিহাসিক পর্ব।

আন্দোলনের সক্রিয় অংশীদার আমেরিকান ওয়ার্কার্স কোঅপারেটিভের প্রেসিডেন্ট বন্ধু ডিজার হর্ন ১৮ অক্টোবর ই-মেইলে সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে আমাকে জানিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘১০ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রে কেউ পুঁজিবাদ শব্দটি উচ্চারণ করলেই তাঁকে কমিউনিস্ট গালি খেতে হতো। এখন পুঁজিবাদের ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে সর্বত্র। যেসব জায়গায় বিক্ষোভকারীরা অবস্থান নিয়েছে, সেখানেই শিক্ষার নতুন পর্ব বিকশিত হচ্ছে। শিকাগোতে হচ্ছে বহু পাঠচক্র, লিখিত হচ্ছে নাটক, গান। দেখা গেল শ পাঁচেক তরুণ বসে কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো নিয়ে আলোচনা করছেন। নিউইয়র্কে জুকত্তি পার্কে নিপীড়িতের থিয়েটার, অর্থশাস্ত্র, নতুন অর্থনীতি, দর্শন নিয়ে একের পর এক বৈঠক হচ্ছে। যৌথ জীবন, সামষ্টিক স্বার্থ, ভবিষ্যতের নতুন মানবিক জীবন নিয়ে আলোচনা চর্চা লড়াইকে ভাষা দিচ্ছে, সামনে তাকানোর শক্তি জোগাচ্ছে। এটা ঠিক যে একক কোনো নেতৃত্ব নেই এই আন্দোলনে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের শহরগুলোতে দীর্ঘদিন যেসব ইউনিয়ন বা সংগঠন গড়ে উঠেছে, তারাই মুখ্য ভূমিকা পালন করছে প্রচার ও যোগাযোগে। এত দিন ভিন্ন ভিন্ন ভাবে কাজ হতো এখন তৈরি হচ্ছে একক লক্ষ্য ও ঐক্যসূত্র। আগামী বছরে শিকাগোতে যে জি-৮ সম্মেলন হতে যাচ্ছে, সেটা নিশ্চিতভাবেই এক বড় লড়াইয়ের ক্ষেত্র হবে।’

তিনি আরও বলছেন, ‘এই আন্দোলনের সবচেয়ে বড় সাফল্য হলো, যাঁরা আন্দোলনের কর্মী নন, যাঁরা সংগঠক নন, যাঁরা বামপন্থী নন, এটি তাঁদের হূদয়কেও টান দিয়েছে।…আমাদের সংখ্যা বিস্তৃত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ এখন বিশ্বের মানুুষকে জানাচ্ছে যে তারা আর ঘুমিয়ে নেই। আমরা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মুক্তির লড়াইয়ের সঙ্গে সংহতি নিয়ে উঠে দাঁড়াচ্ছি।’

‘আমরা ৯৯%’ এখন সারা বিশ্বের নতুন লড়াইয়ের স্লোগান হতে চলেছে। দখল বলে যে স্লোগান তা আসলে শতকরা ১ ভাগের হাত থেকে দেশ ও ক্ষমতার কেন্দ্র দখলমুক্ত করা। একটি অভিন্ন প্রতিপক্ষ, অভিন্ন বৈশ্বিক লক্ষ্য। আমাদের জন্য এই লড়াই নতুন নয়, দেশ ও সম্পদের ওপর জনগণের শতভাগ মালিকানা ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লড়াই তো বাংলাদেশের মানুষ করছেই। এই দুই স্লোগান সারা বিশ্বের, আমাদের।

প্রথম আলো, অক্টোবর ২০, ২০১১।