প্রতিবিম্ব

কীটসের ডাক এসেছিলে ছাব্বিশে;
মূর্ত কবিতা শেলি
স্পেৎসিয়া উপসাগরের ঢেউয়ে মিশে
করলে যেদিন কেলি,
সেদিন কি আর বায়রন তাঁর
উন্মন নিশ্বাসে
ভেবেছিলেন-যে তাঁকেও অচিরে
নেবে দৈবের অধৈর্য ছিঁড়ে
বন্ধুর পাশে, ঘাসে।

শেলি, বায়রন, কীটসের দিকে
তাকায়ে আত্মহারা,
আমিও ভেবেছি দশটি-বারোটি
অমর কবিতা লিখে
যেন যেতে পারি মর্ত্য জীবন
চব্বিশে ক’রে সারা।

কিন্তু তখন, বলা বাহুল্য,
বয়স সতেরো ছিলো;
তাই মনে হ’তো, যদি দেহপুরী
মৃত্যুর হাতে আজও যায় চুরি,
তবু জীবনের বিজয়ী মাধুরী
কমবে না এক তিলও।
মনে হ’তো যেন নিছক বাঁচায়
আছে তার সান্ত্বনা,
যে-উন্মত্ত স্বপ্ন আমার
রক্তের রস, বক্ষের হাড়,
হৃৎপিণ্ডের উদ্দামতায়
হৃদয়ের ব্যঞ্জনা।


যেখানে কখনো আসেননি বায়রন
পোঁচেছি আজ প্রাক্-চল্লিশে এসে,
প্রতিবিম্বের সন্ধানে তাই মন
এগোয় না আর শেলির সোনালি দেশে।
আজ বার-বার মনে পড়ে বার-বার
সেই সত্তর সিঁড়ি
আঁকাবাঁকা খাড়া ধাপে-ধাপে উঠে যার
ইটস পেলেন দেখা
শিখরচূড়ার স্বেচ্ছাচারিতার,
মত্ত, মহান, একা।

আর বার-বার মনে আসে বার-বার
সে-আকুল আশি বছরের কারুকলা,
মায়াবী আঙুল যার
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মুখে
অতীন্দ্রিয়ের ইন্দ্রধনুকে
করেছে এমন মধুর, ভীষণ
রূপের আলোকে স্নাত;
যে দেখেছে সে-ই ভেবেছে, স্বর্গ
তবে কি নিঃস্ব দেহেরই অর্ঘ্য,
এ কি মুমূর্ষু মানুষ, অথবা
দেবতা সদ্যোজাত।


যদিও দেহের শুকায়ে আসছে মজ্জা;
বিদ্রূপে ধিক্কারে
দিনে-দিনে আরো আমাকেই দেবে লজ্জা;
তবু দিনে-দিনে মনে-মনে আরো ভাবি:
দৈব দয়ায় কিছু যদি থাকে দাবি,
তবে যেন আমি বাঁচি
একশো বছর, অন্তত কাছাকাছি;
দিনে-দিনে যাতে আরো হ’তে পারি
সান্ত্বনাহীন স্বপ্ন আমারই,
হৃৎপিণ্ডের হৃদয়পদ্মে
চিরন্তনের শয্যা।

যা হবার তা-যে হবেই, আমার
ধৈর্যেরে এই কথা
শিখায়ে-শিখায়ে মেনে নেবে
মন তাপহারা দেহে স্মৃতিমন্থন,
সেবক শোণিতকণার কঠিন
বধির অবাধ্যতা।
বুক-ফাটা বোবা সর্বনাশেরে
হাসি-ঠাট্টার ছলে
ছড়ায়ে উড়ায়ে দেবে অজস্র
বাজে কথা ব’লে-ব’লে।
কেননা যখন আমার অধর আর
অন্য অধরে আনবে না ইচ্ছার
মূর্ছিত সজলতা;
পারবে না আর তন্ময় বিন্যাসে
নারীর শরীরে বাঁধতে রুদ্ধশ্বাসে
যখন ক্ষয়িত বাহুর নিষ্ফলতা:
হয়তো তখনই আমি
জাগতে পারবো মুক্ত মহান রঙ্গে
উদ্দাম রাত সখা-কৃষ্ণের সঙ্গে;
তারপর তোরবেলা
দেখবো, অবোধ উর্বশী তার
করুণ চিকণ বঙ্গোচূড়ার
চিত্ৰবিলাসী স্বচ্ছ সলিলে
একলা করছে খেলা।