কফিন, দোলনচাঁপা এবং কোকিল

হঠাৎ একদিন বারবেলায় এক প্রেস রিলিজ আত্মপ্রকাশ করলো। নগরবাসীদের
জন্যে এটা ছিল সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। অনেকই ব্যাপারটিকে অলক্ষুণে বলে
ঠাউরে নিলো, যদিও মুখ ফুটে কেউ কিছু বললো না। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হলো
একটি কফিনের কথা। সেই কফিন নাকি প্রায়শই নজরে পড়ছে লোকজনের।
কখনো চৌরাস্তায়, কখনো পার্কে, কখনো বা এঁদো গলির মুখে দেখা যায়
কফিনটাকে। প্রকাশ, এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের অভিমত চাওয়া হয়েছে এবং
ইতোমধ্যেই একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। রুদ্ধ কক্ষে তদন্ত
কমিটির কাজ শুরু হয়ে গেছে বলে প্রেস রিলিজে জানানো হয়। জনসাধারণ
যাতে ভয় না পান, সে-জন্যে আকুল আবেদন জানানো হয়েছে তাদের প্রতি।
তাছাড়া, তদন্ত কমিটির রিপোর্ট প্রকাশিত হোক আর না-ই হোক,
ব্যাপারটিকে দৃষ্টিভ্রম হিশেবে ধরে নেয়াই ভালো। প্যানিক ছড়ানে সম্পূর্ণ
নিষিদ্ধ।

টেবিলে রাখা খবরের কাগজ ক্রমাগত চোখ মারছে আমাকে। আমার
নিঃসঙ্গতার সঙ্গে এই ফিচলেমি একেবারেই ভালো লাগছে না। অনেকগুলো
কবিতার বই দিয়ে খবরের কাগজটিকে চাপা দিলাম। অনিদ্রার সঙ্গে
বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হবার দরুন আমি ইদানীং খুব দেরী করে বিছানায় যাই।
চোখের পাতায় ঘুমের পা পড়তে পড়তে পূবের আকাশে লাগে আবীরের
হালকা ছোপ। তাই মধ্যরাতেও আমি বসেছিলাম চেয়ারে। আমার হাতে
ছিলো প্রাচীন সভ্যতাবিষয়ক একটি বই; উদ্দীপক এবং আধপড়া। প্রাচীন
মিশরের এক স্তোত্রের ওপর চোখ পড়তেই কিসের শব্দ শুনতে পেলাম।
শব্দটি, মনে হলো, বারান্দা থেকে এসেছে। বারান্দার দিকে পা বাড়াতেই
আমার অস্তিত্বে যেন কেউ বরফের পানি ঢেলে দিলো, এপ্রিলের দারুণ গরমেও
আমি হি হি কাঁপতে শুরু করলাম।

বাক-রহিত আমি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম শিলীভূত মূর্তির মতো। প্রেস
রিলিজ কথিত কফিনটা বারান্দায় শুয়ে আছে মমির ধরনে। সেই মুহূর্তে
রশোমন ছবির গভীর অরণ্যে ছুটন্ত কাঠুরের রৌদ্রেঝলসিত কুড়ালের মতো
একটি কুড়ালের প্রার্থনায় হাটু গেড়ে বসলাম। আমার শোণিতে চেঁচিয়ে উঠলো
এক ঝাঁক কাকাতুয়া। এক কোপে কফিনের ডালা খুলে ফেলবার এক দুর্মর
বাসনা আমাকে দখল করলো। কফিনটার গায়ে খোঁড়া তৈমুরের কালের মাটি
লেগে রয়েছে। আমি কফিনের দিকে এগিয়ে যাবো কি যাবো না ভাবছি, এমন
সময় সেটা নড়ে চড়ে উঠলো আর তার ভেতর থেকে বেরিয়ে এল এক
নরকংকাল। কংকালের গায়ে কোনো পোশাক কিংবা উর্দি নেই, নেই বেল্ট
অথবা নক্ষত্রের মতো কোনো পদক, শুধু তার হাতে ঝুলছে নাঙা তলোয়ার।
ব্লিচিং পাউডারের মতো শাদা কংকালের হাতে কারুকাজময় তরবারি অন্ধকারে
ঝলসে ওঠে ঘন ঘন, এক ফোঁটা মর্চে ধরেনি তাতে। আমার দিকে তরবারি
উঁচিয়ে এগিয়ে এল সে আস্তেসুস্থে। মনে হলো, ওর কোনো তাড়া নেই। কিন্তু
আমাকে আঘাত না ক’রে সে প্রবেশ করলো আমার ঘরে, ভরিয়ে তুললো
কাঠের চেয়ারের শূন্যতা। একটু যেন অস্বস্তি-পীড়িত মনে হলো তাকে,
অতিশয় মূল্যবান আসনের স্মৃতি হয়তো ঝিকিয়ে ওঠে করোটির ভেতর।
নরকংকাল ঘেসো কণ্ঠে বললো, “তাজিম শেখোনি তুমি। কেন কুর্নিশ করছো
না আমাকে? জানো, এক্ষুনি তোমার গর্দান নিতে পারি?” কঠোর ধমকের
পরেও আমার শরীর আনত হলো না এতটুকু, আমি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে
রইলাম তরুণ মোরগের মতো। কখন যে এক অসীম সাহসিকতা আমাকে
দত্তক নিয়েছে জানতেই পারি নি। অনধিকার প্রবেশের অপরাধে অভিযুক্ত করে
আমি ওকে সংযত হতে বললাম। কিন্তু সংযম ওর ধাতে নেই। বুঝতে
পারলাম, নিজের কণ্ঠস্বর ওর খুবই প্রিয়। পাথরের নুড়ির মতো কথা ক্রমাগত
ঝরতে থাকলো ওর দন্তহীন মুখ-গহ্‌বর থেকে।

“এই যে একটা কফিন অতর্কিতে হাজির হয়েছে তোমাদের শহরে, এর কি
কোনো অর্থ নেই ভাবছো? এই যে আমি তলোয়ার হাতে আবির্ভূত হয়েছি
মধ্যরাতে একি তাৎপর্যহীন মনে করো? এই অসির আঘাতে কংকালে পরিণত
হবে অসংখ্য নরনারী। আমার তলোয়ার খেলা চলবে অহর্নিশ প্রকাশ্যে, কিন্তু
কেউ টের পাবে না। আমি যে-পথ দিয়ে হেঁটে যাবো, সে-পথে জেগে উঠবে
শ্মশানের পোড়া গন্ধ, সারা শহর বিবমিশায় আক্রান্ত হবে লাশকাটা ঘরের
উৎকট গন্ধে। সকল সাহিত্য ও শিল্পকলা ভবন হয়ে শৌচাগার। শ্রাবণের
মেঘের মতো পঙ্গপাল নেমে আসবে তোমাদের প্রত্যেকটি ফসলের ক্ষেতে।
তোমাদের জলাশয়গুলো শুকিয়ে বিষবাষ্প ছড়াবে দশদিকে। শস্যের
গুদামসমূহ উজাড় হয়ে যাবে চোখের পলকে। লক্ষ লক্ষ শিশু ক্ষুধায় কেঁদে
উঠতে চাইবে, কিন্তু আমি ওদের কাঁদতে পর্যন্ত দেবো না। সকল হাসি, কান্না,
শোকপালন, প্রেমিক-প্রেমিকার আলিঙ্গন, কোবিদের চিন্তা, কবির উচ্চারণ-
সবকিছু নিষিদ্ধ করে দেবো।

নরকংকালের ঘেসো কণ্ঠের শব্দস্রোত আমাকে রূপকথার পাথুরে মূর্তিতে
রূপান্তরিত করলো। আমার মুখ থেকে একটি কথাও নিঃসৃত হলো না, শুধু
নিষ্পলক তাকিয়ে থাকলাম ওর দিকে। এই কংকাল দুর্বাসাকে কনুইয়ের গুঁতো
দিয়ে চলে যেতে পারে যোজন যোজন দূরে। দেখলাম, নরকংকাল কাঠের
চেয়ার ছেড়ে তরবারি দোলাতে দোলাতে আবার শুয়ে পড়লো কফিনের
ভেতর, বন্ধ হয়ে গেল ডালা। তারপর কফিন ভেসে চললো মেঘে মেঘে।
সারারাত ঘুম হলো না এক ফোঁটা। চোখে একরাশ মরিচের গুঁড়ো। বেলা
বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই রাতের অতিথির খবর জানানোর জন্যে রওয়ানা হলাম
সর্বাধিক প্রচারিত সংবাদপত্রের দপ্তরের দিকে। এক ধরনের আশংকা ও
উদ্দীপনা আমাকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। যেন এক বেনামি সংকটের ছায়া ঘিরে
ধরেছে রাজধানীকে এবং এক্ষুনি চোখে পড়লো একটা কফিন, যার গায়ে
লেগে রয়েছে খোঁড়া তৈমুরের কালের মাটি। কফিনটাকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে
একগুচ্ছ দোলনচাঁপা আর এক ঝাঁক কোকিল। কোকিলের ডাকে ঝংকৃত হচ্ছে
রাজধানীর আকাশ। দোলনচাঁপার ঘ্রাণ মাদকতা ছড়ালো হাওয়ায় হাওয়ায়।

আমার আর খবরের কাগজের অফিসে যাওয়া হলো না।