আলী হায়দর

পাহাড়ে পাহাড়ে তার গর্জন, জাগে মরুপ্রান্তর।
আলী হায়দর! আলী হায়দর! আসে আলী হায়দর!

মরু-আফতাব উড়ে চলে তার ঘোড়ার খুরে,
তল্ওয়ার খাপে সূর্যের খা’ব পড়ছে ঝু’রে,
চম্কালো ঐ দিগন্তে ওকি বজ্ৰ-নার,
অথবা আলীর শাণিত দু’ধারী জুলফিকার?

দিক-দিগন্তে ভ’রে গেছে চোখে যায় না দেখা
মেঘ-নির্ঘোষে জাগে আতশের শস্ত্র লেখা।
আল্লার শের পাহাড় হ’তে কি ঝাঁপায়ে পড়ে?
তীক্ষ্ম শিকারী-চোখ শত্রুর টুটীর পরে …
সময় নাহি তো আলী হায়দর ভেঙেছে দ্বার
আসে মুর্তজা, সিপাহ়্-সালার ভাঙি প্রাকার
পালাও এবার দুমার দল ফেটে প’ড়ে অমর…
আলী হায়দর! আলী হায়দর! আসে আলী হায়দর।

থরথর করি কাঁপে প্রান্তর জীর্ণ খেজুর পাতা,
বিদ্যুৎ যেন ছিঁড়ছে আবর খোর্মাবীথির ছাতা
দক্ষিণে বায় ঘন চমকায় আলীর জুলফিকার
সহসা প্রকাশ সূর্য খুলেছে মধ্যদিনের দ্বার।

চোখ ঝলসানো কোথায় সে তরবারি?
কোথা মুর্তজা? কোথা সে শস্ত্রধারী?
এখানে জমেছে নিবিড় অন্ধকার।

এখানে জয়ীফ স্থবির আঁধার-
জমানো মেঘ
এখানে বইছে বাধার পাথার
নিরুদ্বেগ,
এখানে বইছে ঝড়, বালুকায়
ঝ’রছে পাতা।
পারি না ওঠাতে এই ঝঞ্ঝায়
শীর্ণ মাথা
বিজলী চমক দেয় না আলীর
জুলফিকার
বহুদিন হ’তে এ মরু গলির
রুদ্ধ দ্বার।।

তবু যেন শুনি জড়-প্রান্তরে জীবন্ত হুংকার,
আজো বুঝি মোর শিরায় শিরায় সুর তোলে তল্ওয়ার,
সে প্রিয় পরম, দিগন্তে দেখি আঁকা
জুল্ফিকার সে? অথবা বজ্ৰ বাঁক?

সুদূর দিনের ছবি …
নিখিল তিমির শর্বরী-তটে জাগ্ছে আরব-রবি
আলোক-অন্ধ খান্নাস দল তীর ছোঁড়ে তার বুকে
পর্বত-বাধা আনে তার সম্মুখে।

এমন সময় যে নওজোয়ান হাতে তেগ তল্ওয়ার
নির্ভীক-সিনা দাঁড়ায়েছে পাশে তার
তূর পাহাড়ের পাথরে খোদাই সুদৃঢ় তার তনু
হেরার জ্যোতিতে কোরানের নুরে ভরা অণু পরমাণু
সকল অত্যাচারের মধ্যে ওঠে দিয়ে মাথা নাড়া
দারাজ বাজুতে সংহত করি অগ্নিগিরির ধারা
ইসলামী জোশে বেহুঁশ পাগল-পারা
খোলে একে একে মানবতার সে চির-নিরুদ্ধ কারা।

তার তক্‌বিরে বিয়াবান চিরে বাহিরিয়া আসে স্বর
তার তক্‌বিরে কাঁপে অমর, ফাটে মরু-প্রান্তর
গর্জে খোদার সিংহ: আল্লা, আল্লাহু আক্বর!
নবীজীর পাশে আল্লার সেনা এল আলী হায়দর!

পাহাড় হ’তে সে আল্লার শের ঝাঁপায়ে প’ড়ে
অগ্নিতীক্ষ্ণ-চোখ শক্রর টুটির ‘পরে
জানি না অত্যাচারীর এ কোন্ আজরাইল
তুলার মতন ওড়ে যার ডরে পাথর দিল।।

সে কী তূরন্ত দুরন্ত-গতি মরুতে ঝড়ের বেগে!
জড়পিণ্ড এ বিয়াবানে বুঝি আগুন উঠেছে জেগে
হাজার ঘোড়ার খুরের আঘাতে লক্ষ উল্কা জ্বলে
দিগ্কাওসের বাঁকা রেখা উড়ে চলে,
তীরের মতন বেগে স’রে যায় পদতলে মরুভূমি,
শহীদের খুনে মরণ তুফান জীবনের মৌসুমী …

তারি সাথে ঘন চমকায় হাতে দুধারী জুলফিকার
নিমেষে সূর্য ছিঁড়ছে শাণিত অস্ত্রে আঁধি-প্রাকার
চমকে জুলফিকার
জেহাদের মাঠ চাষ ক’রে তার মেঘে ওঠে হুংকার …

‘ও- লো ওজ্জা! ও- লো হোবল!’
হুংকারি আসে পংগপাল
আসে বর্বর কাফেরদল
ক্লেদ-সমুদ্র ফেনোত্তাল
বীভৎস হীন-হিংস্রতায়
ভরায়ে উষর পৃথিতল
হাঁকে খান্নাস, খবিস দল
‘ও- লো ওজ্জা! ও- লো হোবল’…

হিংস্র নখরে পাশবতার
ছিঁড়বে সে টুটি ইস্‌লামের,
ছিঁড়বে সে টুটি মানবতার,
চারিদিকে ফেলি তিমির ঘের
নেভাবে চেরাগ-শিখা অমল,
আসে ডাক ছেড়ে কাফেরদল
ভরায়ে আরাবে শূন্যতল
‘ও- লো ওজ্জা! ওলো হোবল!’

এখন কোথায় সিপাহ্-সালার? ঐ শোন তার স্বর।
আলী হায়দর! আলী হায়দর! আসে আলী হায়দর!

যেদিকে বাড়ায় নির্ভীক অঙ্গুলি
নুড়ির মতন ওড়ে কাফেরের খুলি
কেঁপে মরে তার বজ্রের রবে শঙ্কিত আজাজিল
চৌচির হয় সঙ্গ্দিল যত পিশাচের কালো দিল।
নেজা-গোর্জের মেঘ আবরণ ছিঁড়ে
সূর্য দীপ্ত তল্ওয়ার ফেরে মৃত্যুর তীরে তীরে
দুশ্মন-ডেরা জয় করি ওঠে সে চির-জয়ীর স্বর
আল্লাহু আক্বর।

সিপাহ্-সালার! তব তকবিরে শাশ্বত ইস্‌লাম
ওড়ায় বিজয়ী সফেদ হেলাল চাঁদ-নয়নাভিরাম
অতল গভীর হ’তে ভেসে ওঠে গৃঢ় শান্তির স্বর
সেতারা জ্বালানো দীপশিখা নিয়ে হেসে ওঠে অম্বর।

হে মহামানব! তুমি শুধু নহ বীর তল্ওয়ারধারী
অসংযমের উপরে হেনেছ সত্যের তরবারি,
কোন মলিনতা করেনি তোমার চিত্ত কলুষ কভু
আল্লাকে ছাড়া আর কারু তুমি মানো নাই তব প্রভু
তাঁর নির্দেশ মাথা পেতে নিয়ে তব অলঙ্খ শির
সবার উপরে র’য়েছে উর্ধ্বে সব পাপ-গোলামীর।
যারা আল্লার দাস্য করে না, নিজেদের অগোচরে
সকল দাস্য-শিকলে জড়ায়ে প্রতি পলে ডুবে মরে।
এই পিশাচের পদলেহীদের অনেক ঊর্ধ্বে থেকে
মহামানবের পথ চলিবার আদর্শ গেছে রেখে …

যার বল্লম চাষ ক’রে গেছে লাখো জালিমের খুলি,
বদর আকাশে মেঘ হ’য়ে যার জমেছে পায়ের ধূলি,
ইহুদীর পিছে দেখ সে চ’লেছে সম্প্রম নত-শির
মহাসেনানীর বিনয়ে-মুগ্ধ মানবতা ধরণীর।

বৃদ্ধকে ঠেলে ফেলে দিয়ে যেতে বিবেক দিয়েছে বাধা
দুশ্মন্ও পায় তোমার নিকটে মানুষের মর্যাদা।
তোমার বিনয় উঠিয়াছে খাস আল্লার দরবারে
তাই জামাতের অধিকার তব কেহ নাহি নিতে পারে।

আল্লার পথে জানি তুমি শুধু ধরিয়াছো তরবারি,
চির-সংযমী ভুলেও কখনো হওনি অত্যাচারী,
কাফেরের থুথু সারা মুখে নিয়ে নাও নাই প্রতিশোধ,
আল্লার দাস দমন করেছ সব অন্যায় ক্রোধ।
ফেরেশতাদের উর্ধ্বে তুলেছে তোমারি সে মানবতা
হে সুফী সাধক! তাই জিনিয়াছ নভঃ দুর্লংঘতা।

প্রজ্ঞাপূর্ণ মহানগরের হে বিরাট শাহীদ্বার!
তাছাওফের যে নূরানী ঈমে তনুমন একাকার
তার নিভৃত ইংগিত পেয়ে নলবনে ওঠে সুর
শামাদানে জ্বলে প্রেমের শিখায় বেদনা যে অবগাহি
কোটি মুসলিম পেয়েছে ফিরিয়া চিত্তের বাদশাহী!

মরুভূর ধূলি, একমুঠো ধূলি এক মুঠো মৃত্তিকা
জানি কেমন করে সে পেয়েছে সাত আকাশের শিখা,
আরশের তলা হ’তে সে কুড়ায়ে আনে জান্নাতী নূর
মাটির পাঁজরে ভেসে আসে তার হারানো দিনের সুর,
ছোটে সে হাওজ-কওসর পানে, মাকামে মাহ্‌মুদায়
পুষ্পিত শাখা ভরে শবনম, শারাবন তহুরায়।

গোলাবের গান বুকে পূরে নিয়ে উড়ে আসে বুলবুল
আঞ্জির শাখে লু-হাওয়া জাগায় শীষ,
মরু আফতাব হেসে ওঠে তার পথে দেখে ওয়েসিস্
প্রখর দিনের রশ্মিও ক্রমে তন্দ্রা স্বপ্নকুল।

হাবিয়ার জ্বালা নিয়ে যে বদ্দূ চ’লেছিল পথ ভুলে
তোমার শেখানো নলের বাঁশরী তুলে
উন্মাদ প্রেমে হ’য়েছে সে মস্তানা
সিন্ধু ঈগল মরুতটে এসে মেলে প্রসারিত ডানা।
তার শ্রান্তির আক্সির জানো তুমি
পুষ্পমুখর হ’য়ে হেসে ওঠে কোটি মৃত বনভূমি।

জায়নামাজের মাদুরে তোমার মধু ঝ’রে মোত্তাকী
ফির্দৌসের প্রেমের শারাব বিলায় অচেনা সাকী,
তোমার চিত্ত নীল কবুতর পাড়ি দেয় কান্তার
ক্ষত তনু হ’তে তীর তুলে নিলে ভাঙে না আবেশ তার।।

যে আফতাবের রশিতে রাঙি চাওনি হীরা ও মোতি
তার গতিবেগে বাড়ালে মানব-মনের অগ্রগতি
গলিজ আবর্জনায় ত্যক্ত ফিরে পায় মানবতা,
ষোল পাপড়িতে চাঁদ পূরে এসে পায় তার পূর্ণতা।
চাঁদের নদীতে ওঠে অবিরাম জোছনার কল্লোল
মরু-দুলালীর রাঙা হাতে দফ্ বলে শুধু মিঠে বোল।

তূর পাহাড়ের বহিরাবরণে বজ্রের বেষ্টনী
তবু অন্তর-মূলে ভাসে তার ঝর্ণা কলধ্বনি,
পাথরে খোদাই আলী হায়দর! আবু তোরাবের প্রাণ
শিলা দুর্গমে ঝর্ণার মত ব’য়ে যায় অফুরান।

কোন্ অনন্ত দরিয়ার পানে তার অশান্ত গতি
দু’পাশে ছিটায়ে ফুলের আঁজলা ছুটেছে মরুর নদী,
ডুবুরীর সাথে ডুব দিয়ে দিয়ে পায় না সিন্ধুতল
দজ্লা শিরায় নিত্য নতুন জোয়ার ঢালিছে ঢল;
রহে সুগভীর সিন্ধুর নীর সীমাহীন অতলতা
তার দ্বারে এসে সভ্ৰম- নত সকল চঞ্চলতা।
বাজে অনন্ত জলতরংগ মৃদংগ অম্বরে
সারং রবাব একাকার হ’ল যন্ত্রীর মন্তরে।
নাই তিল অবসর
যেথা ঈশ্কের আতশী-আবেগ ছাড়ে আকাশের স্তর
সেখানে তোমার নিত্য অবাধ গতি।
জান্নাতে ফিরদৌসের পথে চিত্ত মানে না ক্ষতি।
মহানগরের হে শাহী দরজা! তোমার আকাশ খোলা!
সম্মুখ দিয়ে পার হ’য়ে যায় হূরের চতুর্দোলা
হে নূর পিয়াসী! কে রাখে তার খবর?
আল্-আহাদের সন্ধানে তার নাই তিল অবসর!
আল্লা’র কাছে ক’রেছে সে তার পূর্ণ সমর্পণ,
তাই সে মানে না অত্যাচারীর, জালিমের বন্ধন,
তাই মরুপারে রুদ্ধ কপাট ডাকে যবে খায়বার,
অমনি সূর্যে ঝলসে তোমার দু’ধারী জুলফিকার।

মুস্‌লিম কভু নাহি মানে পরাজয,
কুল মখ্লুকে তার জয় অক্ষয়,
যত খায়বার রুধেছে দুয়ার সেনানী তোমার হাতে
ভেঙেছে বালুর মিনার যেমন ভেঙে প’ড়ে ঝঞ্চাতে …

শিলা-সংকুল পরিখার ধারে কাটছিল তার দিন,
কোরেশের খিমা উড়েছে কখন ঝড়ে
কোথায় বন্দী বনি-কোরায়েজা শংকিত কেঁপে মরে
ভাগে দুমতল-জন্দল রাজ দূরে দেখে সংগিন
পার হ’য়ে যায় সন্ধির সব দিন।
এমন সময় দুর্গম পথে ডাক এল যবে তার
অমনি সূর্যে ঝলসি উঠিল দু’ধারী জুলফিকার।

সিংহ-নখর ছিঁড়ে ফেলে যথা ভীরু দুষার ঝুঁটি,
জানি খায়বার প’ড়েছে তেমনি তোমার আঘাতে লুটি
তিমির প্রান্তে দেখি হেলালের নবীন অভ্যুদয়,
দ্বীন ইসলাম পড়েছে ছড়ায়ে নিখিল বিশ্বময়,
আরবী তাজীতে কাসেদ ছুটেছে নাই তার অবসর,
রুদ্ধ দুর্গ দুয়ার ভেঙেছে মহাবীর হায়দর,
তার পথ দিয়ে আসিছে খালেদ, আসিছে তারেক, মুসা
সুবে সাদিকের বন্দরে ভেসে আসিছে রক্ত-ঊষা
সে পথের খোজ নাই আর অগোচর
নতুন নকীব ছুটেছে বহিয়া জয়ের শুভ-খবর
ছড়ায়ে প’ড়েছে বিজয়ী সূর্য-রশ্মি নবীর দ্বীন,
ইরানের ভিতে গোলাবীর পাপড়ি জাগিতেছে রংগিন

কান পেতে শশানে মহাচীন কোন্ হারানো পদধ্বনি
কালো চামড়ার আড়ালে কাফ্রী-সিনা ওঠে রণরণি
আজ নির্ভীক মজলুম ওঠে মদীনা মিনার বেয়ে
খুন খোশরোজ পারে মওসুমী শিখা ফেলে মাটি ছেয়ে!
আট কেল্লার রুদ্ধ প্রাকার আজিকে হ’য়েছে গুঁড়া,
কুলমখ্লুক হ’তে দেখা যায় আল্ হেলালের চূড়া,
তার তক্‌বির শোনা যায়, পিছে ওঠে জনতার স্বর:
আলী হায়দর! আলী হায়দর! আসে আলী হায়দর!