আরিচা-পারঘাটে

এক
বর্ষার মেঘের নীচে ছায়াচ্ছন্ন আরিচায় এসে
মনে হ’ল পারঘাট যেন এক নিষ্প্রাণ কবর
(জীবনের সব চিহ্ন মুছে গেছে এখানে নিঃশেষে)!

প্রতীক্ষার ক্ষণ তাই মনে হয় তিক্ত, ক্লান্তিকর,
পারে না জাগাতে আর কারো বুকে প্রাণের স্পন্দন,
বিমর্ষ, প্রকৃতি, মেঘ গতিহীন; সময় মন্থর!

চিত্রিত পটের মত ব’সে আছে যাত্রী কয় জন
সন্ধ্যার খেয়ার পথে অবসন্ন- দেহ পারঘাটে,
আনন্দের সাড়া নাই, নাই হাসি, কথোপকথন,

অসহ্য ক্লান্তির ভারে এই ভাবে দীর্ঘ দিন কাটে?
অকস্মাৎ দেখি চেয়ে খরস্রোতা নদী বহমান
আরিচার তীর ছেড়ে বয়ে যায় জীবনের নাটে

কী দুরন্ত গতিবেগ! কী উদ্দাম আনন্দ-অম্লান
যৌবনের কলোচ্ছাসে গেয়ে যায় জীবনের গান।।

দুই
বাধাবন্ধহীন নদী,- গতিবেগ উন্মুক্ত, অবাধ
মুক্ত জীবনের কিংবা আজাদীর যেন সে প্রতীক
(জিঞ্জির, জিন্দান ভেঙে যে পেয়েছে পূর্ণতার স্বাদ

কিংবা মঞ্জিলের দিশা,- যে পেয়েছে ঠিকানা সঠিক)
ভাসায়ে পথের বাধা সমুদ্রের ডাকে সে দীউয়ানা
চলে দুর্নিবার গতি স্থির লক্ষ্যে- দৃষ্টি নির্নিমিখ!
প্রলয়ের কাল মেঘ রুদ্ধ রোষে ঝাপ্টায় ডানা,
সুবিশাল বনস্পতি দাঁড়ায় রুধিয়া তার পথ,
দুরন্ত তুফান, ঝড় মধ্য পথে দেয় তা’কে হানা

তবু সে উদ্দাম গতি লুপ্ত করি বাধার পর্বত
ধ্বংসের কুটি আর ভয়ংকর প্রলয়, তুফান
হেলায় ভাসায়ে যত প্রলোভন, মিথ্যা দাস যত

দুর্গম, দুস্তর পথে ভারমুক্ত শম্ভকাহীন প্রাণ
গেয়ে যায় কলোগ্লাসে মুক্ত জীবনের জয়গান৷।

তিন
এ নদী প্রবহমান জীবনের নব জাগরণে
ভাসায়ে তরঙ্গভঙ্গে জড়তা, জরার আক্রমণ
চলে সে উদ্দাম গতি (শঙ্কা নাই সংঘাতের ক্ষণে),-

মুখাপেক্ষী নয় কারো; মানে না সে শৃঙখল বন্ধন।
অবরুদ্ধ হয় যদি যাত্রাপথে কভু অতর্কিতে
প্রচণ্ড আঘাতে ভাঙে সব বাধা; সমস্ত বারণ

বন্যাবেগে মুছে ফেলে নেয় খুঁজে মুক্তি পৃথিবীতে
(অথবা সে যায় মুছে যত বাধা দৃঢ় বা ভঙ্গুর)।
গতিমান এ জীবনে অন্তহীন পথের সঙ্গীতে

তীর-তীব্র বেগে চলে নিয়ে তার বাধামুক্ত সুর,
গেয়ে যায় মুক্ত কণ্ঠে পরিপূর্ণ জীবনের গান

(সম্মুখে চলার পথে নাই তার ব্যর্থতা অশ্রুর),
খিজিরের কাছে পেয়ে মঞ্জিলের, পথের সন্ধান
জীবন্ত প্রবাহ চলে অসংশয়- ভারমুক্ত প্রাণ।।

চার
খরস্রোতা এ নদীর তীরে ব’সে স্তব্ধ পারঘাটে
মনে হ’ল সে মুহুর্তে দিকে দিকে প্রাণের মর্মর,
উম্মুখ আগ্রহে চলে পরিপূর্ণ জীবনের নাটে,

গতিচ্ছন্দে পিষে যায় অপমৃত্যু,- মিথ্যা, অসুন্দর!
মুমূর্ষু এ জিন্দেগানি ছায়াচ্ছন্ন থেকে দীর্ঘকাল
মুক্ত আকাশের নীচে শোনে তার মুক্তির খবর!

শতাব্দীর প্রান্তে সেই প্রাণধারা তরঙ্গ উত্তাল
জাগায়ে শহর, গ্রাম হানা দেয় নিভৃত কুটিরে;
পরিবর্তনের ধারা ওঠে জেগে বিক্ষুব্ধ, বিশাল!

নতুন ঊষার বহ্নি দেখা দেয় প্রাচ্যের তিমিরে,
শীর্ণ জনতার প্রাণে জীবনের দিতে আমন্ত্রণ
প্রমত্ত নদীর মত সেই বার্তা আসে আজ ফিরে,
শিরায় শিরায় জাগে জীবনের নতুন স্পন্দন;
আবে হায়াতের স্পর্শে জিন্দেগীর হয় উজ্জীবন।।

পাঁচ
প্রতীচীর হিংস্র ছায়া- কাল রাত্রি হয় অবসান,
প্রাচ্যের আকাশ থেকে ঝ’রে পড়ে সুপ্তি শতাব্দীর,
দীর্ঘ সংগ্রামের পথে ওঠে জেগে নতুন জাহান!

ভোরের শিকারী ঊষা নিশীথের বক্ষে হানি’ তীর
উজ্জ্বল আলোকরশ্মি আনে আজ প্রাচ্যের আকাশে,
অসংখ্য জিন্দান থেকে ঝ’রে পড়ে জুল্মাত রাত্রির,

অসংখ্য জিঞ্জির থেকে সদ্যমুক্ত জীবন উল্লাসে
নতুন বিপ্লবে পায় জীবনের চিহ্ন অমলিন।
সংশয়-বন্ধন মুক্ত আজাদীর বার্তা নেমে আসে

তরঙ্গিত জীবনের গতিস্রোতে রক্তিম, রঙ্গিন।
দীর্ণ করি বিভীষিকা অন্ধকার রাত্রির কবর
পরিপূর্ণতার ডাকে এ জীবনে আসে মুক্ত দিন,

কাফেলার যাত্রাপথে আসে নেমে নতুন খবর;
শুরু হয় দরিয়ায় জিন্দেগীর নতুন সফর।