বৈশাখ

ধ্বংসের নকীব তুমি হে দুর্বার, দুর্ধর্ষ বৈশাখ
সময়ের বালুচরে তোমার কঠোর কণ্ঠে
শুনি আজ অকুণ্ঠিত প্রলয়ের ডাক।।
চৈত্রের বিশীর্ণ পাতা রেখে গেছে শেষ চিহ্ন সালতামামীর,
ফাল্গুনের ফুলদল (কো’কাফের পরী যেন) আজ শুধু কাহিনী স্মৃতির,
খর রৌদ্রে অবসন্ন রাহী মুসাফির যত পথ-প্রান্তে নিঃসাড়, নিশ্চল,
আতশের শিখা হানে সূর্যরশ্মি লেলিহান, ঝিমায় মুমূর্ষু পৃথ্বিতল,
রোজ হাশরের দগ্ধ, তপ্ত তাম্র মাঠ, বন মৃত্যুমুখী, নিস্তব্ধ, নির্বাক;
সূরে ইস্রাফিল কণ্ঠে পদ্মা মেঘনার তীরে
এস তুমি হে দৃপ্ত বৈশাখ।।

প্রজ্ঞার বর্তিকা নিয়ে দূর-দূরান্তের পথে চ’লে গেছে দিশারী খিজির,
শস্য-শ্যামলিমাহীন ঊষর প্রান্তর যেন শূন্যতার প্রতীক পৃথ্বীর,
চৈত্রের বিশ্রান্ত শ্বাস মূর্ত হ’য়ে ওঠে শুধু তাপদগ্ধ, উদ্ভ্রান্ত জীবনে,
নিষ্প্রাণ শূন্যতা নিয়ে বিমর্ষ প্রান্তর,- মন গুমরিয়া ওঠে ক্ষণে ক্ষণে,
খর রৌদ্রে উদ্ঘাটিত ব্যর্থতার এ অধ্যায়, প্রাণহীন এ নদীর বাক;
সুরে ইস্রাফিল কন্ঠে নিষ্প্রাণ দিনের তীরে
এস ফিরে হে দৃপ্ত বৈশাখ।।

হারায়ে সাক্বনা, শান্তি চৈত্রের গুমোটে বন্দী ধরা মৃত্যু-ম্লান,
রৌদ্রদগ্ধ পৃথ্বিতল দেখে শুধু অপমৃত্যু- মওতের জিঞ্জির, জিন্দান,
শত বিকৃতির ছাপ, পঙ্গুতার ম্লান ছায়া পৃথিবীতে জাগে ক্ষণে ক্ষণে,
পুঞ্জীভূত হতাশায় বিষবাষ্প জ’মে ওঠে লক্ষ্যহীন বিভ্রান্ত জীবনে,
গতিহীন জড়তায় বিকলাঙ্গ জীবনের পথে জমে ক্লেদ, গ্লানি, পাঁক;
এ দুঃসহ জীবনেরে নাড়া দিয়ে এস ফিরে
এস তুমি হে দৃপ্ত বৈশাখ।।

এস তুমি সাড়া দিয়ে বিজয়ী বীরের মত, এস স্বর্ণ শ্যেন,
বাজায়ে নাকাড়া, কাড়া এস তুমি দিগ্বিজয়ী জুলকার্ণায়েন,
আচ্ছন্ন আকাশ নীলে ওড়ায়ে বিশাল ঝাণ্ডা শক্তিমত্ত প্রাবল্যে প্রাণের
সকল প্রকার, বাধা চূর্ণ করি মুক্ত কর পৃথিবীতে সরণি ত্রাণের,
সকল দীনতা, ক্লেদ লুপ্ত কর, জড়তার চিহ্ন মুছে যাক;
বিজয়ী বীরের মত নির্ভীক সেনানী তুমি
এস ফিরে হে দৃপ্ত বৈশাখ।।

অগণ্য, অসংখ্য বাধা ওড়ায়ে, প্রবল কণ্ঠে তুলি তীব্র পরুষ হুঙ্কার
হে বৈশাখ! এস ফিরে বজ্বের আগুনে দীপ্ত- আল্লার দু’ধারী তলোয়ার,
ভ্রষ্ট, গুমরাহা যত নির্বোধের অহমিকা, শূন্যগর্ভ দম্ভ, আস্ফালন
চূর্ণ করি এস তুমি শঙ্কাশূন্য রণাঙ্গনে সমুজ্জ্বল সেনানী যেমন
নিঃশঙ্ক আল্লার শের- দীপ্ত আবির্ভাবে যার পলাতক ফেরুপাল, কাক;
সূরে ইস্রাফিল কণ্ঠে পদ্মা মেঘনার তীরে
এস তুমি হে দৃপ্ত বৈশাখ।।

মিথ্যা বাতিলের দুর্গ ধ্বংস করি; ধ্বংস করি বিভীষিকা সঞ্চিত রাত্রির
তৌহিদী পয়গাম কণ্ঠে যেমন দাঁড়ালো এসে মর্দে খোদা- জালালী ফকীর
মূসা কালীমের মত ‘আসা’ হাতে তীব্র দৃষ্টি বাংলার প্রান্তরে
চৈত্রের বিভ্রান্তি ভেঙে তেমনি বৈশাখ এস খর রৌদ্রে…এস ঘরে ঘরে,
তোমার সংঘাতে এই পৌত্তলিক জড়তার মৃত্যুম্লান শর্বরী পোহাক;
কালের কুঠার তুমি নিষ্প্রাণ এ জনারণ্যে।
এস ফিরে হে দৃপ্ত বৈশাখ।।

কিম্বা রোজ আযলের প্রোজ্জ্বল শিখার মত মুক্ত লেলিহান
জ্বালায়ে সকল আঁধি হে সাধক! দাও এসে মুক্তির আহ্বান,
প্রখর তোমার দাহে মিথ্যা তেলেসমাত, যাদু,- পুড়ে যাক সত্তা তামসিক
শুনুক সমগ্র বিশ্ব তোমার প্রবল কণ্ঠ হে দুর্জয় সত্যের সৈনিক!
শুনুক সভয়ে যত আত্মরতিমগ্ন প্রাণ জড়তায় নিস্তব্ধ, নির্বাক;
পদ্মা মেঘনার তীরে এস তুমি এস ফিরে
এ জীবন সংগ্রামের বৈশাখ।।

ধ্বংসের নকীব তুমি হে বৈশাখ! এস ফিরে, এস তুমি অপূর্ব সুন্দর,
বৎসরের সূচনায় পিঙ্গল আকাশে দেখি অগ্নি বর্ণে তোমার স্বাক্ষর,
প্রচণ্ড ঝড়ের সাথে অচ্ছেদ্য, অভিন্ন সত্তা,- খুলিরুক্ষ এ পাক জমিনে,
জরাগ্রস্ত পৃথিবীতে, অথবা বিক্ষত প্রাণে এস তুমি এস পথ চিনে,
তোমার প্রাণের তাপে ব্যাধিগ্রস্ত জীবনের ক্লেদ, গ্লানি সব জ্ব’লে যাক;
পুরাতন বৎসরের প্রান্তর ছাড়ায়ে এস;
এস চির দুর্জয় বৈশাখ।।

বিদায় বিগত বর্ষ! হে বিশীর্ণ পুরাতন আলবিদা জানাই তোমাকে,
নতুনের স্বপ্ন জাগে মৃত্যুম্লান পৃথিবীতে রৌদ্রদগ্ধ বৈশাখের বাঁকে,
নিষ্প্রাণ এ জড়তার বুকে জাগে তীব্র গতি, জাগে ঝঞ্ঝা রব,
দুরন্ত ঝড়ের বেগে অচল স্থাণুর বুকে ওঠে জেগে উদ্দাম বিপ্লব,
সুখ-বিলাসীর স্বপ্ন ভেঙে যায়, ভেঙে পড়ে কারুণের সঞ্চিত মৌচাক;
সুপ্তির সমুদ্র থেকে জাগ্রত প্রাণের দ্বারে
হানা দেয় প্রমত্ত বৈশাখ।।

মৃত্যু-ঘন অন্ধকারে জ্বালায়ে বিদ্যুৎ-ক্ষণ দীপ্ত জুল্ফিকার
নববর্ষ শুরু হয়, নতুন বৎসর আসে সংগ্রামের পথে দুনিৰ্বার,
সৃষ্টি ও ধ্বংসের মাঝে, শ্রম সাধনার পথে অপূর্ব উল্লাসে
‘খোশ আমদেদ’ ধ্বনি সকল দিগন্ত হ’তে আজ ভেসে আসে,
ব্যর্থতার যত গ্লানি মিশে যায় দূরান্তরে- পলাতক বলাকার ঝাঁক;
সূরে ইস্রাফিল কণ্ঠে মুক্ত জনতার মাঝে
আসে আজ প্রমত্ত বৈশাখ।।

হে বৈশাখ! এস এস খররৌদ্র-উদ্ভাসিত প্রমুক্ত নীলার শাহ্বাজ
ঝড়ের দু’পাখা মেলে হানা দাও কণ্ঠে তুলে দ্বিধাহীন বজ্রের আওয়াজ,
দিগন্ত-বিস্তৃত মাঠ, বিশাল অরণ্য আর জনপদ- বিমর্ষ শিকার
মুহূর্তে উঠুক জেগে, উঠুক সভয়ে কেঁপে দু’পাখার ঝাপটে তোমার,
প্রচণ্ড আঘাতে সেই রুদ্ধ গতি জীবনের সব গণ্ডী- সীমানা হারাক;
সূরে ইস্রাফিল কণ্ঠে পদ্মা মেঘনার তীরে
এস তুমি প্রমত্ত বৈশাখ।।

হে বৈশাখ! এস এস … জিঞ্জির, জিন্দান ভেঙে সুলেমান নবীর উম্মৎ
প্রমত্ত জ্বিনের মত সদ্যমুক্ত এস তুমি তোলপাড় করি’ সারা পথ,
উথালপাথাল ঢেউ দরিয়ার বুকে তুলে ক্ষণিকের মৃত্যু মহোৎসবে
ডোবায়ে হাজার কিশ্তী লক্ষ ডিঙি চল তুমি হে বৈশাখ, শত বজ্র রবে!
আতকিত ছাড়ে পথ দুই পাড়ে তরু শ্রেণী নারিকেল, তাল ও গুবাক;
সূরে ইস্রাফিল কণ্ঠে পদ্মা মেঘনার তীরে
এস ফিরে উন্মত্ত বৈশাখ।।

হে বৈশাখ! এস এস পাড়ি দিয়ে অতলান্ত দরিয়া কিনার,
হে দুর্ধর্ষ, উঠে এস বাষ্পীভূত কাল মেঘ- সমুদ্রের তাজীতে সওয়ার,
অমা-অন্ধকার-ঘন, ঝড় গতি সে তাজীর তীব্র হ্রেষা রবে
ভীরুতার অবসানে মহান মৃত্যুর মাঠে জীবনের খেলা শুরু হবে,
দ্বিধা-দ্বন্দ্ব লোভ যত, গণিতের খতিয়ান অসমাপ্ত,- সব বন্ধ থাক;
সূরে ইস্রাফিল কণ্ঠে পদ্মা-মেঘনার তীরে
এস ফিরে প্রমত্ত বৈশাখ।।

কিংবা তুমি উঠে এস দুরন্ত, দুর্বার গতি শঙ্কাহীন হে ঘোড়-সওয়ার
ওড়ায়ে জড়তা শিলা, ওড়ায়ে সকল বাধা, দ্বন্দ্ব-দ্বিধা সংশয়ের ভার
পিষে ফেলে যাও সব রাজ্য, রাজধানী, গ্রাম, জনপদ, মাঠ;
আল্লার আলমে তুমি মর্দে মুজাহিদ, বীর, সমুন্নত প্রদীপ্ত ললাট,
তোমার তক্বিরে তাই ত্রস্ত কুল মখলুকাত,- জীবনের, এ নদীর বাঁক
সময়ের হাতিয়ার কোষমুক্ত খরধার
এস চির দুর্জয় বৈশাখ।।

সংগ্রামে, সংঘর্ষে দীপ্ত এস তুমি হে বৈশাখ!- বিপ্লবের প্রতীক অম্লান
স্বাগত জানায় তাই তোমাকে বিপ্লবী বীর আশ্রাফুল মখ্লুক ইনসান,
তোমার বিধ্বংসী রূপে ভয় পায় ভীরু প্রাণী, অবিশ্বাসী অথবা দুর্বল,
তোমার বিধ্বংসী রূপে মর্দে মুমীনের মন উচ্ছসিত, আনন্দ-চঞ্চল,
পথসঙ্গী সে তোমার জঙ্গী সে নির্ভীক প্রাণ যে শুনেছে জ্বেহাদের ডাক
সর্বশক্তিমান যিনি তার আধিপত্য মানি,
চল জঙ্গী নির্ভীক বৈশাখ।।

সংগ্রামী তোমার সত্তা অদম্য, অনমনীয়,- বজ্রদৃঢ় প্রত্যয় তোমার,
তীব্র সংঘর্ষের মুখে বিশাল সৃষ্টিকে ভেঙে অনায়াসে কর একাকার,
সম্পূর্ণ আপোষহীন, মধ্যপথে কোন দিন থামো না তো, জানো না বিরতি,
তোমার অস্তিত্ব আনে ক্ষণস্থায়ী এ জীবনে অবিচ্ছিন্ন, অব্যাহত গতি,
প্রচণ্ড সে গতিবেগ ভাঙে বস্তি, বালাখানা, ভেঙে পড়ে জামশিদের আঁক,
লাভ-ক্ষতি সংজ্ঞাহীন, নিঃশক, নিঃসঙ্গ তুমি
হে দুর্বার, দুর্জয় বৈশাখ।।

তোমার অবাধ গতি সমুদ্রে, প্রান্তরে কিংবা সুদুর্গম অরণ্যে, পাহাড়ে;
যত পাও প্রতিরোধ সম্মুখে চলার পথে তোমার উল্লাস তত বাড়ে,
তোমার চলার তালে রুদ্ধদ্বার কক্ষ ভাঙে, ভাঙে দুর্গ, আবদ্ধ প্রাকার,
স্থবির জড়তা, ক্লেদ উড়ে যায় শুষ্ক তৃণ হে বৈশাখ! সংঘর্ষে তোমার,
ধ্বংসের নেশায় মেতে উড়ায়ে গুঁড়ায়ে চল প্রতিরোধ, বাধা, দুর্বিপাক,
জাগায়ে ধ্বংসের সুরে খণ্ড কেয়ামত যেন
প্রমত্ত ধ্বংসের সুরে ধাও তুমি চির দিন
হে নির্মম, নির্ভীক বৈশাখ।।

হে বৈশাখ! এস, এস… স্রষ্টা যিনি লা-শরিক জব্বার, কাহ্হার
তাঁর আজ্ঞাবহ তুমি নিয়ে যাও দেশে দেশে প্রলয় ধ্বংসের সমাচার,
বিধূনিত তুলা সম উড়ে যাবে এ পৃথিবী, যে দিন পাহাড়;
তোমার চলার তালে হে বৈশাখ! পাই আমি নিশানা যে তার
ধ্বংসের কঠোর দূত জানো না তো কোমলতা, দাও এসে প্রলয়ের হাঁক;
প্রমত্ত ধংসের সুরে ধাও তুমি চির দিন
হে নির্মম, নির্ভীক বৈশাখ।।

বৈশাখ! তোমার স্রষ্টা জব্বার, কাহ্হার যিনি রহীম, রহমান;
তার ইশারায় জানি ফুলের পাপড়ি মেলে অগ্নিকুণ্ডে শিখা লেলিহান,
অশেষ রহমত যাঁর বৃষ্টিধারা নিয়ে আসে জীবনের নব রূপায়ণ,
ধ্বংসের সমাধি স্তূপে সবুজ ঘাসের শীষে দেখা দেয় জান্নাত্ নূতন,
শহীদী লহুর স্পর্শে প্রাণবন্ত হয় ফের এ জমিন- কারবালার খাক;
তোমার ধ্বংসের সূরে অনাগত সৃষ্টি স্বপ্নে
মন তাই উধাও বৈশাখ।।