বর্ষায়

এক
বঙ্গোপসাগর থেকে এল ভেসে মেঘের কাফেলা
জীবনের বার্তা নিয়ে স্নিগ্ধ, শ্যাম মমতা-মেদুর,
পাড়ি দিয়ে বহু পথ, বালু বক্ষ সমুদ্রের বেলা

গ্রীষ্মের উত্তপ্ত প্রাণে দিল এনে বর্ষণের সুর
(মত্ত ময়ূরের মন বনপ্রান্তে গেয়ে ওঠে “কে-কা”)!
চৈত্রের ফাটল ধরা মাঠ, বন তৃষিত, বিধূর

দীর্ঘ প্রতীক্ষার শেষে দেখে চেয়ে মসীবর্ণে লেখা
নিবিড় মেঘের পটে চমকায় বিদ্যুৎ সর্পিল
(জান্নাতের হুর যেন অকস্মাৎ দিয়ে যায় দেখা,

শুধু মুহুর্তের তরে আকাশের খুলি ঝিলমিল
পলকে মিলায়ে যায়)! চকিতে জাগায়ে চারিধার
অঝোর বর্ষার ধারা শুভ্র, স্বচ্ছ ঢালে মিকাইল;

ধরণীর তপ্ত গণ্ডে নেমে আসে স্নিগ্ধ বারিধার;
জীবনের বার্তা নিয়ে এল বর্ষা-বিহ্বল আষাঢ়।।

দুই
প্রখর গ্রীষ্মের শেষে এল বর্ষা, বাদল হাওয়ায়
দিক-প্রান্তে অপরূপ ছায়া দেখে কাজল মেঘের
একাকী প্রতীক্ষমানা কাননে কেতকী শিহরায়।

তপ্ত যৌবনের সাকী, দিন শেষ গুলমোহরের,
বর্ণের প্রাচুর্য নিয়ে যায় সে দৃষ্টির অন্তরালে;
কিংবা কো’কাফের পরী- পলাতক-সুদূর দেশের।

ক্ষণিকের প্রগল্ভতা ওঠে জেগে কদম্বের ডালে;
সবুজে শ্যামলে হয় বিনিময় বিমুগ্ধ দৃষ্টির,
প্রাণের ইশারা জাগে বনপ্রান্তে নিভৃত তমালে।

মত্ত বর্ষণের দিনে দেখি তাই অজস্র বৃষ্টির
অফুরন্ত সমারোহে জেগে ওঠে নদী, মাঠ, বন;
সমস্ত প্রকৃতি যেন গায় গান নতুন সৃষ্টির,

রৌদ্রদগ্ধ এ পৃথিবী পায় খুঁজে নতুন জীবন;
অঝোর বর্ষার সুরে পৃথিবীর হয় উজ্জীবন।।

তিন
বর্ষায় জীবন্ত নদী মধুমতী মুক্ত কলেল্লাসে
ব’য়ে যায় অবিশ্রাম, থামে না সে মুহুর্তের তরে,
বুকে তার পাল তুলে জেলে ডিঙি- শখচিল ভাসে,

ছড়ায়ে প্রাণের স্পর্শ দুই পাশে সবুজ প্রান্তরে
প্রমত্ত সে গতিবেগে ধায় নদী,- উদ্দাম আবেগে
আবে হায়াতের ধারা যায় যেন উমুখ সাগরে।

সে প্রবল গতিস্রোতে আনন্দের বন্যা ওঠে জেগে,
প্রান্তরের ধমনীতে ওঠে জেগে উদ্দাম যৌবন,
প্রাণের বিদ্যুৎ যেন চায় মৃত্যুম্লান মেঘে!

সবুজে শ্যামলে তাই উচ্ছসিত মাঠ, ঘন বন
নদীর প্রবাহ থেকে পায় পূর্ণ প্রাণের জোয়ার,
অথবা এ জিন্দেগানি পেয়ে তার মুক্তির স্পন্দন

সকল জড়তা ভূলে হয় তীব্র গতিতে দুর্বার,
মুহুর্তে এ নদী হয় সময়ের স্রোত খরধার।।

চার
দুরন্ত, চঞ্চল নদী প্রাণবন্ত, পাহাড়ের ঢালে
কুলে কুলে পরিপূর্ণ, পরিপূর্ণ কানায় কানায়
অবাধ, উদ্দাম গতি দূর দিগন্তের পথে চলে;
নিশান্তের তীরে এসে বিহঙ্গম উন্মুক্ত ডানায়
জীবনের আমন্ত্রণে ভেসে যায় আকাশে যেমন
এ জীবন্ত নদী চলে তেমনি সিন্ধুর ঠিকানায়।

প্রদীপ্ত উল্লাসে তার অতিক্রম করি’ মাঠ, বন,
ভাসায়ে জড়তা, ক্লেদ;- পুঞ্জীভূত কদর্য, কলুষ,
প্রচণ্ড আঘাতে ভেঙে সব বাধা, সকল বন্ধন

জাগ্রত নদীর সত্তা বয়ে চলে গতি নিরঙ্কুশ;
কিংবা সমুদ্রের ডাকে পরিপূর্ণ, জীবন্ত এ নদী
প্রাণের ঐশ্বর্যে পূর্ণ চলে মুক্ত, চলে নিষ্কলুষ!

দুনির্বার গতিস্রোতে যাত্রাপথে নেমে আসে যদি
বন্যা বিপ্লবের রূপে দেখা দেবে দিগন্ত অবধি।।

পাঁচ
যদি পথে বাধা পায় প্রমত্ত এ নদী দুর্নিবার
প্রলয়ের রূপ নিয়ে দেখা দেবে জানি সে নিমেষে,
ধ্বংসের আহ্বান শুধু উচ্চারিত হবে কণ্ঠে তার,
ধ্বংস করি’ জনপদ;- মাঠ, বন ডোবায়ে নিঃশেষে
সর্বনাশা রূপ নেবে পাবে না সে মুক্তি যত দিন
(কেননা রহস্য গাথা জীবনের মূর্ত হয় শেষে

অবিচ্ছিন্ন গতি ছন্দে- কালের আর্শিতে অমলিন!
হারালে সে গতিবেগ ছায়াচ্ছন্ন কিংবা মৃত্যুম্লান
মরণের বালুচরে লুপ্ত হয়; হয় সে বিলীন)।

রুদ্ধগতি জীবনের দিয়ে তাই নতুন আহ্বান
ভোলায়ে মৃত্যু বা সুপ্তি,- স্বপ্নালস রাত্রির আরাম,
বিশ্রান্ত যাত্রীর প্রাণে তুলে তাই সমুদ্রের গান

এ বর্ষার নদী চলে (জিন্দেগানি পায় তার দাম
মঞ্জিলের মধ্যপথে চায় না যে নিষ্ক্রিয় বিশ্রাম)।।