দরিয়ায় শেষ রাত্রি

রাত্রে ঝড় উঠিয়াছিল; সুবেসাদিকের স্নান রোশ্‌নিতে সমুদ্রের
বুক এখন শান্ত। কয়েকজন বিমর্ষ মাল্লা সিন্দবাদকে
ঘিরিয়া জাহাজের পাটাতনে আসিয়া দাঁড়াইল।

১ম মাল্লা
কাল রাত জেগে আওয়াজ পেয়েছ’ কোনো?
জিঞ্জির আর দাঁড় উঠেছিল দুলে!

২য় মাল্লা
বুঝি সী-মোরগ সাথীহারা তার দরিয়ার শেষ রাতে
ঝড় বুকে পুরে বসেছিল মাস্তুলে!

৩য় মাল্লা
যেন সুলেমান নবীর শিকলে বন্দী বিশাল জিন
ছাতি চাপড়ায়ে কেঁদেছিল কাল সারারাত…সারারাত,
পাল মুড়ি দিয়ে পাটাতনে শুয়ে শুনেছি কান্না
সেই সমস্ত গায় লেগেছিল তার হতাশার কশাঘাত,
বন্দী সে জিন কেঁদেছিল বুঝি দূর ও’তানের তরে
কাল রাতে তার আওয়াজ শুনেছি দরিয়ার হাহাস্বরে;
সেই সাথে সাথে আমার মনেও জেগেছিল আহাজারি,
ছুটেছিল যেথা জিন্দিগী মোর বাগদাদ বন্দরে।

৪র্থ মাল্লা
দজ্লার পাশে খিমার দুয়ারে হাসিন জওয়ানি নিয়ে
যেখানে আমার জীবনের খা’ব মন ছুটেছিল সেথা,
কাফেলার বাঁশী ব’য়ে এনেছিল জহরের মত ব্যথা!
কলিজার সেই রুদ্ধ বেদনা শুনেছি ঝড়ের স্বরে।

৫ম মাল্লা
বুক চেপে ধরে কাল সেই ঝড়ে পাটাতনে পেতে কান
শুনেছি সুদূর আঞ্জির শাখে টাঙানো দোলার গান,
দুধের বাচ্চা কেঁদে উঠেঠিল আমার বুকের ‘পরে,
শুনেছি আমি সে-শিশুর কান্না কাল রাত্রির ঝড়ে।
সাত সফরের সাথী তুমি জান পাথরে গড়া এ মুঠি,
বেদনা-নিসাড় দোলনার সুরে প’ড়েছিল পাশে লুটি
বেহুঁশ হালতে খুঁজেছি আঁধারে দুখানা কোমল ডানা
কিশ্তির মুখ ঘোরাও এবার শুনব না আর মানা।
সিন্দবাদ
শুনতে কি পাও দূর ও’তানের টান?
মাঝি মাল্লার দল!
দরিয়ার বুকে শেষ হ’ল সন্ধান?
ডাকছে খাকের গভীর স্নেহ অটল?

৬ষ্ঠ মাল্লা
কাল মাস্তুলে ঝড়ের কান্না শুনেছি একলা জেগে,
শুনেছি কান্না রাত জেগে দূর মরুভূর কূলে কূলে,
বাদামের খোসা এসেছিল এক ভেসে তুফানে বেগে,
আমার বুকের সকল পর্দা উঠেছিল দুলে দুলে,
এসেছিল এক সী-মোরগ তার চঞ্চুতে মাটি ব’য়ে।
আমার আতশী রগের রক্ত গ’লেছিল আঁসু হ’য়ে-
দুলে উঠেছিল আবছা আলোয় দরিয়ার নোনা পানি,
নাড়ী-ছেঁড়া ব্যথা মউজের মুখে জেগেছিল কাতরানি;
শুনেছি আমার পুরানো মাটির টান-
তারার চেরাগে ক’রেছি আমার দিগন্ত সন্ধান।

৭ম মাল্লা
ডাকে বাগদাদী খেজুর শাখায় শুক্লা রাতের চাঁদ,
মাহ্গির বুঝি দজলার বুকে ফেলে জ্যোছনার জাল,
কোমল কুয়াশা স্নেহে যেথা মাটি পেতেছে নতুন ফাঁদ;
ঘরে ফেরবার সময় হয়েছে আজ।

সিন্দবাদ
নতুন দ্বীপের পত্তনি নিয়ে পেতেছি সেখানে খিমা,
জরিপ ক’রেছি সাত সাগরের সীমা;
ঝড়ের ঝাপটা কাটায়ে এসেছি পাড়ি দিয়ে টাইফুন,
রূহা দ্বীপে নেমে শুকায়েছি মোরা আহত গায়ের ঘুণ…;
পার হয়ে কত এসেছি নিরালা দরিয়ার বিভীষিকা
মাস্তুলে ফিরে জ্বালায়েছি দেখ নয়া সফরের শিখা…

১ম মাল্লা
আজ বাগদাদ ডাকে কোথা বহু দূরে!
যাব স্রোত ফুঁড়ে যাব সব বাঁক ঘুরে
হাতীর হাড়ের সওদা নিয়েছি, নিয়েছি কাবাব-চিনি,
আল্মাস আর গওহর দিয়ে বেসাতি ক’রেছি পুরা,
শেষ ক’রেছি এ পিপুল, মরিচ, এলাচের বিকি-কিনি;
কিশ্তির মুখ ঘেরাও এবার দরিয়ার বন্ধুরা।

সিন্দবাদ
ভীরু কমজোর…

২য় মাল্লা
ভয় পাই নাকো, কমজোর নই মোরা।
হালের মুঠির মত আমাদের কব্জা, সিন্দবাদ!
দরিয়ার মত দারাজ সিনায় আজ নামে পেরেশানি;
এড়াতে পারি না- ঐ শোনো ডাকে বহুদূরে বাগদাদ…

৩য় মাল্লা
মোরা মুস্লিম দরিয়ার মাঝি মওতের নাই ভয়,
খিজিরের সাথে পেয়েছি আমরা দরিয়ার বাদশাই,
খাকে গড়া এই ওজুদের মাঝে নিত্য জাগায় সাড়া
বাগদাদী মাটি; কিশ্তীর মুখ এবার ঘোরাও ভাই!

সিন্দবাদ
কাল ঝোড়ো রাতে দাঁড়ের আঘাতে দামী জেওরের মত
হীরা জওহর ফুটেছিল কত দরিয়ার নীল ছাঁচে,
সফরের মায়া টাছে আমাকে দূর হ’তে আরো দূরে-
নোনা দরিয়ার আকাশ আমার জাগছে বুকের কাছে;
আল্লার এই অশেষ আলমে অফুরান রূপ, রস
জমে গাঢ় হ’য়ে দূর সফরের আশা যেন হীরাকষ-

৪র্থ মাল্লা
দরিয়া-সোঁতায় যুঝে হ’ল কত জিন্দিগী পয়মাল,
লোক্সান হ’ল হাজারো সে জান মাল,
পেরেশান তনু…

সিন্দবাদ
তবুও শ্রান্তিশেষে
বাগদাদ ফের নতুন সফর দেখবে আগামী কাল।

আহা ভুলে গেলে আকীকে গড়া এ দরিয়া নীল মহল,
নামে জিল্কদ রাতের শা’জোদী তের তবকের চাঁদ,
ভুলে গেলে তার সকল স্বপ্ন সাধ,
ভুলে গেলে তার সুদূর আশা সফল।

জাজিমের বুকে ছড়ানো পাথর দানা!
ডাক্ছে আবার তোমাদের সাথী মাল্লা সিন্দবাদ,
চলো ফুঁড়ে চলি আকাশের শামিয়ানা;
কালো মওতের মুখোমুখি হ’য়ে জংগী জোয়ান ফিরে
দরিয়া-সোঁতায় টেনে তুলি চললা তুফানের মাতামাতি।
ভুলে যেও না এ মাল্লার জিন্দিগী,
শুরু করো ফের নতুন সফর আজি,
দেখ, মাস্তুলে জ্বেলেছি নতুন বাতি,
মৌসুমী-হাওয়া পাল ভ’রে ওঠে বাজি।

৫ম মাল্লা
শুধু দু’ঘড়ির বিশ্রাম নেব পাতার খিমায় মোর,
ক’রব না হেলা মাটির গভীর টান।
আজ কত দূরে কোথায় সে বন্দর?
কোথায় আমার খেজুর-বীথির গান?

৬ষ্ঠ মাল্লা
বা’র দরিয়ায় পেয়েছি আমরা জীবনের তাজাঘ্রাণ-
পেয়েছি আমরা কিশ্তী-ভরানো জায়ফল, সন্দল;
দরিয়ার ঝড়ে আহত ক্ষণিক নিতে চাই বিশ্রাম;
মাটির মমতা বোঝে শুধু এক দরিয়ার মাঝিদল।

৭ম মাল্লা
ভাঙে দরিয়ার ঘূর্ণী তুফানে জীর্ণ প্রাচীন মন,
সবুজ ঘাসের শিয়রে বাতাস ব’য়ে যায় অনুখন
ভাঙে না, নিত্য গড়ে নেয় মন নতুন মাটির ঘর-
কিশ্তির মুখ খুঁজে ফেরে তার আশ্রয় বন্দর-

৮ম মাল্লা
হাজার আঘাত গায়ে টেনে তাই বেসাতি ক’রেছি পূরা।

সিন্দবাদ
কিশ্তির মুখ ঘোরাও এবার দরিয়ার বন্ধুরা।
(মাল্লার দল তুমুল কলরবে জাহাজের হালের দিকে ছুটিয়া গেল)

মাল্লাগণ সমস্বরে
কিশ্তির মুখ ঘোরাও এবার দরিয়ার বন্ধুরা…