ঝড়

এক
হে বন্য বৈশাখী ঝড়!- হে দুর্দম! জীবন-মৃত্যুর
হিংস্র পটভূমিকায় ভ্রাম্যমাণ, তুমি যাযাবর,
পাড়ি দিয়ে যেতে চাও মহা বিশ্ব, দূরান্ত সুদূর!…

জন্মের মুহূর্ত থেকে ছেড়ে তাই পরিচিত ঘর
দৈত্যের তাঞ্জামে চল শঙ্কাহীন তুমি দুর্নিবার,
ছড়ায়ে দক্ষিণে বামে উল্লসিত মেঘের কেশর

ঘূর্ণাছন্দে টেনে তোল সিন্ধু-বক্ষে প্রবল জোয়ার
(পৃথিবীর দূর প্রান্তে উচ্চারিত হয় তাই নাম)!
প্রবল গতির মুখে খুলে ফেলে দিগন্তের দ্বার

প্রমত্ত প্রাণের বেগে চল তুমি, চাও না বিশ্রাম!
তোমার উন্নত শির স্পর্শ করে আকাশ খিলান,
ক্রুদ্ধ, ভয়ংকর রূপ,- জানি তবু নয়নাভিরাম!

তোমার চলার তালে ওঠে ঘূর্ণি- প্রমত্ত তুফান;
হে বন্য বৈশাখী ঝড় চল নিয়ে ধ্বংসের আঁহ্বান।

দুই
হে বন্য বৈশাখী ঝড়! গতিস্রোত প্রমত্ত ভয়াল
ধ্বংসের নেশায় মাতি, যৌবনের উল্লাসে নির্মম
পাড়ি দাও অনায়াসে ফেন-ক্ষুব্ধ সমুদ্র উত্তাল,
ডোবায়ে হাজার কিশ্তী, লক্ষ ডিঙি,- অরণ্যে দুর্গম
অতর্কিতে এসে তুমি হানা দাও দস্যু দুর্নিবার,
দুর্ভেদ্য প্রকার যেন ঘন বন করি অতিক্রম

মুহূর্তের মাঝে তুমি আদিগন্ত মাঠ হও পার!
দীপ্ত বিদ্যুতের ফণা চায় দিগন্তে সর্পিল;
তবু তুমি শঙ্কাহীন মৃত্যু মেঘে নির্ভীক সওয়ার

চলার নেশায় মত্ত ধ্বংস রসে আকণ্ঠ ফেনিল
দিক-চক্র পাড়ি দিয়ে কর নব দিগন্ত সন্ধান!
আকাশের ঝরোকায় সবিস্ময়ে দেখে জিব্রাইল

জাগায়ে প্রবল কণ্ঠে মৃত্যু আর মুক্তির আহ্বান
বজ্রের আগুনে দীপ্ত, ভয়ংকর চ’লেছে অম্লান।।

তিন
হে বন্য বৈশাখী ঝড়! হে উদ্দাম, নৃশংস, নিষ্ঠুর
বিশাল, বলিষ্ঠ সত্তা, আজীবন অভ্যস্ত সংগ্রামে
তোমাকে ঘিরিয়া জাগে জীবন-মৃত্যুর দুই সুর!

সাড়া জাগে যে মুহূর্তে চাও তুমি দক্ষিণে ও বামে,
সচকিত হয় মৃত্যু ধাও তুমি সম্মুখে যখন,
তোমার চলার তালে জীবনের ছন্দ ওঠে নামে

কিংবা সংঘর্ষের মুখে হয় তার নব রূপায়ণ
(শ্রান্তিহীন গতিবেগে জিন্দেগানী হয় না মলিন)।
গণ্ডীর বন্ধন-মুক্ত, শক্তিমান, প্রোজ্জ্বল জীবন

উন্মুক্ত সড়কে দেখে প্রতিরোধ- সংঘাতের দিন
দ্রুত হ’তে দ্রুততর, দুততম গতিতে প্রবল,
প্রচণ্ড আঘাত হানি দুর্নিবার শক্তিতে শাহীন

উড়ে যাও দূরান্তরে কঁপায়ে আকাশ, জলস্থল;
হে বন্য বৈশাখী ঝড়! মুক্তপক্ষ বিহঙ্গ প্রোজ্জ্বল।।

চার
হে বন্য বৈশাখী ঝড়! ধাবমান,- আল্লার আলমে
ক্ষুধিত বাঘের মত অতিক্রম করে যাও পথ,
শংকিত প্রান্তর কঁপে হে দুর্ধর্ষ তোমার বিক্রমে।

তোমার গর্জনে জাগে জনপদ, অরণ্য, পর্বত;
সুবিশাল বনস্পতি প’ড়ে যায় পথে মুখ গুঁজে,
সুদূরের পথযাত্রী মুসাফির হারায় হিম্মৎ;

বিধ্বস্ত বাসনা যত ঝরা পাতা মরে পথ খুঁজে!
উৎক্ষিপ্ত ধূলায়, মেঘে মালেকুল মৌত আজরাইল
বিদ্যৎ চাবুক হানে মুহুর্মুহু নীলার গম্বুজে!

কম্পমান এ পৃথিবী, লুপ্ত হয় তারার মিছিল
অচেনা জগৎ প্রান্তে হানা দাও সন্ধ্যায় যখন,
তোমার প্রবল কন্ঠ গর্জে যেন সূরে ইস্রাফিল,

শংকিত এ পৃথিবীতে কাঁপে যত সংশয়িত মন;
মৃত্যুর সম্মুখে কাঁপে কলুষিত, কদর্য জীবন।।

পাঁচ
রুদ্ধ গতি যে জীবন ক্লেদলিপ্ত জড়তায়, পাপে,
কলঙ্কিত যে জীবন আত্মরতিমগ্ন- পাঁকে ডোবে,
অবিশ্বাসী যে জীবন স্বস্তিহীন সংশয়ের তাপে,

হতাশ্বাস যে জীবন আত্মঘাতী ব্যর্থতার ক্ষোভে,
লক্ষ্যভ্রষ্ট যে জীবন পৈশাচিক বিকৃতিক নীড়ে,
অভিশপ্ত যে জীবন সর্বগ্রাসী পাশবিক লোভে,

কলুষিত সে জীবনে হে দুর্বার আস তুমি ফিরে,
হানা দাও সে জীবনে হে বৈশাখী ঝড় বজ্রবেগে,
প্রবল ধ্বংসের রোল তোল সেই জিন্দেগানী ঘিরে,

জাগায়ে মৃত্যুর সাড়া অন্ধকার প্রলয়ের মেঘে
চকিতে জাগায়ে বিশ্ব- মৃত্যুভীত দুনিয়া জাহান
উন্মত্ত নেশায় তুমি দেখা দাও উদ্দাম আবেগে,

আত্মবঞ্চনার কিংবা বিকৃতির করি অবসান
হে বন্য বৈশাখী ঝড়! দাও তুমি সংগ্রামী আহ্বান।।

ছয়
তুমি বিপ্লবের দূত,- জীর্ণ প্রথা গতানুগতিক
ধ্বংস করি পৃথিবীকে জানাও সৃষ্টির সমাচার,
মুহুর্তের মাঝে আনো জীবনের ধারা বৈপ্লবিক;
তোমার চলার তালে শেষ হয় রুগ্ন জড়তার!

পরমুখাপেক্ষী, ভীরু, গলগ্রহ, অনুকারী প্রাণ
সংগ্রামী, স্বাধীনচেতা হয় বজ্রনির্ঘোষে তোমার,

ব্যাধিগ্রস্ত মানসের ঘটায়ে নির্মম অবসান
বিপ্লবী সে শুরু করে জীবনের অধ্যায় নূতন,
উষর মরুর বক্ষে জাগায়ে ঝর্ণার কলতান

প্রাণৈশ্বর্যে গ’ড়ে তোলে দুনিয়ার জান্নাত কানন।
মুক্ত জীবনের খেলা মরণের পটভূমিকায়
ঘুমন্ত শক্তির উৎসে ঘটায় সুতীব্র বিস্ফোরণ,

কালের আর্শিতে আমি ক্ষণদীপ্ত বিদ্যুৎ ছটায়
বিপ্লবের সেই রূপ দেখি চেয়ে উদ্দাম ঝঞ্ঝায়।।

সাত
মুমূর্ষু এ জিন্দেগানী করে তাই প্রতীক্ষা তোমার,
চৈত্রের ফাটল ধরা মাঠ চায় মেঘের আভাস,
তাইতো ঝড়ের পথে পৃথিবীর এই ইন্তেজার,

তাপদগ্ধ দিনে স’য়ে ব্যর্থতার তিক্ত পরিহাস
হাভিয়ার জ্বালা বুকে এ পৃথিবী-আঁখি নিষ্পলক
তপ্ত বক্ষে চায় ফের সবুজের কোমল আশ্বাস।

যত ওঠে তীব্র ঝড়, জাগে যত বিদ্যুৎ ঝলক
একান্তে প্রতীক্ষমাণা পৃথ্বি তত মুখ তুলে চায়,
ব্যগ্র দৃষ্টি মেলে তার খুঁজে ফেরে মেঘের অলক!

প্রতীক্ষিত ক্ষণে আসে শিলাবৃষ্টি দুরন্ত ঝঞ্ঝায়,
বৈশাখীর ধ্বংসলীলা তারপর হয় অবসান,
প্রশান্তির বার্তা আনে মিকাইল অঝোর বর্ষায়…

চরম ধ্বংসের শেষে আসে নব সৃষ্টির আহ্বান,
তাইতো পরম কাম্য এ বিপ্লব;- এ ঝড়ের গান।।