ঝরোকা’য়

মুসাফির জনতার মৃদুশব্দ নিম্নমুখ নীল পেয়ালায়
মিশে গেল আকাশের স্তব্ধ ঝরোকায়।
সুর্মা পাহাড়ে লুপ্ত অগ্নিবর্ণ গুলরুখ শিখা।

অন্ধ পরিক্রমা-শ্রান্ত সে তীব্র দাহিকা
স্মৃতি শুধু দূর বনান্তের।
শিরিষের
শাখা ছেড়ে আরো দূরে রজনীগন্ধার,
হেনার;
কিংবা বাগদাদের
হাজার রাত্রির এক রাত এল নেমে।

হে প্রিয়া শাহেরজাদী! তুমি আজ কী অজ্ঞাত প্রেমে
জেগে ওঠো শঙ্কায়, লজ্জায়?
তোমার সকল প্রেম আবার লুকাতে চায়
নেকাব-প্রচ্ছায়?

বৃথা বাজে রিনি ঝিনি
হীরার জেওর!
হে ছলনাময়ী! অন্ধ পুরুষের, পৌরুষের কেড়ে নাও
শ্রান্ত ঘুমঘোর,
ছড়াও পরাগ রক্তধারা
জাফরানের মধু-গন্ধ ভরা।

রাত্রি আজ গাঢ় ঘন! মন
দক্ষিণ হাওয়ায় ভেসে মুসাফির উজানী-পবন,
গন্ধ খুঁজে ফেরে।

আকাশেরে করিয়া চৌচির
তার কান্না লুটে পড়ে
উত্তর সাগর তীরে দক্ষিণের সামুদ্রিক ঝড়ে,
সন্ধান করে সে ইতস্তত
নীড় তার শ্রাবণের পাখিদের মত।

গন্ধ আসে দূরান্তর হ’তে
হে প্রিয়! ভেসেছি আমি দীর্ঘ নওবাহারের ঘন নীল স্রোতে,
তখন তোমার
ও-সুরভি ভার
স্পর্শ করি গেছে বারে বারে;
প্রখর আতশী স্রোতে ভেসে আমি চাইনি তোমারে।

আজ আমি খুঁজে মরি
পাতায় পাতায়, ঘাসে ঘাসে,
পাই না তোমাকে। শুধু বহু দূর হ’তে গন্ধ আসে।
ভেসে যায় মাঠ, মন মুহূর্তের রক্তিম প্রশ্বাসে।
তারপর ক্ষণদীপ্ত সে প্রান্তরপারে
পাই না তোমারে।
আজ তার গন্ধ আসে, রাত্রির নিশ্বাসে তৃষাতুর হৃদয় আমার
জানি যে তোমারো, তাই আগে বহু আগে বারবার
লায়লির ইশারায় বুকে পুরে তারুণ্যের লেলিহান আগুন
সবুজ দিগন্ত তার পাড়ি দিয়ে চ’লে গেছে কবে মজনুন
ধূসর জগতে।
পরতে পরতে
এঁকে গেছে, রেখে গেছে তারা
ওয়েসিস বুকে নিয়ে হেসেছে সাহারা;

স্বপ্ন মরুভূর
হয়তো জ্বলন্ত তার ক্ষুব্ধ বুকে দীউয়ানা সে সুর
চলিষ্ণু জীবন-স্রোতে ভাসমান গতির প্রবাহ
মুছে নিয়ে গেছে তার আকাশের দাহ
দিয়ে গেছে প্রশান্তি নিঝুম
মরুভূর ঘুম …
তোমাকে সুন্দর করে সে আমার প্রেম
অন্দরের ঘ্রাণ,
দিন রাত্রি ঝ’রে ঝ’রে পড়ে
দীর্ঘ পদ্মনাল বেয়ে পাপড়ির পরে …
ভ’রে ওঠে মনের আকাশ দীর্ঘশ্বাস অপরাহ্ন বেলা
পাপড়ির দ্বার রুধি পদ্মের সুরভি কোথা চলেছে একেলা,
পিছে ফেলে পরিত্যক্ত পাপড়ির বাস,
ভেসে চ’লে মন, দূরে ভেসে চ’লে সুরভি প্রশ্বাস,
…জানিনা কোথায়-
ব’সে আছি অন্ধকারে নিশীথ-প্রচ্ছায়,
পাপড়ি যায় না দেখা, আজ শ্রান্ত ধমনীর আগ্নেয় উৎসব।
শুধু একা করি অনুভব
মার হারানো গন্ধ সুরভি-প্রশ্বাস,
মনের অলিন্দে শুধু দেখা দেয় তন্দ্রাতুর তোমার আকাশ!

মুগ্ধ মন আকুল সৌরভে
নাহি জানি ভুলেছে সে কবে
রজনীগন্ধার স্নিগ্ধ ভীরু বাতায়ন,
রুদ্ধ কারা দ্বার ভাঙি আজ সে করিছে দূরে কার অন্বেষণ!
নৈশ বাতাসের তীরে
আঁধারের বুকে চিরে
নেমে আসে ঘুম।
মনে হয় আকাশ কুসুম
তোমার সন্ধান।
তবু লাগে জোয়ারের টান,
সুপ্তির অতলে যেয়ে হানা দেয় জাগ্রত চেতনা,
কী অসহ্য বেদনায় লাগে বুকে সৌরভ-মূৰ্ছনা!
বন-চামেলির স্রোতে ভেসে যায় কোথায় সুদূরে
ভারাক্রান্ত তনু ছেড়ে মন আজ ফেরে ঘুরে ঘুরে-
দক্ষিণ বাতাসে
নিজেকে হারায়ে ফেলে ছুটে চ’লে ব্যাকুল আশ্বাসে।
প’ড়ে থাকে ধূলিমুঠি, প’ড়ে থাকে ভ্রান্ত অহংকার-
ব্যথাতুর হ’য়ে ওঠে সমগ্র চেতনা, সত্তা, মনের কিনার।
ধূলিতলে মিশে যায় রজনীগন্ধার- সুঠাম, সুগোল তনুতল,
ফোটায়ে বিশুভ্র দল, ঝরায়ে সুরভি অনর্গল
আরণ্য হেনার ঝড়ে সৌরভ মর্মরে-
ভুলে যেয়ে আবর্তের টান,
অন্তরের ঘ্রাণ,
পাপড়ির রূপ ছিঁড়ে খোঁজে সে গভীর মূলে সুরভি বিতান…

এখন
প্রশান্ত বাতাসে শুধু জাগিতেছে গুলেনার বন,
থেমে গেছে যত কথা, গান,
তোমার হারানো স্মৃতি নিয়ে এল এ আকাশ-ভরানো তুফান।
তোমাকে সুন্দর করে সে আমার প্রেম
অন্তরের ঘ্রাণ দিন রাত্রি ঝ’রে ঝ’রে প’ড়ে
পাপড়ির পরে,
মনের আকাশে
প্রশান্ত সুপ্তির মত ব্যথাভারাক্রান্ত তার গন্ধ ভেসে আসে।