কিস্‌সাখানির বাজার

[কিস্সাখানির বাজার! শুধু নামটাই নয়, এই বাজারের দীর্ঘ ইতিহাসও আমার কাছে রহস্যময় বলে মনে হয়েছে। এই ইতিহাস এক দিনের নয় দীর্ঘ দিনের। শতাব্দীর পর শতাব্দী কেটে গেছে, কিস্সাখানির বাজার দেশ-দেশান্তরের সওদাগর বিচিত্র পণ্য নিয়ে জমায়েৎ হ’য়েছে। সারাদিন চ’লেছে তাদের বেচা-কেনা, বিভিন্ন সওদার লেন-দেন। দিনান্তে শুরু হ’য়েছে কিস্সার আসর। মানুষের জীবন-মৃত্যুর মতই সে সব কাহিনী আশ্চর্য, রহস্যময়। শতাব্দীর পর শতাব্দী কিত্সাখানি বাজার বাঁচিয়ে রেখেছে তার এই ঐতিহ্য। কিস্সাখানির বাজারের এটাই বৈশিষ্ট্য।]

এ পৃথিবী পণ্যশালা,…এই কিস্সাখানির বাজার
এ-ও এক পণ্যশালা।…শেষহীন আলিফ লায়লার
অশেষ কাহিনী নিয়ে প’ড়ে আছে যুগ যুগান্তর,
মরু গিরি পাড়ি দিয়ে এসেছিল যত সওদাগর
চিত্রল, সোয়াত থেকে, তাতার বা খোরাসান থেকে
উটের সারির মত উপত্যকা পথে এঁকেবেঁকে
হিমেল হাওয়ার স্পর্শে কঠিন শীতের সাঁঝে যে ধারা মন্থর
তাদের কাহিনী যত জমে আছে এ-মাটির মাঠের উপর।

এখানে এনেছে সওদা- আঙুর, বেদানা, সেব, খোবানি, কিশ্মিশ্,
হিরার ধারের মত খঞ্জর, গালিচা আর ফুটন্ত নার্গিস!
কিন্তু যা বিস্ময়কর সে কেবল মানুষের বিচিত্র মিছিল
(পাহাড়ের পথ বেয়ে উঠে এল যারা খুলে রহস্যের নীল)!
শীতের হিমেল ভোরে বহু দলে, বহু দেশ থেকে
পাখীর ঝকের মত এল ওরা, এল একে একে
চিত্রল, সোয়াত থেকে; খোরাসান, বাদকশান থেকে
বরফ-জমানো পথে ক্ষণিকের পদচিহ্ন এঁকে
(যে নিশানা মুছে যাবে কঠিন তুষার ঝড়ে রাত্রির কিনারে)
তবু এল, তবু এল- এই কিস্সাখানির বাজারে।

এখন সুদীর্ঘ দিন দূর দেশী সওদাগর পথের দু’পাশে
ক্ষণিকের ডেরা তুলে করে যাবে লেন-দেন বিশ্বাসে অথবা অবিশ্বাসে,
তাকাবে সন্দিগ্ধ চোখে বেদুঈন তন্বী কোন নির্মম; সুন্দর!
পরিপাটি করে তবু সাজাবে পশরা দিয়ে দুদিনের এই খেলাঘর।
শেষ হলে বেচা-কেনা দিনশেষে শুরু হবে কিস্সার আসর;
জোব্বা-পোশ বৃদ্ধ কোন ব’লে যাবে রহস্যের অজানা খবর,
আশ্চর্য কাহিনী সেই, শেষহীন সে কাহিনী যার
কথক হারায়ে যায় কিন্তু কথা চলে বেশুমার।
অনেক শতাব্দী আর যুগান্তর পাড়ি দিয়ে চলে সে কাহিনী,
মিলনে, বিরহে, দ্বন্দ্বে, কামনায় কখনো বা বাজায়ে কিঙ্কিণী
মানুষের সে কাহিনী পাহাড়ী নদীর মত চলে অবিরত
আসে যায় যাত্রীদল; শুধু কথা জাগে অব্যাহত।
দূর-দূরান্তের কথা, দেশ-দেশান্তের কথা, সংখ্যাহীন হৃদয়ের কথা,
কথার কপোত ওড়ে পাখায় ছড়ায়ে তার রহস্যের নির্মম শুভ্রতা!
অনেক রাত্রির পর্দা খুলে যায় সেই সাথে বহু রহস্যের;
নেকাব তুলিয়া ধরে দূর দেশী সওদাগর অচেনা পথের।

(এখন যাবে না চেনা তাকে আর,- সারাদিনমান
যে ক’রেছে তেজারত খঞ্জর গালিচা নিয়ে ক্লান্ত বেমানান।
কিস্সার আসরে সেই প্রৌঢ় সওদাগর এক আশ্চর্য বিস্ময়,
দূরান্তের মুসাফির,- কাহিনীতে ফোটে যার স্বপ্ন বা সংশয়
যেন সে উন্মুক্ত আত্মা ডেকে যায় সারাক্ষণ অজানা কথাতে,
জীবনের অভিজ্ঞতা রহস্যের চাবিকাঠি যেন তার হাতে)!
ডেরা তাম্বু ছেড়ে এসে অবাক বিস্ময়ে শোনে শ্রোতারা নির্বাক,
মধ্য এশিয়ার পথে কখন হারানো যুগে উড়েছিলো পরী এক ঝাঁক,
কিংবা ইরানের পথে দিয়েছিল দেখা কবে মৃত্যু হানাদার!
নিপুণ জহুরী যেন গেঁথে যায় একে একে সেইসব কাহিনী মুক্তার।
চলে যায় এই ভাবে যুগ-যুগান্তর, বহু সওদাগর
বলে যায় এই একে লেন-দেন শেষ হ’লে পথের খবর,
অভিজ্ঞ সঞ্চয়ী কোন ব’লে যায় জীবনের শ্রেষ্ঠ অভিজ্ঞতা;
রাত্রি শেষ হ’য়ে গেলে বিস্মিত শ্রোতার প্রাণে জাগে স্বপ্ন অথবা ব্যর্থতা।
তারপর একদিন এ বাজার ভেঙে গেলে মৌসুমের শেষে
কাহিনী থামায়ে তার চলে যায় সওদাগর অচেনা বিদেশে!
আগামী মৌসুমে ফের হয়তো সে দেখা দেবে, হয়তো দেবে না
শেষ হ’লে জীবনের, বাজারের লেন-দেন কিংবা বেচা-কেনা।
হ’য়েছে এমন ঢের,..এ বাজার কাহিনী বলার
শুনেছে অনেক কষ্ট, দেখেছে সে অনেক শ্রোতার
বিস্মিত মুখের দীপ্তি; কিন্তু বহু মৌসুমের শেষে
সেই সব চেনা মুখ হারালো কোথায় কোন অচেনা বিদেশে।
নতুন অচেনা মুখে ভরে ওঠে তবু এই প্রাচীন প্রান্তর,
আবার অচেনা কষ্ঠে জমে ওঠে দিন শেষে কিস্সার আসর,

এ পৃথিবী পণ্যশালা,…এই কিস্সাখানির আসর।
এ পৃথিবী পণ্যশালা,…এই কিস্সাখানির বাজার
এ-ও এক পণ্যশালা,…শেষহীন আলিফ লায়লার
অশেষ কাহিনী নিয়ে প’ড়ে আছে যুগ-যুগান্তর!

মরু গিরি পাড়ি দিয়ে আসে যায় যত সওদাগর
তারাই সাজায়ে রাখে এ বাজার…দু’দিনের ঘর,
বলে যায় একে একে সেই সব সওদাগর অন্তহীন জীবনের কথা;
কথক হারায়ে গেলে নতুন কথক টানে কাহিনীর ধারাবাহিকতা।।