মধুমতীর তীরে

আকাশের মাঠ ঘিরে ঘিরে ঘন সূর্যাস্তের নলবন
তারি মাঝে ডুব দিয়ে পাখী চাঁদ দেখে আলোর স্বপন,
দিনের কুশ্রীতা ঝেড়ে ফেলে ওড়ে কোন শুভ্র রাজহাঁস
জ্যোছনা ভেজানো তনু তার নীচে ফেলে মাঠ, মরা ঘাস
উড়ে চলে আকাশের ধারে অন্তহীন নীলের কিনারে।

নলবনে জ্যোছনার বাঁশী ছড়ায় সুরের আস্তরণ
ঝিম হয়ে আসে সেই সুরে সকল আকাশ, নদী বন!
স্বচ্ছ নীর নদীর আরশি, মাটি ফেলে গভীর প্রশ্বাস
তারাভরা ছবি বুকে নিয়ে নদী হ’ল দ্বিতীয় আকাশ;
চাঁদ সেথা ডুবে ডুবে চলে বহুদূরে সমুদ্র অতলে।
জনতার কোলাহল নাই প্রশান্তির স্বপ্ন মধুমতী
দুই পাশে ধানক্ষেত রেখে অবিশ্রান্ত চলে সেই নদী
সূর্যাস্তের তোরণে যেখানে জ্বলে সন্ধ্যাতারকার টিপ
রাত্রির দুর্গম পথে পথে মহাকাশ জ্বালালো প্রদীপ
কর্কশ দিনের দাঁড়কাক যেথা এসে হল স্তব্ধ বাক্।

এখন এ নলবন শুধু রাত্রিচর পাখীদের পাড়া।
নিঃশব্দের সুবিপুল নীড়ে নেমে এল চাঁদের ইশারা,
স্তব্ধ নীল পটভূমিকায় রিক্ত সাকী সংগীতমুখর
সেই শুধু করিছে উতলা ব্যথা ক্ষুব্ধ ধরণীর ঘর- ;
বনতলে শূন্য করি বুক ডেকে ডেকে ফিরিছে ডাহুক।

তারাফুল ফোটানো সে কোন নলবনে গভীর মেঘের
ছায়াম্লান মাটির বাঁশরী সুর ভেসে চলে ডাহুকের,
সে বাঁশীর ঘন সুর-জালে মুগ্ধ মন, উতলা আকাশ
ভঙ্গুর মাটির দেহলিতে ক্রমাগত ফেলিছে নিশ্বাস;
নলবনে জমানো অশ্রুর ডাহুকের সুগভীর সুর।

সেই সুরে এ মাটি আকাশ কোথা দূরে চলে ভেসে ভেসে
পদতলে মেলে না ঠিকানা চলে কোন সুদূর্গম দেশে
সুদূরে, নিকটে, ঘনবনে- বন্ধুর, দুর্গম পথে ভয়ে
নিজেরে অচেনা ভাবি মনে জেগে ওঠে পরম বিস্ময়ে
পড়ে থাকে প্রান্তর আকাশ পাখা মেলে ওড়ে শাদা হাঁস।

দীর্ঘ তার মৃণালের মত কণ্ঠ বেয়ে স্বর ফেটে পড়ে
পাড়ি দিয়ে বহু জনপদ চলে কোন অচেনা গহ্বরে।
অপরিচয়ের নীড় পানে মেলেছে সে আলোকিত ডানা
ডাহুকের দূরচারী সুর অরণ্যের পায় না ঠিকানা;
ম্লান সন্ধ্যা; ছায়া পথ ধরে। চাঁদ নামে রাত্রির সাগরে।

তুমি যদি আজ কাছে আসো এই রাত্রে নাহি যাবে চেনা
গোধূলির পূর্ণ পরিচিতি ছায়া-ম্লান হল সে অচেনা,
আঁধারের এই যবনিকা পাখীদের করেছে আড়াল,
হয়তো সে মুহুর্তের নদী কিংবা সে দিগন্তহীন কাল
সমুদ্র ফিরিছে কাছে কাছে বহিতেছে আমাদের মাঝে।

গভীর মেঘের নলবনে শুক্লা দ্বিতীয়ার সাদা পাখী
ডুব দিয়ে তিমির অতলে সে বিহঙ্গ ঘুমায় একাকী
পরিত্যক্ত দিনের পালক ভেসে যায় শর্বরীর বানে
অন্তহীন ছায়া-পথ ধরে ফিরিছে সে অশ্রান্ত সন্ধানে;
এখন নিকটে যায় দেখা রাত্রির নিকষ তটরেখা।

তার কালো দীর্ঘ তরঙ্গের একটানা সুর ভেসে আসে,
সে অতল সমুদ্র গাহনে সারা মন সংকুচিত ত্রাসে,
জনতার মুখর সভায় খোঁজে ভীরু কথার আড়াল
অসংখ্য জোনাকি শিখা নিয়ে জ্বলে দূরে ছায়াচ্ছন্ন তাল
আর পাশে তমিস্রা প্রচ্ছায় রাত্রির তরঙ্গ বয়ে যায়।।