ওসমান গণি

অতল নৈঃশব্দ্যে ডুবে হে আকাশ! তুমি তো দেখেছ তন্দ্রাহীন,
উটের সারির মত দল বেঁধে ধূলিস্রোতে
মিশেছে অসংখ্য রাত্রিদিন,
মিশে গেছে সংখ্যাহীন মানুষের মৃত্তিকা মিছিল,
মিশে গেছে আকাশের বর্ণ বিভা- সফেদ, জরদ, লাল, নীল।
শুধু সেই খরস্রোতা ধূলিতলে প্রবালের সাধনা মিনার
সবুজ দ্বীপের স্বপ্নে তুলেছে বিজয়বার্তা তার।

প্রবালের সাধনায় যে মানুষ পেয়েছে পূর্ণতা,
এই ধূলিস্রোত মাঝে বেঁচে আছে শুধু তারি কথা,
অনির্বাণ সে সত্য অশনি;
: ওস্‌মান, ওস্‌মান গণি!

আরব আজমে আর
মদীনার আনীল আকাশ;
তায়েফের মাঠে, বনে, ঘাসে,
মানবের শিরদাঁড়া বেয়ে,
মানবীর তনু ছেয়ে,
অতল তিমিরে সুর তুলি;
জনতার অঙ্গে মিশে ধূলি হ’ল কত ম্লান ধূলি।
শুধু যে রূহানী লোকে পেল তার চরম পূর্ণতা,
মদীনার মুসাফির বলে যায় আজো যার কথা,
সেই সত্য,- ত্যাগের অশনি,
: ওসমান, ওসমান গণি।।

নবীজীর হাতে তার হাত রেখে পেল যে নির্ভয়;
যার ছায়াতলে বসি পথিক খুঁজিয়া পেল
জীবনের প্রশান্ত আশ্রয়;
শাহী বালাখানা তার উজাড় করিয়া নম্র ধীর
বিপুল সঞ্চয়ে বুক ভরি নিল সেই মুসাফির।

বসেরা গোলাব সেথা ফুটে ওঠে, ফেটে পড়ে রসাল আনার।
গুলমোহরের ছায়া, নার্গিস আনিছে বারবার
ঐশ্বর্যের পূর্ণ স্রোত পরিপূর্ণ সৌন্দর্যের দ্বারে।
শাহী বালাখানা যেথা উজাড় হ’য়েছে একাধারে;
ইয়াকুত, পোখরাজ, মরকত যেথা করে ভীড়
পূর্ণ ঐশ্বর্যের ভারে পূর্ণ হেথা বক্ষ ধরিত্রীর;-
নূরের তাজাল্লি সেথা যে অনন্ত জাগায় বিস্ময়
তার কাছে কোহিনূর,- কোহিনূর; জানি কিছু নয়।

তবু তূর পর্বতের সেই তরু,- তনু মৃত্তিকার
আবেগে আবেশে প্রেম করিতেছে ধূলায় বিস্তার।
তুমি কি এ ধূলিতলে সেই তরু? কিম্বা জয়তুন!
তোমার প্রেমের বুকে একী সত্য দুর্জয় আগুন!

সে প্রেম-অরুণ চিত্ত নেমে এল রক্তিম রঙিন,
মরু গোলাবের শিখা মধ্যদিনে হ’য়েছে বিলীন
তোমারি সে রক্তরাগে! মেলেছো কি পাপড়ি সোনার
মদীনা আকাশে? তব চিত্ততলে যে ঐশ্বর্যভার
স্তরে স্তরে র’য়েছে জমানো, আরক্তিম পূর্ণিমার
জাফরান সুরঞ্জিত তনুবর্ণ করিছে বিস্তার
অজ্ঞাত সুরভি! দেখ, আকাশ হ’য়েছে একাকার।
প্রেমিক বিহঙ্গ তুমি মহাবিশ্বে তুলেছ যে গান,
সেই সুরজালে আজো মোহমুগ্ধ আরব, ইরান।

মনে পড়ে: ধরণীর দুঃখ-দীর্ণ দুঃস্বপ্নের রাতে
প্রেমের পরম সত্য ব’য়েছিলে মরু সাহারাতে…
আঘাতে আঘাতে ভাঙে পাখা,
শ্বাস রোধ ক’রে মারে, রুদ্ধ ক’রে দিতে চায় ডাকা,
তবু তুমি ফেরো ডেকে ডেকে ..
চূর্ণ ক’রে দিতে চায় ওরা সেই সত্যের কলিকে …

তবুও ফোটালে ফুল, গেয়ে গেলে আলোকের সুর
ভারাক্রান্ত নৈরাশ্যের অন্তহীন শোণিত অশ্রুর
উপরে জাগালে দ্বীপ।
সে দিনের কাহিনী প্রাচীন
ধ্যান করে লুব্ধ মনে আজো এই ব্যথা-দীর্ণ দিন।

সত্যের পতাকা দেখ ওড়ে নভে বিপুল সম্মানে!
শাহী বালাখানা কা’র মুক্ত হ’ল অকৃপণ দানে?
ওগো শ্রেষ্ঠ ধনী!
সে তোমারি!
সে তোমারি!
ওস্‌মান গণি!!

মদীনার বালু বক্ষ দীর্ণ করি তোমারি সে দান
এল নিয়ে প্রাণ-ধারা, দূরচারী পথিকেরা আসে:
মরণ-সংকুল মাঠে স্বপ্ন দেখে নিশ্চিন্ত বিশ্বাসে।

সেই সত্য প্রতিষ্ঠার দিনে
বিশাল ভাণ্ডার তব ঈমানের পথ নিল চিনে।
করে গেলে সীমাহীন দান,
বিশাল বিশ্বের বুকে চিরস্থায়ী ক’রে গেলে
মানুষের বিপুল সম্মান!
হে শালীন। হে শরীফ। রক্ত বিনিময়ে তুমি
মানুষের দিলে মুক্তিপণ!
তোমার সম্প্রমে দেখ সচকিত নবীজীর মন!
জান্নাতী ফেরেশ্‌তা সেও লাজ-নম্র দেখিয়া তোমারে।
খোশ আমদেদ গাহে ওস্‌মানের পথের দু’ধারে।

কোরান একত্র করি রাখিল যে সত্যের সম্মান,
নিজের পরাণ দিয়ে রেখে গেল পিরাণের মান
সে সত্য-সাধক বীর সুঠাম সরল তার মন
নিষ্পাপ-প্রবাল-শুভ্র জানিত না হীন আক্রমণ;
সে উদার মানুষেরে দৃঢ়চিত্তে করেছে বিশ্বাস;
চিত্তের প্রশান্তি দিয়ে জুড়িয়াছে দীর্ণ বহির্বাস
ক্ষত আত্মা এ মানবতার। করেনি সে খেয়ানত
সমর্পিত তার হাতে নবীজীর পুণ্য আমানত।

সে উদার, সে মহান; সম্পদ বিলায়ে সর্বহারা!
তবু তার পুণ্য নামে অভিযোগ আনে আজ কারা?
তার সততায় আজ জ্ঞানপাপী করে কে সন্দেহ?
পর্বতবন্ধনমুক্ত দিকপাবী অন্তহীন স্নেহ
উর্বর করেছে যার এ মরু চিত্তের উষরতা
কোন্ অবিশ্বাসী দেয় তার নামে মিথ্যার তিক্ততা?

যার অফুরন্ত দানে জনপদে বেড়েছে সুষমা,
জীবনের শেষ কড়ি প্রয়োজনে রাখেনি যে জমা,
বায়তুল মাল থেকে করেনি যে ব্যয় কপর্দক;
কুৎসা গাহে তার নামে আজ কোন্ হীন প্রবঞ্চক?

ভালোবাসিয়াছে তার- আকাশ উদার শুভ্র মন,-
তার মুক্ত নভে ছিল প্রতি সিতারার আমন্ত্রণ।
সবারে বেসেছে ভালো,- করেনি সে স্বজন তোষণ;
উম্মুক্ত প্রাঙ্গণে তার ছিল না সঙ্কীর্ণ আবরণ;
রাষ্ট্রের ক্ষমতা, অর্থ লুব্ধ কভু করে নাই যারে;
মিথ্যা তোষণের কুৎসা মিথ্যাভাষী দেয় আজ তারে!

অদম্য! অনমনীয়! বৃথা তারে দেয় অপবাদ
ভীরুতার! সংগ্রামী সে মুজাহিদ- অশ্রান্ত জেহাদ
চালায়েছে অন্তহীন সত্যের বিজয় অভিযানে
দিক হ’তে দিগন্তরে, দূর হ’তে দূরান্তর পানে,
উদ্ধত পাশব গর্ব পাদপিষ্ট ক’রেছে হেলায়
সে নির্ভীক মুজাহিদ! দেখ চেয়ে লুটায় ধুলায়
উদ্ধত ‘রোমের’ গর্ব! দেখ চেয়ে বিস্তৃতি রাষ্ট্রের!
খিলাফতে নবুবীর অধিনেতা, মুক্ত মানবের
খলিফা নিষ্কম্পচিত্ত।

তবু অন্তহীন
প্রেমের সমুদ্র মাঝে চিত্ত তার নিয়ত বিলীন!
মুক্তিকামী খলিফা সে, মৃত্যুকামী নহে সে ভ্রাতার
নিতে সে পারে না খুন, দিতে পারে প্রাণ রক্ত তার!
বন্ধুর ঈমানে তার কোনদিন নাই অবিশ্বাস!

তারি বক্ষচ্ছায়ে বসি সাপেরা ফেলেছে কৃষ্ণ শ্বাস!
পিছু থেকে গুপ্ত ছুরি চালয়েছে যবে ‘মারোআন’
দ্বীনের খাদিম সেই গাথিতেছে একত্রে কোরান
গড়িছে সত্যের ইমারত!
আততায়ী বেছে নিল তার গুপ্ত পথ,
পড়িল খঞ্জর কণ্ঠ চুমে!
ঘনায়িত তমিস্রা তুহিন
সে সত্য-সাধক বীর ঢলিয়া পড়িল মৃত্যুঘুমে
নিষাদের গুপ্ততীরে বিশাল বিহঙ্গ সেই
ঢলিয়া পড়িল মৃত্যুঘুমে!
রেখে গেল শুধু তার দিগন্ত-প্রসার স্মৃতিজাল,
রেখে গেল মর্যাদা বিশাল।

কতকাল
ধূলির দরিয়া মাঝে অগণ্য যাত্রীরা হ’ল ধূলি
(আমরা ধূলির কীট, মোদের শিয়রে সেই
কালস্রোত তুলেছে অঙ্গুলি)
শুধু সেই মৃত্যুস্রোতে প্রবাল মিনারে দ্বীপ ঘোষে তার জয়
মানুষের ব্যুহ মাঝে ওঠে তার কথা:
সে পেয়েছে পরম পূর্ণতা;
দীপ্তবিভা সত্যের অশনি
ওস্‌মান! ওস্‌মান গণি।।