পদ্মা

এক
হে পদ্মা, প্রমত্ত নদী! হিমাদ্রির দুরন্ত সন্তান
কাটায়ে শৈশব তুমি সুদুর্গম পার্বত্য উপলে
উত্তপ্ত নিদাঘে কবে শুনেছ প্রাণের কলতান,

তোমাকে ডেকেছে সাথে শত ঝর্ণাধারা, খেলাচ্ছলে
শত কণ্ঠে গান গেয়ে এক সাথে নিঝ’রের গীতে
পর্বত শিখর ছেড়ে নেমেছ একদা সমতলে!

অপূর্ব নৃত্যের ছন্দে লীলায়িত মধুর ভঙ্গীতে
শৈশবের দিন শেষে মিশে গেছে বিমুগ্ধ কৈশোরে!
তরঙ্গ দোলায় দুলে প্রাণোচ্ছল পথের সঙ্গীতে

নিজেকে চিনেছ তুমি (পৃথিবী যখন ঘুমঘোরে)
চিনেছ নিজের সত্তা, জেনেছ কোথায় সংগোপন
প্রাণের রহস্য গাথা যৌবনের পরিপূর্ণ ভোরে,

জেনেছ সে দিন কেন বিশ্বে এই গতির স্পন্দন
হে পদ্মা,- প্রমত্ত নদী! স্রষ্টার শক্তির নিদর্শন।।

দুই
হে পদ্মা, প্রমত্ত নদী!- তোমার যৌবন খরধার
পথের সকল বাধা গেছে কেটে আদিম উল্লাসে,
উজ্জ্বল, কঠোর দীপ্তি (সময়ের তীক্ষ্ণ তলোয়ার
আশ্চর্য বিভায় দীপ্ত, কিংবা পূর্ণ আরণ্য উচ্ছাসে

অপরূপ মৃত্যু যেন), তবু তার প্রাণের আহ্বান
দেখি এই রুক্ষ মাঠে পৃথিবীর প্রান্তরে ও ঘাসে

(উচ্ছল যৌবন দিনে কোথায় ঝর্ণার কলতান)!
উজ্জ্বল আলোকে দিয়ে জীবনের বিপুল আঞ্জাম
উত্তাল তরঙ্গভঙ্গে গেয়ে দূর সমুদ্রের গান

ভাসায়ে সকল বাধা গতিস্রোত উদ্ধত, উদ্দাম
বর্ষায় দু’কূল প্লাবি’ নেমেছে যখন সমতলে;
দুরন্ত চলার তালে মধ্যপথে চাওনি বিশ্রাম,

এনেছ জীবন বন্যা সংকীর্ণ এ আবদ্ধ পল্বলে;
নয়া জিন্দেগীর সাড়া জাগায়েছ তুমি জলেস্থলে।।

তিন
হে পদ্মা, প্রমত্ত নদী!- মানুষের কীর্তি ক্ষণিকের
তোমার পথের বাধা গেছে মিটে স্রোতের দাপটে,
স্মৃতিচিহ্ন, রংমহল গেছে মিশে দপী ধনিকের

(বর্ণ বা রেখার চিহ্ন নাই আর শূন্য চিত্রপটে)!
অকস্মাৎ মনে হয় তরঙ্গিত মৃত্যু এ ধূসর
যখন উন্মত্ত ধারা ওঠে জেগে ঝড়ের ঝাপটে

কিংবা এ প্রবাহ তীব্র যেন এক হিংস্র অজগর
অন্ধ রোষে ধাবমান, স্রোতাবর্তে বিক্ষুব্ধ, ফেনিল
উপাড়িয়া তীর তরু, ইমারত কৃষাণের ঘর

প্রচণ্ড আক্রোশে আর ভয়াবহ গতিতে সর্পিল
চ’লেছে নিঃশেষে মুছে মানুষের উদ্ধত দুরাশা
(নির্বাক বিস্ময়ে শুধু দেখেছে তা আকাশের নীল

অথবা ভোরের পাখী আতঙ্কে যে ছেড়ে গেছে বাসা)!
তাইতো সন্ত্রস্ত প্রাণ রেখেছে এ নাম ‘কীর্তিনাশা’।।

চার
হে পদ্মা, প্রমত্ত নদী! এই ভাবে কত যুগান্তর
চলেছ বর্ষায় তুমি বন্যাবেগে প্রান্তর ভাসায়ে
সে কথা জানে না কেউ, কেউ তার রাখে না খবর।

কত মাঠ, জনপদ লুপ্ত হ’ল মৃত্যু হিমছায়ে
কিংবা কত নারী নর গেল ভেসে দুস্তর পাথারে
হে পদ্মা! তোমার তীরে ক্ষণিকের বাসর সাজায়ে

সে কথা জানে না কেউ জীবনের বিস্তৃত কান্তারে
(অথবা সে খোঁজ নিতে হয় নাই কারো প্রয়োজন)।
প্রমত্ত এ গতিস্রোতে মনে হয় তাই বারেবারে

সন্ধ্যার পাখীর মত স্নিগ্ধ নীড় চায় যে জীবন
বিড়ম্বিত হয় শুধু সংখ্যাহীন তরঙ্গ সংঘাতে,
সংগ্রামের ঝুঁকি নিয়ে যেতে হয় তাকে আমরণ

উচ্ছল আলোকে কিংবা ঝড়-ক্ষুব্ধ অন্ধকার রাতে
মৃত্যু ও মুক্তির পথে আনন্দে অথবা আশঙ্কাতে।

পাঁচ
অনেক ঘূর্ণিতে ঘুরে, পেয়ে ঢের সমুদ্রের স্বাদ,
জীবনের পথে পথে অভিজ্ঞতা কুড়ায়ে প্রচুর
কেঁপেছে তোমাকে দেখে জলদস্যু- দুরন্ত হার্মাদ,

তোমার তরঙ্গভঙ্গে বর্ণ তার হ’য়েছে পাণ্ডুর!
সংগ্রামী মানুষ তবু দুই তীরে চালায়ে লাঙল
কঠিন শ্রমের ফল- শস্য দানা পেয়েছে প্রচুর;

উর্বর তোমার চরে ফলায়েছে পর্যাপ্ত ফসল!
জীবন-মৃত্যুর দ্বন্দ্বে নিঃসংশয়, নির্ভীক জওয়ান
সবুজের সমারোহে জীবনের পেয়েছে সম্বল।

বর্ষায় তোমার স্রোতে গেছে ভেসে সাজানো বাগান,
অসংখ্য জীবন, আর জীবনের অজস্র সম্ভার,
হে নদী! জেগেছে তবু পরিপূর্ণ প্রাণের আহ্বান,

মৃত জড়তার বুকে খুলেছে মুক্তির স্বর্ণদ্বার
তোমার সুতীব্র গতি- তোমার প্রদীপ্ত স্রোতোধার৷।

ছয়
তোমার অস্তিত্ব নদী! অবিচ্ছিন্ন গতিতে প্রবল,
তরঙ্গিত জীবনের খরস্রোতে অস্তিত্ব তোমার,
তোমার অস্তিত্ব শুধু গতিমান প্রবাহে উচ্ছল,

তোমার অস্তিত্ব শুধু যতক্ষণ গতি দুর্নিবার,
জীবনের অভিযানে অগ্রগামী সত্তা যত দিন,
ত দিন দিয়ে যাও বন্যা বারি দুরন্ত, দুর্বার

তোমার জীবন্ত সত্তা তত দিন, জানি তত দিন
কালের পৃষ্ঠায় দীপ্ত, সমুজ্জ্বল তোমার স্বাক্ষর
হে পদ্মা; প্রমত্ত নদী প্রাণবন্ত, থাকে অমলিন।

যত দিন জড়তায় জাগে না মৃত্যুর বালুচর,
যত দিন গতিপথে যাও মুছে স্থিতি বা বিরাম,
যত দিন চল শুনে অন্তহীন সমুদ্রের স্বর

দিগন্তের পথে দেখি তত দিন লেখা তব নাম!
অবিশ্রান্ত চল তাই মুহূর্তের জানো না বিশ্রাম।।

সাত
তোমার স্রষ্টার কাছে (কুল মখ্লুকের যিনি রব)
হে নদী! তোমার মত আমারো প্রার্থনা রাত্রি দিন
সকল প্রান্তরে, পথে পাই যেন গতির বৈভব।

জীবন্ত প্রবাহ সেই দুর্নিবার,- বাধাবন্ধহীন
ভাসায়ে সকল ক্লেদ, পুঞ্জীভূত কদর্য কলুষ
মঞ্জিলের পথে যেন চলে স্বচ্ছ শুভ্র, অমলিন;

অথবা সে প্রাণধারা তীব্র গতিবেগে নিরঙ্কুশ
ভারগ্রস্ত জীবনের, জড়তার করি অবসান
জিন্দেগীর বিয়াবানে এনে দেয় মুক্তি নিষ্কলুষ

অচল; স্থাণুর বুকে গতিমান জীবনের গান
রিক্ত প্রাণ পৃথিবীতে দেয় যেন পুষ্পের সম্ভার;
আবদ্ধ জিন্দানে দিয়ে প্রাণোচ্ছল গতির আহ্বান

অস্তিত্বের আদি কথা খোলে যেন রহস্যের দ্বার
(হে পদ্মা, তোমার মত গতিবেগ দুরন্ত, দুর্বার)।।