পটভূমি

সাড়ে আটটার ট্রেন উগারিয়া গেল তার আহার্য রাতের:
উত্তপ্ত মস্তিষ্ক নিয়ে রাতজাগা মানুষের দল
পথের দু’ধার ঘেঁষে চলে যেন সরীসৃপ পাথর শীতল
আর চলে প্রাণহীন নাগরিক, নাগরিকাদের
উজ্জীবিত পাশবিকতার
নগ্নরূপ মৃত জনতার।

বিকট শব্দের মেঘ বিছায়েছে নগরীর আকাশে ধূসর
রঙ্চটা বিবর্ণ চাদর
ট্রাফিকের আর্তনাদে, ট্রামে, বাসে পথের পাথর
ম্লান হ’য়ে যায় যেন,
এমন সময়
পাহাড়ী কিশোর কণ্ঠে শোনা গেল ছাতা-সারানোর
শ্যেন-তীব্র স্বর।
মৃত অরণ্যের বুকে যেন কোন উদ্দাম, বলিষ্ঠ দাঁড়কাক
ডেকে গেল কর্কশ প্রবল শেষ ডাক।
শব্দ ওঠে ছাতা-সারানোর
নির্জীব রাত্রির ম্লান-স্বপ্ন তন্দ্রাঘোর।

ছুটে গেল সে আরণ্য বলিষ্ঠ শব্দের তাপে তালে তালে,
লাল দীঘি তীরে তীরে অচেনা ঝাউয়ের ডালে ডালে
রক্ত-রাঙা বিরাট মহালে
চাতালের ‘পর
তীক্ষ্ণ বল্লমের মত ছুটে যেয়ে লাগে সেই ছাতা-সারানোর
তীর তীব্র স্বর।
ভেসে যায় চোখের পলকে
ফুটপাত, কারখানা, যন্ত্রপীড়া এই বদ্ধ ঘর-
জীবন্ত উচ্ছল
প্রাণবন্ত জীবনের পাখার খবর,
নিবিড় আঙুরবন, বরফ-জমানো চূড়া, সুদৃঢ় পাথর।

বিদেশী সাইপ্রেস শাখে দৃঢ় পাহাড়ের ঘ্রাণ
দুর্গম পথের
অচেনা বন্ধুর জগতের,
সাথী তার পাথুরে বাদাম,
সেব নাশপাতি আর পেশী দৃঢ় হাত
তরুণীর কেশদাম, পাহাড়ের চূড়া-ঘেরা তারা-ভরা রাত।
সেখানে যে চাঁদ ওঠে
(কলুষিত বিকৃত দৃষ্টির
ব্যর্থতায় নহে অসুন্দর)
সূর্যের জাফরান নিয়ে যেখানে বাসায় ফেরে নীল কবুতর
পরিপূর্ণ নীড়ে,
অসংখ্য সেতারা জ্বলে ঘন নীলে, রাত্রিরে তিমিরে।
পাহাড়ের বিপুল স্তব্ধতা,
প্রাণবন্ত জীবনের চরম পূর্ণতা
আকাশের গাঢ় নীল চুঁয়ে পড়ে
আনারের ঘন রক্ত-পাপড়ির ‘পরে,
তরুণীর রক্তিম কপোলে
নরম বুকের রঙ ক্ষণে ক্ষণে রাঙা ঢেউ তোলে।
নিস্তব্ধ প্রগাঢ় শান্তি,
মাঠ, ঘন বন,
বলিষ্ঠ সুঠাম তনুমন
বুলবুল, সুরের প্লাবন…

জানি না সে কতদূরে পাহাড়ী বন্যায়, ঝড়ে ভাসিতেছে সাতরঙা কুচি
ভাঙা আনারের দানা অনর্গল ঝরে পড়ে হিমেল হাওয়ার সাথে যুঝি
স্তূপীকৃত জমে ওঠে গালিচার একপাশে পেস্তার রঙিন পাথর
আঙুরবনের হাওয়া, পাহাড় পথের হাওয়া বয়ে আনে চাঁদের খবর-

যান্ত্রিক চাপের নীচে সে স্বপ্ন ভাঙিয়া পড়ে জানি না কখন,
আখরোট বন ছেড়ে দুঃস্বপ্নের মত জেগে ফাইলের বন;
এখানে সমস্ত দিন প্রবল বর্ষায় ভিজে পাহাড়ী কিশোর
শতাব্দীর ব্যর্থতায় রাজপথে ঘুরে ঘুরে ছাতা-সারানোর
তেলে তিক্ত সুর…