পুঁখির কাহিনী অবলম্বনে

[শাহ্ আযাদ বখ্তের স্বগতোক্তি]

‘আন্ধার ঘরেতে মোর নাহিক চেরাগ,
যে বাগানে মেওয়া নাই মিছা সেই বাগ।।
ছেতারা হইতে দেখ আছমানের খুবি,
পুত্ৰ নাই যার তার মিছা ধান্দা সবি।।’

‘আজব দুনিয়া, দেশ…কুস্তুনতুনিয়া; আর আমি
বাদশা এ দেশের; তাঁবেদার আছে আজও বেশুমার
দূর দেশী রাজা, খাজাঞ্চি-খানায় জমে রাজ্যকর,
জয়ের খবর আনে লোক লশকর…শাহী ফৌজ।
পথে নাই রাহাজানি, অনাবাদী মেলে না জমিন,
সকলে ইনসাফ পায়, শান্তি আছে প্রতি ঘরে ঘরে
ঈদুল ফিতর যেন বার মাস রয়েছে এখানে;
প্রতি রাত্রি এ দেশের রাত যেন শবে-বরাতের।

তবু শান্তিহীন প্রাণ, নিরানন্দ জীবন আমার
বর্ষ মাস, আমার আঁধার ঘরে জ্বলেনি চিরাগ;
অথবা সিতারাহীন অন্ধকার আকাশের মত
এ জীবন বঞ্চিত আলোকে। দেখি নাই পুত্র-মুখ
শোনেনি তৃষিত কান শিশুর কাকলি; পাই নাই
অনাস্বাদিত শান্তি কোন দিন ব্যর্থ জিন্দেগীতে।

মওতের পয়গাম এসে গেছে, দেখেছি সন্ধ্যায়
আর্শির মহলে কাল ক্ষণ-দীপ্ত বিদ্যুতের মত
কেশ-গুচ্ছ মাঝে এক শুভ্রকেশ তুষার-সফেদ
..বিজুলি চমক যেন ঘন কৃষ্ণ আবরের মাঝে
…মৃত্যুর স্বাক্ষর স্পষ্ট

সময় ফুরায়ে আসে; দিন
শেষ হয়ে আসে দ্রুত অস্পষ্ট ছায়ায়…অন্ধকারে।
চল্লিশ বসন্ত, বর্ষা মিশে গেছে দ্রুত পদক্ষেপে
বিস্মৃতির মাঝে; সম্মুখে এখন পথ অবরুদ্ধ
রাত্রির কিনারে। দিন শেষ হ’য়ে যাবে, অকস্মাৎ
হারাবে গোধূলি-স্বপ্ন এ প্রৌঢ় আকাশে। তারপর
জানি না কি ভাবে কবে শেষ হবে খেলা দু’দিনের।

কিন্তু তা দুঃখের নয়, জীবনের শেষ আছে জানি,
মৃত্যু যে অপরিহার্য এ কথা জেনেছি বহু আগে,
শুধু এক বেদনায় ব্যথা-দীর্ণ কাহিনী আমার
…জাগাবে না যে কখনো জীবনের নতুন অধ্যায়
শেষ প্রশ্বাসের সাথে শেষ হবে আশা ফসলের
কোন সম্ভাবনা আর রবে না এ শস্য-রিক্ত মাঠে।

অথচ দেখেছি আমি সুবিশাল পৃথিবীর বুকে
রেখে যায় সব প্রাণী জীবনের উত্তরাধিকার
সন্ততির মাঝে, রাখে জীবনের বীজ শস্যে, ফলে
মৌসুমের ফুল, রেখে যায় জীবনের গতিবেগ
সকল প্রবহমান নদী-স্রোত অফুরন্ত পথে।
কে যায় নিঃশেষে মুছে তার চেয়ে দুঃখী প্রাণী
আর কে রয়েছে দুনিয়া জাহানে? কে এমন দুঃখী প্রাণী
যে জানে অস্তিত্ব তার মুছে যাবে অচিরে নিঃশেষে?
আমি সে আযাদ বখ্ত বদ্নসীব স্বর্ণসিংহাসনে।

বুঝিনি কখনো আমি- কি লাভ এ নিষ্ফল জীবনে!
কি লাভ সে মরুমাঠে শস্যহীন পরিণতি যার?
কি লাভ সে জিন্দেগীতে পেল না যে তার ওয়ারিশান?
শস্য-রিক্ত মাঠ আর পুত্রহীন জীবন আমার
রেখেছে সাদৃশ্য এক পৃথিবীর বুকে শান্তিহীন।

কত সুখী সে কৃষাণ কর্মক্লান্ত প্রহরের শেষে
ভুলে যায় পেরেশানি যে সহজে পুত্র বুকে নিয়ে!
কত সুখী সে মজুর তুলে দেয় যে নিজের গ্রাস
ক্ষুধিত পুত্রের মুখে! কত সুখী সে রিক্ত ভিখারী
যে দেখে পুত্রের মুখ জান্নাতের শান্তি পায় মনে
পাতার কুটিরে সুখী দরখ্তের তলে!

আর আমি
দৌলৎ হাশমৎ ঘেরা তখ্তে কিংবা এ বালাখানায়
দুঃখ-ভারাক্রান্ত প্রাণ ফলহীন শূন্যতার তীরে।
সবচেয়ে দুর্ভাগা যে, যে মিসকিন সে-ও কোনদিন
নামেনি এ দীনতায় ব্যর্থতার সর্বনিম্ন স্তরে।

কত তন্দ্রাহারা রাত্রি জেগে আমি মসল্লার পরে
মুনাজাত করেছি তো বারিতা’লা আল্লার দরবারে:
দাও খোদা! ফরজন্দ…পুত্র দাও নিষ্ফল জীবনে-
অস্তিত্বের আলো দাও নৈরাশ্যের এ শূন্য প্রান্তরে,
রক্ষা করো বিলুপ্তির নিশ্চিত কঠিন ধ্বংস থেকে।
হয়নি মঞ্জুর দো’আ,…পরিপূর্ণ হয়নি প্রার্থনা।
জিন্দেগীর সূবে শাম মুছে যাবে এখন আমার
নাম ও নিশানাহীন অস্তপারে। পেয়েছি ইশারা
আর্শির মহলে কাল ক্ষণ-দীপ্ত বিদ্যুতের মত
মৃত্যুর স্বাক্ষর দেখেছি তো শুভ্র কেশদামে!
আর বুঝি আশা নাই স্বপ্নশেষ দিগন্তের তীরে।

যে ঘরে চিরাগ নাই অন্ধকার সেই রংমহল,
যে বাগানে ফল নাই মিথ্যা সেই বাগিচার মায়া,
সিতারার দ্যুতি নিয়ে আস্মান হ’য়েছে উজ্জ্বল,
পুত্রহীন এ জীবন হ’ল তাই ব্যর্থতার ছায়া।
সব ছেড়ে যাব আজ শাহী তাজ কিংবা বালাখানা,
কি হবে সে জিন্দেগীতে কাল যার রবে না নিশানা।।