সাত সাগরের মাঝি

কত যে আঁধার পর্দা পারায়ে ভোর হ’ল জানি না তা।
নারঙ্গী বনে কাপছে সবুজ পাতা।
দুয়ারে তোমার সাত-সাগরের জোয়ার এনেছে ফেনা।
তবু জাগলে না? তবু তুমি জাগলে না?
সাত-সাগরের মাঝি চেয়ে দেখো দুয়ারে ডাকে জাহাজ,
অচল ছবি সে, তসৃবির যেন দাঁড়ায়ে রয়েছে আজ।
হালে পানি নাই, পাল তার ওড়ে নাকো,
হে নাবিক! তুমি মিনতি আমার রাখো:
তুমি উঠে এসো, তুমি উঠে এসো মাঝিমাল্লার দলে
দেখবে তোমার কিশ্তি আবার ভেসেছে সাগরজলে,
নীল দরিয়ায় যেন সে পূর্ণ চাঁদ,
মেঘ-তরঙ্গ কেটে কেটে চ’লে ভেঙে চ’লে সব বাধ।
তবে তুমি জাগো, কখন সকালে ঝ’রেছে হাস্নাহেনা
এখনো তোমার ঘুম ভাঙলো না? তবু তুমি জাগলে না?

দুয়ারে সাপের গর্জন শোন নাকি?
কত অসংখ্য ক্ষুধিতের সেথা ভিড়,
হে মাঝি! তোমার বেসাতি ছড়াও, শোনো;
নইলে যে সব ভেঙে হবে চৌচির।

তুমি দেখ্ছো না, এরা চলে কোন্ আলেয়ার পিছে পিছে
চলে ক্রমাগত পথ ছেড়ে আরো নীচে।
হে মাঝি! তোমার সেতারা নেভেনি এ-কথা জানো তো তুমি,
তোমার চাঁদনি রাতের স্বপ্ন দেখছে এ মরুভূমি,
দেখ জমা হ’ল লালা, রায়হান তোমার দিগন্তরে;
তবু কেন তুমি ভয় পাও, কেন কাঁপো অজ্ঞাত ডরে।

তোমার জাহাজ হয়েছে কি বানচাল?
মেঘ কি তোমার সেতারা করে আড়াল?
তাই কি অচল জাহাজের ভাঙা হাল,
তাই কি কাঁপছে সমুদ্রে ক্ষুধাতুর
বাতাসে ফাঁপানো তোমার ও ফাঁকা পাল?

জানি না, তবুও ডাক্ছি তোমাকে সাত দরিয়ার মাঝি,
প্রবালদ্বীপের নারিকেলশাখা বাতাসে উঠেছে বাজি।
এ ঘুমে তোমার মাঝি-মাল্লার ধৈর্য নাইকো আর,
সাত সমুদ্র নীল আক্রোশে তোলে বিষ ফেনভার,
এদিকে অচেনা যাত্রী চলেছে আকাশের পথ ধ’রে
নারঙ্গী বনে কাঁপছে সবুজ পাতা।
বেসাতী তোমার পূর্ণ করে কে মারজানে মর্মরে?
ঘুম ঘোরে তুমি শুনছো কেবল দুঃস্বপ্নের গাথা।
উচ্ছৃখল রাত্রির আজো মেটেনি কি সব দেনা?
সকাল হ’য়েছে। তবু জাগলে না?
তবু তুমি জাগলে না?
তুমি কি ভুলেছ লবঙ্গ ফুল, এলাচের মৌসুমী,
যেখানে ধূলিতে, কাঁকরে দিনের জাফরান খোলে কলি,
যেখানে মুগ্ধ ইয়াস্মিনের শুভ্র ললাট চুমি
পরীর দেশের স্বপ্ন-সেহেলি জাগে গুলে বকাওলী!

ভুলেছ কি সেই প্রথম সফর জাহাজ চ’লেছে ভেসে
অজানা ফুলের দেশে,
ভুলেছ কি সেই জামরুদ-তোলা স্বপ্ন সবার চোখে
ঝলসে চন্দ্রালোক,
পাল তুলে কোথা জাহাজ চ’লেছে কেটে কেটে নোনা পানি,
অ-শান্ত সন্ধানী
দিগন্ত নীল পর্দা ফেলে সে ছিঁড়ে
সাত-সাগরের নোনা পানি চিরে চিরে।
কোন্ অজ্ঞাত বন্দরে এসে লাগলো সেই জাহাজ
মনে পড়ে নাকো আজ,
তবুও সেখানে ভ’রেছে জাহাজ মারজানে মর্মরে
এইটুকু মনে পড়ে।

কবে যে তোমার পাল ফেটে গেছে উচ্ছৃখল ঝড়ে,
তোমার স্বপ্নে আজ অজগর দুঃস্বপ্নেরা ফেরে।
তারা ফণা তোলে জীর্ণ তোমার মৃত্যুর বন্দরে
তারা বিষাক্ত ক’রেছে তোমার নুয়ে পড়া আকাশেরে।
তবু শুন্বে কি, তবু শুন্বে কি সাত-সাগরের মাঝি
শুকনো বাতাসে তোমার রুদ্ধ কপাট উঠেছে বাজি;
এ নয় জোছনা-নারিকেল শাখে স্বপ্নের মর্মর
এ নয় পরীর দেশের ঝরোকা নারঙ্গী বন্দর
এবার তোমার রুদ্ধ কপাটে মানুষের হাহাকার,
ক্ষুধিত শিশুর কান্নায় শেষ সেতারের ঝংকার।
আজকে তোমার পাল ওঠাতেই হবে,
ছেঁড়া পালে আজ জুড়তেই হবে তালি,
ভাঙা মাস্তুল দেখে দিক করতালি,
তবুও জাহাজ আজ ছোটাতেই হবে।
কে জানে কখন কেটেছে তোমার স্বপ্নমুগ্ধ রাত,
আজকে কঠিন ঝড়ের বাতাস দ্বারে করে কশাঘাত,
সর্প-চিকন জিহ্বায় তার মৃত্যুর ইঙ্গিত,
প্রবল পুচ্ছ আঘাতে তোমার রঙিন মিনার ভাঙে।
হে মাঝি! তবুও থেমো না দেখে এ মৃত্যুর ইঙ্গিত,
তবুও জাহাজ ভাসাতে হবে এ শতাব্দী মরা গাঙে।

এখানে এখন রাত্রি এসেছে নেমে,
তবু দেখা যায় দূরে বহুদূরে হেরার রাজ-তোরণ,
এখানে এখন প্রবল ক্ষুধায় মানুষ উঠছে কেঁপে,
এখানে এখন অজস্র ধারা উঠছে দু’চোখ ছেপে
তবু দেখা যায় দূরে বহুদূরে হেরার রাজ-তোরণ…

কাঁকর বিছানো পথ,
কত বাধা, কত সমুদ্র, পর্বত,
মধ্যদিনের পিশাচের হামাগুড়ি,
শকুনি ফেলেছে ছায়া আমাদের মাথার উপরে উড়ি,
ফেলেছি হারায়ে তৃণঘন বন, যত পুষ্পিত বন,
তবু দেখা যায় দূরে বহুদূরে হেরার রাজ-তোরণ…
শাহী দরজার সকল কপাট অনেক আগেই খোলা,
অনেক আগেই সেখানে দ্বাদশী জোছনা দিয়েছে দোলা।

হে মাঝি! তোমার নোঙ্গর তুলবে না?
এখনো কি আছে দেরী?
হে মাঝি! তোমার পাল আজ খুলবে না?
এখনো কি তার দেরী?

বাতাসে কাঁপছে তোমার সকল পাল
এবার কোরো না দেরী,
নোনা পানি যদি ছুঁয়েছে তোমার হাল
তা’হলে কোরো না দেরী,
এবার তাহলে বাজাও তোমার যাত্রার জয়ভেরী,
আসুক যাত্রী পথিক, হে মাঝি এবার কোরো না দেরী।
দেরী হ’য়ে গেছে অনেক জানো তা তুমি,
ফিরে গেছে কত জাহাজ-ভাসানো দরিয়ার মৌসুমী,
কত এলাচের দানা উড়ে গেছে ঝড়ে
দারুচিনি-শাখা ভেঙেছে বনান্তরে,
মেশ্কের বাস বাতাস নিয়েছে লুটি,
মৃত্যু এখন ধ’রেছে তোমার টুটি,
দুয়ারে জোয়ার ফেনা;
আগে বহু আগে ঝ’রেছে তোমার সকল হাস্নাহেনা।

সকল খোশবু ঝ’রে গেছে বুস্তানে,
নারঙ্গী বনে যদিও সবুজ পাতা-
তবু তার দিন শেষ হ’য়ে আসে ক্রমে-
অজানা মাটির অতল গভীর টানে
সবুজ স্বপ্ন ধূসরতা ব’য়ে আনে
এ কথা সে জানে
এ কথা সে জানে।

তবু সে জাগাবে সব সঞ্চয়ে নারঙ্গী রক্তিম,
যদিও বাতাসে ঝ’রেছে ধূসর পাতা;
যদিও বাতাসে ঝরছে মৃত্যু হিম,
এখনো যে তার জ্বলে অফুরান আশা;
এখনো যে তার স্বপ্ন অপরিসীম।

হে মাঝি! এবার তুমিও পেয়ো না ভয়,
তুমিও কুড়াও হেরার পথিক-তারকার বিস্ময়,
ঝরুক এ ঝড়ে নারঙ্গী পাতা, তবু পাতা অগণন
ভিড় করে- যেথা জাগছে আকাশে হেরার রাজ-তোরণ।

সে পথে যদিও পার হ’তে হবে মরু,
সে পথে যদিও দরিয়ার নোনা পানি,
তবুও সে পথে আছে মঞ্জিল, জানি আছে ছায়াতরু
পথে আছে মিঠে পানি।

তবে পাল খোলো, তবে নোঙ্গর তোলো;
এবার অনেক পথশেষে সন্ধানী!
হেরার তোরণ মিলবে সমুখে জানি।
তবে নোঙ্গর তোলো,
তবে তুমি পাল খোলো,
তবে তুমি পাল খোলো।।