সিন্দবাদ

কেটেছে রঙিন মখমল দিন, নতুন সফর আজ,
শুনছি আবার নোনা দরিয়ার ডাক,
ভাসে জোরওয়ার মউজের শিরে সফেদ চাঁদির তাজ,
পাহাড়-বুলন্দ ঢেউ ব’য়ে আনে নোনা দরিয়ার ডাক;

নতুন পানিতে সফর এবার, হে মাঝি সিন্দবাদ!

আহা, সে নিকষ আকীক বিছানো কতদিন পরে ফিরে
ডেকেছে আমাকে নীল আকাশের তীরে,
ডেকেছে আমাকে জিন্দিগী আর মওতের মাঝখানে
এবার সফর টান্‌বে আমাকে কোন্ স্রোতে কেবা জানে!

ঘন সন্দল কাফুরের বনে ঘোরে এ দিল বেহুঁশ,
হাতীর দাঁতের সাঁজোয়া পরেছে শিলাদৃঢ় আব্‌লুস,
পিপুল বনের ঝাঁজালো হাওয়ায় চোখে যেন ঘুম নামে;
নামে নির্ভীক সিন্ধু ঈগল দরিয়ার হাম্মামে।

কেটেছে রঙিন মখমল দিন ওজুদে চিক্‌না সরে,
তবু দূরচারী সফরের ঢেউ ভেসে এল বন্দরে,
হাতীর হাওদা ওঠাও মাহুত কিংখাব কর শেষ;
আজ নিতে হবে জংগী সাঁজোয়া মাল্লার নীল বেশ।
রোষে ফুলে ওঠে কালাপানি যেন সুবিশাল আজদাহা,
মউজের মুখে ভাসছে কিশ্‌তি শ্বেত,
জানি না এবার কোন স্রোতে মোরা হব ফিরে গুম্‌রাহা
কোথায় খুলবে নওল ঊষার রশ্মিধারা সফেদ;
কোথায় জাহাজ হবে ফিরে বানচাল,
তক্তায় ভেসে কাটবে আবার দরিয়ায় কতকাল;
সে কথা জানি না, মানি না সে কথা দরিয়া ডেকেছে নীল।
খুলি জাহাজের হালে উদ্দাম দিগন্ত ঝিলমিল,
জংগী জোয়ান দাঁড় ফেলে করি দরিয়ার পানি চাষ,
আফতাব ঘঘারে মাথার উপরে মাহ্‌তাব ফেলে দাগ;
তুফান ঝড়িতে তােলপাড় করে কিশ্‌তির পাটাতন;
মোরা নির্ভীক সমুদ্রস্রোতে দাঁড় ফেলি বারো মাস।
সুরাত জামাল জওয়ানির ঠোঁটে বেকার নওজোয়ান
ভাবে জীবনের সব মধু ললাটে কমজোর ভীরু প্রাণ,
এ আশ্চর্য আমাদের কাছে! কিশ্‌তি ভাসায়ে স্রোতে
আমরা পেয়েছি নিত্য নতুন জীবনের তাজা ঘ্রাণ।

পাকে পাকে ঘুরে তীরবেগে ছুটে আবর্তে দিশাহারা,
ক্ষুধার ধমকে ঘাস ছিঁড়ে খেয়ে আকাশে জাগায়ে সাড়া,
জালিমের চোখ আগুনে পোড়ায়ে গুঁড়ায়ে পাপের মাথা’
দেখেছি সবুজ দরিয়া জাজিমে স্বপ্ন র’য়েছে পাতা।

হাজার দ্বীপের বদ রুসমের উপরে লানত হানি’
কিশ্‌তীর মুখ ফেরায়েছি মোরা টানি’-
বুরাঈর সাথে পেয়েছি ভালাই অফুরাণ জিন্দিগী,
আব্‌লুস- ঘন আঁধারে পেখম খুলেছে রাতের শিখী।
আর থেকে থেকে দমকা বাতাসে নারিকেল শাখে হাওয়া,
ভোলায়েছে সব পেরেশানি, শুরু হ’য়েছে গজল গাওয়া,
সুরাত জামাল জওয়ানির ঠোঁটে কেটেছে স্বপ্ন রাত
শুনেছি নেশার ঘোর কেটে যেতে এসেছে নয়া প্রভাত।

জড়ো করি লাল, পোখরাজ আর ইয়াকুত ভরা দিন
দরিয়ার বুকে নামায়েছি ফের বে-দেরেগ সংগিন,
সমুদ্র-সিনা ফেড়ে ছুটে চ’লে কিশ্‌তি, স্বপ্ন সাধ
নতুন পানিতে সফর এবার, হে মাঝি সিন্দবাদ।

আজ নির্ভীক মাল্লার দল ছোটে দরিয়ার টানে,
পান করি সিয়া সুতীব্র জ্বালা কলুষিত বিয়াবানে;
হারামি মওত ঢাকে সারা মন, দেহ,
গলিজ- শহরতলীতে আবার জেগে ওঠে সন্দেহ;
বিষ নিশ্বাসে জিন্দিগী ফের কেঁদে ওঠে বিস্বাদ,
নতুন পানিতে সফর এবার, হে মাঝি সিন্দবাদ।

কালো আকীকের মত এ নিকষ দরিয়ার বুক ছিঁড়ে
চলো সন্দল বন-সন্ধানে অজানা দ্বীপের তীরে,
হালের আঘাতে নোনা পানি ছুঁড়ে রাহা খোঁজে গুমরাহা,
পার হ’য়ে যাও আয়েশী রাতের ফাঁদ;
পাথর জমানো দরিয়ার তীরে মওতের বুকে আহা,
কাফুরের মত নতুন জীবন ডাকছে সিন্দবাদ!
জড়তার রাত শেষ হ’য়ে এল আজ,
কেটেছে পল্কা নরম আয়েশ আশরতে বহুদিন,
মর্চে ধরেছে কব্জায়; ম্লান তাজ।
আজ ফুঁড়ে চলো দরিয়ার সংগিন,
ভাঙো এ নরম মখমলে ছাওয়া দিন;
মাতমি-লেবাস ফেলে আজ পরো মাল্লার নীল সাজ।

আমরা মরি না, সুখা মাটি শুধু তাকায় শংকাকুল,
দরিয়ার ডাকে এক লহ্‌মায় ভাঙে আমাদের ভুল,
প্রকাশিত নীল দিন;
দেখে সফরের প্রসারিত পথ দিগন্ত-স্রোতলীন।

আনি আল্‌মাস, গওহর লুটে আনি জামরুদ লা’ল,
নিথর পাতাল বালাখানা থেকে ওঠাই রাঙা প্রবাল,
এরা জিঞ্জিরে আটক চিড়িয়া হীন কামনার বুড়া-
শিরাজী মত্ত। পাথর হানিয়া করি সব মাথা গুঁড়া।

রাতে জেগে শুনি খোদার আলমে বিচিত্র কল্লোল
তারা ছিটে প’ড়ে মধ্য সাগরে জাহাজে জাগায় দোল,
আমরা নাবিক জংগী জোয়ান ইশারা পেয়েছি কত
মউজের মুখে তাই ভেসে যাই টুকরা খড়ের মত।
বজ্র আওয়াজ থামায়ে গভীর দরিয়ায় ওঠে চাঁদ।
দিলের দুয়ারে মাথা ঠুকে মরে নাবিক সিন্দবাদ।

ভেঙে ফেললো আজ খাকের মমতা আকাশে উঠেছে চাঁদ,
দরিয়ার বুকে দামাল জোয়ার ভাঙ্‌ছে বালুর বাঁধ,
ছিঁড়ে ফেলে আজ আয়েশী রাতের মখমল-অবসাদ,
নতুন পানিতে হাল খুলে দাও, হে মাঝি সিন্দবাদ।