সিরাজাম মুনীরা

সিরাজাম মুনীরা মুহম্মদ মুস্তফা
(সাল্লাল্লাহু আলাইহি অ-সাল্লাম)

পূর্বাচলের দিগন্ত নীলে সে জাগে শাহানশাহের মত
তার স্বাক্ষর বাতাসের আগে ওড়ে নীলাভে অনবরত।
ঘুম ভাঙলো কি হে আলোর পাখী? মহানীলিমায় ভ্রাম্যমাণ
রাত্রি রুদ্ধ কণ্ঠ হ’তে কি ঝ’রবে এবার দিনের গান?
এবার কি সুর ঘন অশ্রুর কারা তট থেকে প্রশান্তির?
এবার সে কোন্ আলোর স্বপ্নে তাকাবে ক্ষুব্ধ প্রলয় নীর?
এ বোবা বধির আকাশে এবার ভূলবে কি তার নীরবতাকে
সেই মুসাফির সুদূরচারীর সুগভীর সুরে দরদী ডাকে?

ঐ আসে আসে সেই বিহঙ্গ সাতরঙা তার শ্বেত পাখায়,
আকাশের বুক ঘন হঁয়ে ওঠে নীল মরকত স্বচ্ছতায়,
সোনালী আলোয় শ্বাপদ রাত্রি আহত, লুপ্ত নিমেষ মাঝে;
থির-বিদ্যুৎ আভা তরঙ্গ আলোকের সুর আকাশে বাজে।

হে অচেনা পাখী কোন্ আকাশের গভীরতা হ’তে এসেছ উঠি?
তোমার পক্ষ-সঞ্চারে ভাষা-ভাবের কুসুম উঠিছে ফুটি;
তোমার জরিন জরির ফিতায় নিখিল মানস করো জরিপ
কত অজ্ঞাত সাগরে সহসা ভেসে ওঠে কত সোনার দ্বীপ,
ভাষা-মুখরিত তোমার পাখায় সব সাগরের অশ্রুজল,
তোমার ছায়াকে চুম্বন করে তরুণ মনের লাল কমল,
আলো-বিহঙ্গ! মুক্ত নীলের সকল রশ্মি ঝরোকা চেন,
তোমার গতির ইঙ্গিতে তাই নিখিল স্বপ্ন ফুটছে যেন।
অন্ধ রাতের তুমি নও, তুমি নও মৃত স্থবিরতার
সব আকাশের দুয়ার খুলেছো, খুলেছো সকল মনের দ্বার,
তোমার আসার পথ চেয়ে চেয়ে আবেগে সকল আকাশ কাঁপে,
মুক্তপক্ষ, হে আলো! ধন্য ধরণী তোমার আবির্ভাবে।

কে আসে, কে আসে সাড়া প’ড়ে যায়,
কে আসে, কে আসে নতুন সাড়া!
জাগে সুষুপ্ত মৃত জনপদ, জাগে শতাব্দী ঘুমের পাড়া।
হারা সম্বিত ফিরে দিতে বুকে তুমি আনো প্রিয় আবহায়াত,
জানি সিরাজাম-মুনীরা তোমার রশ্মিতে জাগে কোটি প্রভাত,
তব বিদ্যুকণা-স্ফুলিঙ্গে লুকানো র’য়েছে লক্ষ দিন,
তোমার আলোয় জাগে সিদ্দিক, জিন্নুরাইন, আলী নবীন,
ঘুম ভেঙে যায় আল ফারুকের- হেরি ও প্রভাত জ্যোতিষ্মান
মুক্ত উদার আলোক তোমার অগণন শিখা পায় যে প্রাণ।

তুমি না আসিলে মধু ভাণ্ডার ধরায় কখনো হ’ত না লুট,
তুমি না আসিলে নার্গিস কভু খুলতো না তার পর্ণপুট,
বিচিত্র আশা-মুখর মাশুক খুলতো না তার রুদ্ধ দিল;
দিনের প্রহরী দিত না সরায়ে আবছা আঁধার কালো নিখিল।

তাই সে যখন এল এ ধরায় সে নবী যখন আবির্ভূত
দেখে এ বিশ্ব বিস্মিত চিতে সে দূতের তনু মহিমা পূত,
নিখিল ব্যাপ্ত তার অন্তরে পর্বত হ’তে পথের ধূলি,
এ-হাতে বজ্রনির্ঘোষ যবে ও-হাত এনেছে গোলাব তুলি,
ক্লিন্ন তিমিরে যাত্রীরা যবে দেখে সম্মুখে শ্বাপদ ভূমি
এমন সময় হে জ্যোতির্ময় নূরানী চেরাগ আনলে তুমি।
‘কে আমি’ জানালে তুমিই প্রথম হে মেষপালক উম্মী নবী!
দীপ্ত সূর্য আলো আরশিতে ধরিয়াছে কাল তোমারি ছবি।
সে এল, সে এল রাজার মত সে এ-ধূলিতে তবু দীনের মত,
পুষ্পকোমল তার অন্তর হ’ল বিক্ষত কাঁটায় ক্ষত,
তবু সে জাগালো মেশ্কের বাস, জাগালো মরুতে গুলে আনার
ইব্রাহিমের পরশে যেমন ফুল হঁয়ে ফোটে ক্ষুব্ধ নার।

দেখেছি তোমার মানবতা চলে সাথে জনগণ বিপুল দেহ
ক্লেদাক্ত পথে ফোটায়ে মুকুল সাজালো তাদের ধরণী গেহ,
যে মরুতে জানি ফুল ফোটেনাকো, যেখানে উষর পৃথ্বীতল,
সেখানেও তুমি জাগালে শস্য, আনলে অঝোর ধারা বাদল।

তবু ভাঙলো কি, ঘুম ভাঙলো কি, ঘুম ভাঙলো এ অন্ধদের?
আজ বিস্মৃতি তোলে যে আড়াল তোমার দিনের এই দিনের!
এখানে যে ম্লান কদর্যতার ছবি আর ক্ষুধা যায় কি সেথা,
গড়ায় বিপুল অজগর তার লেলিহান ক্ষুধা, বিপুল ব্যথা,
আকাশে আকাশে তারি বিষাক্ত প্রশ্বাসে হেরি মূর্ছাতুর
আলো-বিহঙ্গ ভোলে হে সূর্য, তোমার শেখানো পথের সুর।

মনে জাগে সেই ঘনতর বিষ, বিশ্ব আরব গগনে মেঘ
অত্যাচারীর হাতে পীড়িতের সে কী দুর্ভোগ, কী উদ্বেগ!
মূক পশু সম মার খেয়ে মরে খরিদা গোলাম বাঁদির দল
শিশু হত্যার মৌসুমী যেন, পাপে কেঁপে ওঠে জলস্থল,
শারাব শোণিতে মাতাল মানুষ মানবতাহীন নর্দমায়
পুরীষ মাখায় শুভ্র ললাটে কদর্যরুচি পশুর প্রায়,
নাস্তিকতায় বহুত্ববাদে, ব্যভিচারে ছানি প’ড়েছে চোখে
কাবাগৃহ তারা সাজায়ে পুতুলে অন্ধের মত কপাল ঠোকে,
পথে কেঁদে ফেরে এতিম শিশুরা সর্বহারার বিরাট দল,
জালিমের হাতে মার খেয়ে খেয়ে বৃথা মোছে তারা নয়নজল।
আজো যেন শুনি ওরা টুটি টিপে মারছে শিশুকে সদ্যজাতা
অসহায় শিশু কণ্ঠের শেষ গোঙানিতে কাঁপে খেজুর পাতা,
বালু চাপা দিয়ে শ্বাস রোধ করি জাগে পিশাচের কলোগ্লাস,
কেঁদে ওঠে ধরা বুকে ধরে সেই দুধের বাচ্চা শিশুর লাশ।
হাটে ও বাজারে কেনা দাস-দাসী মানুষ লুটালো প্রেতের করে
মানবতাহীন কসাইয়ের হাতে তাদের হাড়ের চামড়া ঝরে।
সত্যধর্ম মুছেছে তখন তিমির লুপ্ত ধরণী হ’তে
শুধু নীচু মুখে ভয়াল গতিতে নামছে বিশ্ব ধ্বংস স্রোতে।
নিখিল-বিশ্ব ঊষা নেমে এলে বুকে নিয়ে এলে আলোর রেখ।

সে দিন কি দুলে উঠেছিল ধরা নওশেরোয়াঁর ভেঙেছে দ্বার?
নিভেছে পৌত্তলিকের হাজার বছর জ্বালানো কুহক নার?
দুষা শাবক ঘাস ফেলে দিয়ে শোনে কি অজানা সুরের গান
অস্ত চাঁদের রশ্মি কি চায় দিনের সূর্যে জোয়ার টান?
হায়রে অনাথ এতিম শুধুই মার কোলে দোলে পিতৃহারা।
তার পরে কবে মা-হারা সে শিশু পথে পথে মোছে অশ্রু-ধারা,
মাঠে মাঠে করে দুম্বা চরাতে সে শিশু বুঝেছে ব্যথা অপার
বাণিজ্য পথে বোঝা টেনে টেনে সে বুঝেছে ব্যথা মানবতার।

লু’ হাওয়ায় ওড়ে মরুর কাঁকর সূর্য-শিখায় ভয়ঙ্কর,
অগ্নিদাহন তোমার কোমল তনুতে হানে সে অগ্নিশর,
ঈশান কোণের ঝড় উড়ে আসে, সাথে বয়ে আনে মরুর ধূলি,
কিশোর কণ্ঠ জ্বলে পিপাসায়; জলে ক্ষুধাতুর পাকস্থলী,
বত্রিশ নাড়ী ছিঁড়ে প’ড়ে বুঝি ক্ষুধার ধমকে ধমনী কাঁপে,
বাবলা কাঁটায় বিক্ষত দেহ, পিঠ নুয়ে আসে বোঝার চাপে,
আঁসু ঝরে আর কলিজার খুন ঝরে সিরিয়ার বালুর মাঠে,
খেজুর কাণ্ড উপাধান শিরে কিশোর তোমার রজনী কাটে।
কোন্ সে অটল কারিগর তার কঠিন আঘাতে অনবরত
বারবার হানে আর চেয়ে দেখে হ’ল কিনা তার মনের মত।
হাজার ব্যথার আগুনে পোড়ায়ে মরুর হাপরে হাজার দিন
সুন্দরতম তব অন্তর ব্যথার রঙে সে করে রঙিন।
তখন তোমার বিশাল হৃদয় বুঝেছে দুঃখ দীন দুখীর
জীবন কাঁটায়ে অনশনে হায় বুঝেছে কী জ্বালা ভুখা প্রাণীর,
জেনেছে বন্দী বনি-আদমের দুঃখ; কোথায় ব্যথা নারীর।
কোন কারিগর দিয়াছে তোমার ঐ সুবিশাল নয়নে নীর?

মরুআকাশের গভীরতা সে’ও হার মানে ঐ বুকের কাছে।
তোমার খোর্মা মুঠি বিলি করো তুলে নিয়ে তুমি মুখের কাছে।

তারপর এল হেরা গহ্বরে তিমির পাথারে ধ্যানের দিন
পরম সত্য খুঁজবার তরী ভাসে সেই স্রোতে সাথীবিহীন,
মরু মক্কার চোখের মণি সে সত্য দীপ্ত আল্-আমিন
হেরার গুহায় মোরাকাবা-লীন খোঁজে সে সত্য প্রেম রঙিন।

মরু প্রশ্বাসে বালুকা-বেলার পটে বদলায় রাজ্যপাট,
দিনের দরজা বন্ধ করিয়া প’ড়ে রাত্রির কালো কপাট,
জ্বলে অসংখ্য সেতারার বাতি গভীর নীলায় তন্দ্রাহীন
ঘুমহারা চোখে হে সাধক! তব শর্বরী কাটে ব্যথামলিন।
স্তব্ধ নিথর থমথম করে তোমার আকাশ তোমার মন,
মরুর পিপাসা নিয়ে তুমি করো আত্মার বারি অন্বেষণ,
ব্যাকুল আশায় হেরার শিখরে খুঁজে ফেরো তুমি আবহায়াত
সূর্য-শ্রান্ত দিনশেষে নামে দীর্ঘ তোমার ধ্যানের রাত।

একাগ্রতার সকল সেতারা চেরাগ জ্বালায়ে মনের সাধ
খোঁজো হে সাধক মৌন পরম সত্য-স্রষ্টা আল্-আহাদ,
খুঁজে ফেরো তুমি লা-শরীকে মহান সত্য অভিজ্ঞান।
মরুর পিপাসা অশ্রু ভিজায়ে জাগাও দু’চোখে কী সন্ধান?
হে একাগ্রচিত্ত সাধক ঘরছাড়া হায় সাথীবিহীন।
কোন জয়তুনী স্মৃতিকথা বহি জাগো অ-শ্রান্ত রজনী-দিন?
হেরার কাঁকর ফোটে না কি পায় মরুর সূর্যে জ্বলে না দেহ?
কোন আলোকের আশায় ছাড়লে খেজুর ছায়ার শান্ত গেহ?
প্রবল তৃষিত লু’ হাওয়ার শিখা সে কী হার মানে ঐ আবেগে,
ঝড়ের মতন সারা তনুমন কাঁপে ঈশ্কের আগুন লেগে,

যে অঝোর ধারা ঝ’রছে নয়নে আর্জের অশ্রুভার
কেঁদে কয়- কবে শেষ হবে তার প্রতীক্ষা-নিশি নীরবতার।
ঘুমায় আরব-আজম বিশ্ব জয়তুন শাখে শিশিরপাত,
হায় ঘুমহারা! তোমার সমুখে জাগে নিশিশেষে ম্লান প্রভাত,
তবুও তোমার সেতারার শিখা জ্বলে অম্লান দীর্ঘ যাম,
পরম জ্ঞানের সন্ধানে ঐ দু’আঁখির হায় নাই বিরাম
ভেঙে পড়ে দেহ, শীর্ণ ও-তনু ক্রন্দনে সারা মন বিবশ,
জয়তুন পাতা ঝ’রে পড়ে বুঝি নিঙাড়িয়া প্রাণ-সবুজ-রস।
এমন সময় মরু বিয়াবান কঁপায়ে প্রবল ঝঞ্ঝাস্বর
কালের তীব্র ঘণ্টার ঝড়ে নেমে এল নীচে মহা খবর
নূরের বিভায় দীপ্ত পরম সত্য বারতা অনির্বাণ
দিশাহারা পাখী তোমার কণ্ঠে নামলো প্রজ্ঞাময় কোরাণ।
কোন্ অরণ্য বিদ্যুৎ ঝড়ে চাপা প’ড়ে ম্লান জোনাকি শিখা
দিক্দিগন্তে তোমার মনের জাগ্‌লো জ্যোতির্দীপ্ত লিখা।

প্রবল বাহুতে টেনে নিয়ে ঐ বিরাট নিখিল ভরানো দিল
বলে, ‘পাঠ করো’ ফুকারে বিশাল দীপ্ত বক্ষ জিবরাইল।
তস্বির সম তুমি বিস্মিত হে মেষপালক উম্মী নবী,
মহান জ্ঞানের সম্মুখে এসে দাঁড়ালে নীরব হেরার-রবি।

স্তব্ধ তখন আকাশের গায় খেজুর শাখার প্রান্তসীমা
বিস্মিত ধরা চোখ ভরে দেখে তার দুলালের মহা গরিমা,
খুলিছে সকল আকাশের দ্বার, তারকাবিদ্ধ নীল কপাট
তোমার প্রভুর নামে বুক ভরি হে নবী তখন নিতেছ পাঠ…
কোরাণের নূর বুকে পুরে নিয়ে দাঁড়ালে যখন মরুর পথে
মহাবেদনায় দেখলে মানুষ ভাস্ছে পাপের কলুষ স্রোতে।

সে কী অনাচার! সে কী ব্যভিচার। বীভৎস কর আঁধি বিলীন,
ভয়াল ঘৃণায় ন্যক্কার তোলে শতাব্দী পথে রাত্রি দিন।
পুতুলে সাজায়ে কাবাঘর কারা মাথা ঠুকে মরে পাপ-মাতাল,
অজ্ঞতার ঐ কুয়াশার ভিতে বসে মুখেরা ফেলিছে জাল,
যত কলুষিত পচা শাস্ত্রের বাসি রসে ভরি মাতাল মন
মৃত জড়তার অশেষ আঁধার পচাবিষ তারা করে বমন।

সেদিন তমসা শিখরে নূরানী জয়তুন চারা করি রোপণ
প্রোজ্জ্বল দীপ এলে সিরাজাম মুনীরা জাগায়ে অযুত মন।

মানবমুক্তি পণ নিয়ে তুমি ওঠো দুর্গম শিলা শিখরে,
প্রতি পাথরের প্রাকার পারাতে আহত তোমার রুধির ঝরে,
হে বীর। সেখানে পাথরের মত অটল তোমার পদক্ষেপ,
শিলা পার হঁয়ে পীড়িতের বুকে ঝর্ণাধারার দাও প্রলেপ
যেদিন শোনালে সাফার শিখরে সত্য হে নবী মুহম্মদ
সেদিন তোমার সম্মুখে এসে দাঁড়ালো হাজার শোণিত নদ।

‘আল্লা ব্যতীত নাই উপাস্য, মুহম্মদ সে তার রসুল!’
জানালে যেদিন, তিমিরাবর্তে বজ্র যেদিন ভাঙালো ভুল;
আলোক-অন্ধ শ্বাপদ সেদিন আসে প্রাণপণ, হানে ছোবল;
তুমি অপচল আল্লার দূত দাঁড়ালে সেদিন শিলা-অটল।

জ্যোতির পাপড়ি কাঁটায় ছিড়তে চায় জংধরা পাষাণ দিল,
বাধার পাথরে প্রতিরোধ জাগে, জাগে শয়তান আবুজিহিল,
পাহাড়ে তোমার কেটে যায় কত দীর্ঘ দিনের অন্তরীণ
পশু ও পাখীর আহার্যে তবু হয় না মুখের হাসি মলিন,
তায়েফে শোণিত-স্নান করি তুমি বল: তিনি এক লা-শরীক,
হেরার সূর্য! তখনো আকাশ লুপ্ত, তিমিরে ভরানো দিক।

প্রবল আঘাত শোণিতে, যখন ভাঙছে তোমার তনু ও মন
তখনো ধ্যানের আলোক-পাখায় মহাজ্ঞান করো অন্বেষণ,
তখনো জ্ঞানের পর্দা আড়ালে খুঁজেছে সত্য শ্রান্তিহীন,
প্রজ্ঞা-পথিক! যে সমুদ্রের জোয়ার ভাটায় রাত্রি দিন,
দুই রঙা পাখী পাখা মেলে দিয়ে, ভাসছে যেখানে বারি অতল
তারি তলে ডুবে তুলে আনো কোন্ অজানা জ্ঞানের মুক্তাফল।
‘মুহম্মদ কে’ শুধালে যখন আয়েষা তখন নিরুত্তর;
‘মুহম্মদ কে?’ কে জানে সেকথা কে জানে জ্ঞানের গৃঢ় খবর?
তুমি জানো নিজ অনস্তিত্ব, মাটির কাহিনী, প্রভুর দানে
নূরানী কলবে তারকা ছিটায়ে ওড়ে সে ঊর্ধ্ব আকাশ পানে।
সে মাটি পেয়েছে দারাজ বাজুতে আকাশ পারের প্রবল ঝড়
পার হ’য়ে যায় মরু সাইমুম তীব্রচ্ছটা ভয়ঙ্কর,
রাত্রি মুগ্ধ বেষ্টনী হ’তে ছিটে পড়ে তারা নীহারিকার,
সকল আকাশ ধরা দেয় এসে বিপুল সবল মুঠিতে তার।

তারপর তার শান্ত আকাশ বাড়ে ক্রমাগত ধ্যানের রাত
নিজের কাহিনী স্মরণ করিয়া মৃত্তিকা করে অশ্রুপাত।
এমনি সে কোন্ নীরব নিশীথে এল বোর্রোক বহিয়া জ্যোতি,
তারাভরা রাত, শুক্লা প্রভাত, বিদ্যুৎ ঝড়, বিপুল গতি।
জানি না সে কত আকাশ পারায়ে পরলে প্রথম মোতির তাজ
প্রতীক্ষার সে স্বর্ণ-নিশীথে নামলো পূর্ণ শবে মেরাজ,
সেদিন পূর্ণ মাটির মানুষ আন্লে যে দান পূর্ণতার
আরব-ঊষর নিখিল চিত্তে আজো সে জাগায় গুলে আনার
মক্কার মরু নিল না তোমার প্রাণরসে-ভরা আবহায়াত,

দূর ওয়েসিস পারে মদীনার দরদী আকাশ বাড়ালো হাত।
সেথা’ও মক্কী সাপের জনতা নিয়ে গেছে তার হিংসানল
সেখানেও তাঁরা হেনেছে ও বুকে বিষাক্ত ছুরি, বিষ-ছোবল,
বদর-ওহোদ, মরুপ্রান্তরে ঘিরে যবে হানে মৃত্যুতীর
তখনো সকল মৃত্যুর মাঝে সিপাহ্সালার রইলে স্থির,
লক্ষ মৃত্যু উদ্যত তবু হে মহাসেনানী পাও না ভয়,
বিস্মিত চোখে আলী হায়দর দেখে ঐ তনু জ্যোতির্ময়,

হামজা শিহরে পুলকিত বীর জাগলো কি ফের অস্ত্র তার
দু’হাতে দু’ধারী তলওয়ার নিয়ে হাঁকে, হে সেনানী!
জয় তোমার।

জোড়াতালি দেওয়া, রোদে ভেঙে পড়া নির্যাতিতের ভাঙা মিছিল
তোমার হাতের ইশারায় খোলে মরুদুর্গের সকল খিল।
তারপর এল তোমার প্রভুর প্রতিশ্রুত সে জয়ের দিন
মহাগৌরবে এল ফত্হুম মূবিন–শান্তি দীপ্ত দিন
দীর্ঘ রাতের প্রতীক্ষার ঐ মরুকণ্টকে রঙিন লাল
ফুটলো গোলাব দিকদিগন্তে আজান ফুকারে সাথী বেলাল।
অটল তোমার ধৈর্য হে নবী! সুন্দরতম সে অপরূপ,
তোমার আলোয় জেগে ওঠে কোটি সুদূর প্রাচীন অন্ধকূপ,
অমনি অন্ধ কূপমণ্ডুক সাত সাগরের সিন্দবাদ
নোনাপানি চিরে দ্বীপে বন্দরে নতুন দিনের করে আবাদ,
সাগরে সাগরে নীল স্রোত চিরে ওঠায় ফসল মারজানের,
পাখা মেলে কোথা আকাশ-নাবিক মুসাফির দূর বন্দরের,
সূর্য ফলায় চাষ ক’রে যায় রাত্রি বিরাণ অধিত্যকা
হারানো সাথীরে খুঁজে পায় ফের বিস্মৃত পথে বিরহী চখা
ব’য়ে আনে কোন্ দিগন্ত হ’তে পূর্ণিমা চাঁদ সুরভিসার
রসে ফেটে প’ড়ে জেরুজালেমের গুলশানে লা’লা রাঙা আনার।

কোথায় গেল সে দুর্নীতি আর ক্লেদ ব্যভিচার ভরা পুরীষ
কোথায় গেল সে মানবতাহীন যাত্রীদলের বুকের বিষ।
জিঞ্জীর ভার খ’সে পড়ে গেছে লুটায় বেহেশ্ত্ পায়ের তলে
জীবন্ত শিশু কোলে নিয়ে নারী ভাসে আনন্দ অশ্রুজলে,
আসে দলে দলে নবীন নকীব, উজ্জীবিত সে মানবদল,
ভরে তকদির পুণ্যধ্বনিতে শূন্য নীলিমা জলস্থল,
ধর্মবিহীন তার্কিকও আজ সাক্ষ্য দেয় সে লা-শরীক
‘আল্লার নাই অংশী মুহম্মদ তার দাস জেনেছি ঠিক’।
বুঝেছে সত্য মরুর দুলাল সঙ্গী সুফ্ফা মহামানব
আবহায়াতের ধারায় জেগেছে শতাব্দীর ও প্রাচীন শব।
জ্বলে ভঙ্গুর মৃত শামাদানে চিরন্তনের অভিজ্ঞান
আকাশে আকাশে তারি আহ্বান, পাতার শিয়রে তারি আজান।

তুলেছ কি ভুলি রংগিন তুলি ঝঞ্ঝাক্ষুদ্ধ প্রলয় নীলে?
চোখের পলকে সকল ক্ষুব্ধ ভয়াল ঝটিকা থামায়ে দিলে।
জাগ্‌লো আবার সাদা বাঁকা রেখা ইঙ্গিত দিয়ে পথ চলার
অমনি মুক্ত সুপ্ত স্তরে কওসর ধারা সাত তলার,
শুকনো রুক্ষ বালু ভিজে ওঠে প্রেম-অশ্রুতে পূর্ণ বুক,
শিশির ভেজানো গোলাবী পাপড়ি চায় বুলবুলি চায় মাশুক।
তাই নির্জন-চারী ওয়ায়েস করণির বুকে রঙের ঢেউ,
কেমন ক’রে যে কাটে তার দিন তুমি ছাড়া আর জানে না কেউ।
ভাণ্ডার ভরা সব সম্পদ বিলালে ব্যথিত মহৎ-মনা
ও মাটির নীড়ে তবু অক্ষয় রইল অশ্রু সমবেদনা।

ধ’রেছো মুচির সূচ নিজ হাতে, ইট ব’য়ে তুমি হ’য়েছ কুলি
ইহুদীর কাছে মার খেয়ে হায় ভরালে কি ঐ ছিন্ন ঝুলি।
মানুষের লাগি, ‘উম্মত লাগি’ একী দানে ভরা পরাণপণ-
পরম প্রভুর কাছে দীনতায় একী সুন্দর সমর্পণ।

পুরানো রাতের চাঁদ ক্ষ’য়ে উঠেছে আকাশে নতুন চাঁদ,
সে চাঁদই নিভেছে কালো অঙ্গারে, পার হ’য়ে মরু নীলার বাঁধ
তোমার কুটীর দ্বারে হয় কত খণ্ড শশীর আবির্ভাব,
তবুও মক্কা-মদীনার রাজা মেটে না তোমার গৃহে অভাব,
উনানে চড়ে না আহার্য, কাটে ক্ষুধিত তোমার কত না রাত
মানুষের লাগি উম্মত লাগি তবুও ক’রেছো অশ্রুপাত;
জ্বলে না কুটীরে চেরাগ, জ্বলে ও-ব্যথিত বক্ষে প্রেমের শিখা
জ্বলে ও-মাটির শামাদানে লাল ফিরদৌসের স্বপ্ন লিখা।

গলেছে পাহাড়, জ্বলেছে আকাশ, জেগেছে মানুষ তোমার সাথে,
তোমার পথের যাত্রীরা কভু থামেনি চরম ব্যর্থতাতে,
তাই সিদ্দিক পেয়েছে বক্ষে অমন সত্য সিন্ধু-দোল,
তাই উমরের পাতার ডেরার নিখিল জনের ও কলরোল
তাই ওসমান খুলে গেল দ্বার অতুলন দিল মণিকোঠার,
তাইতো আলীর হাতে চমকায় বাঁকা বিদ্যুৎ জুলফিকার,
খালেদ, তারেক ঝাণ্ডা ওড়ায় মাশুকের বুকে প্রেমের টান,
মহাচীন মুখে ফেরায়ে কাফেলা জ্ঞান যাত্রীরা করে প্রয়াণ।
পাল তুলে দিয়ে কিশতি ছুটেছে জোয়ার ভাটার মাঝে অটল
নতুন তুফানে কোটি মরাগাঙ ধমনীতে পেল নতুন বল,
তারা খুঁজে ফেরে সিন্ধু ঠিকানা প্রবল তৃষার বারি অতল,
মৌসুমী ফুল জাগায়ে দু’ধারে বর্ষ শেষের তোলে ফসল।

মানুষের হাতে সকল পাথেয় দিয়ে কামালৎ-সম্ভাবনা
সব কাজ শেষে মরু-আফতাব হ’লে কি এবার অন্যমনা?
আজ এতদিনে হ’ল কি সময় আবার নতুন পথ চলার?
পরম প্রিয়ের ডাক এল নাকি? আকাশ মহলা সাত তলার
ওপার থেকে সে মহা কারিগর ডাক দিল নাকি হে নূরনবী?
মরুর আকাশ রোশ্নিতে ভরি এবার কোথায় জাগবে রবি?
এখানে তোমার নিশীথারণ্য? কোথায় তোমার ফুটেছে যুঁই?
সে কোন্ স্বর্ণচামেলি বনের আভায় এ মাটি হ’ল বিভুই?
ফিরদৌসের কোন্ গুলশানে ‘সী’ বিহঙ্গ উঠলো ডেকে
চলে গেলে তুমি ও মাটির ফুলমৃত্তিকা তনু ধুলায় রেখে,
যেথা সুন্দর গোলাবী পাপড়ি অক্ষয় রসে নিত্য লাল
চ’লে গেলে সেথা তারি ছায়া মুক্তি পথের আল-হেলাল।

তোমার পথের প্রতি বালুকায় এখনো উদার আমন্ত্রণ,
ঘাসের শিয়রে সবুজের ছোপ জাগায়ে স্বপ্ন দেখিছে বন।
তব শাহাদৎ অলি আজও ফিরদৌসের ইশারা করে,
নিখিল ব্যথিত উম্মত লাগি এখনো তোমার অশ্রু ঝরে,
তোমার রওজা মুবারকে আজও সেই খোশ্বুর বইছে বান,
চামেলির ঘ্রাণ, অশ্রুর বান এখনো সেখানে অনির্বাণ।

চলেছে ধ্যানের জ্ঞান-শিখা ব’য়ে জিলানের বীর, চিশতী বীর
রংগিন করি মাটির সুরাহী নক্শবন্দের নয়নে নীর,
জ্ঞানের প্রেমের নিশান তুলেছে হাজার সালের মুজাদ্দিদ
রায় বেরেলির জঙ্গী দিলীর ভেঙেছে লক্ষ রাতের নিঁদ
ওরা গেছে বহি তোমার নিশান রেখে গেছে পথে সেই নিশানি,
তবু সে চলার শেষ নাই আর, কোনদিন শেষ হবে না জানি।
লাখো শামাদান জ্বলে অফুরান রাত্রি তোমার রশ্মি স্মরি
সে আলো বিভায় মুখ তুলে চায় প্রাণ পিপাসায় এ শর্বরী।

সুর্মা গভীর আকাশের চোখে অশ্রুসজল বৃষ্টিধারা,
নতুন তারার পথ চেয়ে চেয়ে নীহারিকা হ’ল দৃষ্টিহারা।
বিরাট প্রসার মহা-পটভূমি তোমার বেলায় ইতস্তত
অশেষ সম্ভাবনার পলিতে দুরন্ত মরু ঝড়ের মত
যারা এঁকে আসে নতুন মাটিতে সুদৃঢ় ছাপ পথচলার
দীপ্ত ছুরিতে ভাঁজ কেটে কেটে অসাড় তিমির স্থবিরতার;
তাদের সঙ্গে সালাম জানাই হে মানবতার শাহান শাহ্!
হে নবী! সালাম: সাল্লাল্লাহু আলাইকা ইয়া রাসুলুল্লাহ।।