উমর-দারাজ দিল

দেখি সে চ’লেছে … মরু মুসাফির … কোথায় কে জানে
পিঠে বোঝা নিয়ে মৃত বিয়াবান ছাড়ায়ে কী টানে!
চ’লেছে নিয়ে সে মানবতা- যেথা মরু নিষ্প্রাণ,
জেরুজালেমের মাঠে ঢেলে প্রাণ বহি তুফান,
চ’লেছে পারায়ে কাফেলা-সালার শিলা-প্রান্তর
দুর্গমতার শিখরে সেখানে মানুষের ঘর …
চ’লেছে সে-পথে;- সকল পাহাড়, প্রাচীর বাধার
ধূলি হয়ে ওড়ে সব প্রতিরোধ সম্মুখে তার।

চ’লেছে সে দূরে ভূত্যের সাথে মরু পথে,
আগুন জেলেছে আকাশে সূর্য প্রলয়কর,
সেই তাপে সারা গায়ে আতশের শিখা জ্বলে,
আনন্দে টানে উটের রশ্মি, উটে চাকর।
শুক্নো খোর্মা খেজুর তৃপ্ত
সে খলিফাতুল মুস্লেমীন
সত্য, ন্যায়ের মাঠে এনেছিল
সব মানুষের মুক্ত দিন।

সেদিনে এ-দিনে উমর! আজ
পড়েছে বাঁধ,
কবে যে সেখানে ঘনালো সাঁঝ
নামলো এখানে সেই ছায়ায়
রাত অগাধ।
এখানে কেবল আর্ত স্বর,
এখানে তোমার নাই খবর,
প’ড়ে আছি যেন শ্রান্ত শব;
আজকে এখানে নাই উমর।

তবুও থামে না ধূলি লুণ্ঠিত জনতার মন,
জানি ক্রূর জুলমাতে সে খোঁজে কোথায় উমরের খিলাফত,
সেই গতিবেগে জ্ব’লে ওঠে তার আফতাব সন্ধানী;
সে গতির মুখে উড়ে যায় ভয়, শঙ্কার পর্বত।

উমর! তোমার বিশাল হৃদয় দেখে নিতে সাধ জাগে
কেমন ক’রে এ জনতারে তুমি নিয়েছিলে পুরো ভাগে,
কেমন ক’রে এ নির্যাতিতের বিরাট ভাঙা মিছিল,
সাথে নিয়ে তুমি চলেছ সুদূর পথে হে দারাজ্ দিল্,
কেমন ক’রে এ বিবর্ণ মরু করি রঙিন
এনেছিলে দিন, সূর্য মুঠিতে শুভ্র দিন!

দুর্গত জনগণের দরদী! বেছে নিলে সেরা পথ,
মাটির তখ্তে ব’সেছে তোমার সাম্যের খিলাফত,
আজো যেন দেখি জীর্ণ বস্ত্র মেলে ব’সে আছো একা
তোমার দিলের সেরা দৌলত ছিন্ন পিরানে লেখা।

তুলেছে তোমার বদ্দু আকাশ মরু-প্রান্তরে খিমা
দারাজ দিলের প্রসারণ ভাঙে দূর দিগন্তে সীমা
জানি না কেমন ক’রে এ-মরুতে এল সে প্রাণের ঝড়,
নিমেষে ধরণী ছেয়ে নিল অম্বর,
ওড়ে কালো সিয়া জড়তার দুর্জয় কশাঘাতে,
আঁধার, উষর মৃত প্রান্তর কেঁপে শঙ্কাতে …

জ্বলে দিগন্ত বিপুলায়তন উমর- বজ্র দীপ,
তার প্রোজ্জ্বল রোশ্‌নিতে জাগে মাটির লাখো প্রদীপ,
আলো উচ্ছল আকাশ ধরণীতলে তার নির্ভীক সিপাহ্সালার চলে,
জাগে পৃথিবীর দূরতম কোণে বিস্ময় প্রতি পলে
সেই চেরাগের আতশী দহন তলে।

যেখানে আকাশ সীমানাহীন,
যেখানে উদয়-রবি রঙিন
সেখানে তোমার অভ্যুদয়
সেখানে তোমার স্বর্ণ দিন।
করো দিগন্ত লঘন তুমি বিপুল বেগে,
মরু পর্বত পার হ’য়ে যাও নিরুদ্বেগে,
হে নিঃশঙ্ক! চিরদিন তুমি শঙ্কাহীন,
চমকে তোমার অস্ত্রে অশনি-দীপ্ত দিন।
তোমার দৃষ্টি সম্মুখ হ’তে
পালায় সভয়ে যে পলাতক,
সেই শয়তান,- প্রবল, ভয়াল
ঝড়ের মুখে সে ঝরা পালক
রূঢ় সত্যের সম্মুখে সিয়া
ত্রাস মলিন,
নিমেষে আলোক পথ ছেড়ে হয়
আঁধি-বিলীন।

পাপের প্রাচীরে যেথা স্তম্ভিত সত্যের প্রভা ম্লান
তোমার শাণিত তল্ওয়ারে সেথা বজ্রের প্রস্বান।
নিমেষে প্রাকার ভেঙে হয় গুঁড়া গুঁড়া,
আঁধারের পটে সহসা-প্রকাশ সঙ্গ্-মর্মর চূড়া,
সাথে নিয়ে আসে মহাসত্যের অনুচ্ছেদ,
সীমারেখা টেনে দারাজ দস্তে করে প্রভেদ।

অথবা আবার তল্ওয়ার চম্কায়
জালিম, পাপীর, অত্যাচারীর শিয়রে দৃপ্তকায়!
নিষ্প্রভ আঁখি, ঝলসে আঁধির চোখ!
অকম্পিত সে শৌর্যের বুকে প্রবল সত্যালোক
বিশ্বনবীর রশ্মিদীপ্ত স্বর্ণশ্যেন
নিখিল ভুবনে মেলেছে সে পাখা আলো সফেন।
বিপুল প্রতাপে সে বিজয়ী তরবারি,
সে অপরাজেয় ফিরে আসে ঘরে শান্তি পতাকাধারী।
সে কী পৌরুষ! শান্তি দীপ্ত
দারাজ বক্ষে সে কী পুলক,
মিথ্যা হ’তে সে সত্যে ফারুক
করে পৃথক।

আবার দেখি সে ক্ষুধিত জনের শিয়রে একাকী কাঁদে,
নিশীথ প্রহরী ঘুমহারা চোখে বোঝা বয় পিঠে কাঁধে,
মানবতার যে ক্ষীয়মাণ শিখা মরুতে সঙ্গীহীন,
উমর তাহার দরদী বন্ধু,- আমীরুল মুমেনীন!
দারাজ দস্তে তার
আখেরী নবীর প্রিয় কাফেলার উত্তর-অধিকার।
সে খলিফাতুল মুস্লেমীন, সে প্রেমিক মুসলমান
তার বুক ভরা মখলুকাতের অনন্ত কল্যাণ,
বিরাট দিলের স্তরে স্তরে তার অশ্রুর পারাবার,
রাহমাতুল্‌লিল আলামীনের
সে নিশান-বরদার।

যে বিরাটদেহী দরদীর হাতে
তৃপ্ত এতিম শিশুর বুক,
সে শিশু জানে না- তার ক্ষুধায় যে
রান্না চড়ালো- সে-ই ফারুক!
অতন্দ্র তার দীঘল রজনী
দুঃস্থ, গরীব, দীন সেবার;
অনাথ নারীর দরজায় এসে
কাজ করে যেন ভৃত্য তার!

উট খুঁজে ফেরে একাকী খলিফা
আগুন যখন ধরার ‘পর!
সে যে বায়তুলমালের আমীর
শ্রেষ্ঠ খাদিম, সেরা চাকর!
জানি মুস্লিম জাহানের প্রিয়
দুঃস্থের সাথে বিত্তহীন,
মধু কেন্বারো পুঁজি নাই, কাটে
পীড়ায় তোমার কত না দিন!
জনতার কাছে মঞ্জুর হ’লে
পাও আহার্য, পাও বেতন,
সাম্যের মাঠে জনগণ সাথে
বহ ইস্লামী জয়-কেতন।

হে দারাজ দিল! তোমার কাছেই
দাবী-আবদারে আসে মানুষ,
হাসিমুখে তুমি সে দাবী মেটাও
নিখিল-দরদী মহাপুরুষ।
তোমার কাছেই আসে পথিকেরা
পরমাত্মীয়, হে মহা-প্রাণ!
তোমার গরীব ভাই খুলে নেয়
তোমার গা’য়ের ছেঁড়া পিরাণ,
দুর্ভিক্ষের দুর্দিন তুমি
কাটাও ক্ষুধিত অর্ধাহারে,
শত মুসাফির-খানার খাদিম
দাও জিন্দিগী মানবতারে।

তোমার আকাশে বিরাট শান্তি
দিক-দিগন্তে তারি খবর,
লক্ষ সূর্য ঠাঁই পায় হোথা
তোমার উদার বুকে উমর!
নীরব নিশীথ-কাফেলা-প্রহরী
তোমাকে চিনেছে সকল তারা,
তোমাকে পেয়েছে সঙ্গের সাথী
ঘরছাড়া যত সর্বহারা।

লুষ্ঠিত হ’লে মানবতা, তুমি
জাগো অনাচার বাঁধন টুটি,
প্রবল লাথিতে ভেঙে ফেলে ছেঁড়ো
সব জালিমের পাপের ঝুঁটি।

কত যে ক্ষুদ্র সঙ্কীর্ণের
বক্ষে দোর্রা হেনেছো বাজ,
আবর্তিত সে প্রণালীর পথে
সিন্ধু স্বপ্ন দেখে দারাজ…

সত্য ন্যায়ের সে পথে ভাঙুক সব সঙ্কীর্ণতা,
হারানো সে-দিন এ রাতের সাথে আবার বলুক কথা,
আসুক আবার এ হাতে আমার দোর্রা ও তল্ওয়ার
এই কলুষিত জীবনের বুকে হানিতে শেষ প্রহার।

এ নির্লজ্জ মানবতাহীন পশুদের যেথা ভীড়,
দ্বীনের রোশ্‌নি মুছে যারা টানে শামিয়ানা রাত্রির
সেথা উমরের দোর্‌রা হানিয়া আনো পথ মুক্তির
আনো আজাদীর শুভ্রতা, ভাঙো শঙ্কা ধরিত্রীর।
মহান নবীর খলিফা সে বীর।- তার আরব্ধ দিন
আমাদের হাতে হোক্ আজ ফিরে সুন্দর, রঙিন।

আজকে উমর-পন্থী পথীর দিকে দিকে প্রয়োজন
পিঠে বোঝা নিয়ে পাড়ি দেবে যারা প্রান্তর প্রাণ-পণ,
উষর রাতের অনাবাদী মাঠে ফলাবে ফসল যারা,
দিক-দিগন্তে তাদেরে খুঁজিয়া ফিরিছে সর্বহারা!
যাদের হাতের দোর্রা অশনি পড়ে জালিমের ঘাড়ে,
যাদের লাথির ধমক পৌঁছে অত্যাচারীর হাড়ে,
আগুনের চেয়ে নিষ্কলঙ্ক, উদ্যত, লেলিহান
যাদের বুকের পাঁজরে পাঁজরে বহে দরদের বান,
যারা খুলিয়াছে রুদ্ধ মনের সঙ্কীর্ণতা খিল
দারাজ দিলের আরশির ছায়া ধ’রেছে দারাজ দিল্
সে ভয়ঙ্কর, সেই প্রশান্ত মধ্যদিনের রবি,
এই মজলুম দুনিয়ার খা’ব- নিত্য ধ্যানের ছবি।
সেই সূর্যের প্রদাহে জ্বলুক এ তমসা-ম্লান রাত,
কাফেলা-সালার! তোমার দেখানো রাহে করি করাঘাত।
জ্বলে যাক্ এই ছলনা-বিলাস মিথ্যার কারসাজি,
তোমার দোর্রা খলিফা আমার হস্তে উঠুক বাজি
জাগুক সে দেখে শ্রান্তিমগ্ন উৎপীড়িতের দ্বার,
ক্ষুদ্র কামনা ভুলুক স্বপ্ন তার,
ভূলুক সে তার এ প্রগল্ভ বাচনিক মুখরতা;
কর্ম-বিলীন সে নিক তোমার প্রশান্ত নীরবতা …

শব্দিত নৈঃশব্দ্যের মাঝে যে কাফেলা চলে অনন্ত নিশিদিন,
যেথা চালকের হাতে চম্কায় দিবালোকে সংগীন,
উটের পায়ের আঘাতে উড়িছে ধূলি,
ছোটে একাগ্র সন্ধান করি নায়কের অঙ্গুলি,
তীব্র গতির ঘণ্টায় জাগে মহারণ্যের ঝড়;
যেখানে উমর সুবিশাল অন্তর
মরু আকাশের বিস্তৃতি তলে তুলেছে সকল কথা;
সুবিশাল বুক ভরি তার জাগে সুবিপুল নীরবতা।

সে জানে তারার সত্য, সে জানে সৌর কক্ষপথ,
সে জানে কোথায় ধূলি হ’য়ে ওড়ে অরণ্য, পর্বত,
কাফেলা-সালার সে মহানায়ক, আমীরুল মুমেনীন
চালনা ক’রেছে বিরাট জনতা সঙ্কেতে নিশিদিন।
সে খলিফাতুল মুস্লেমীন, সে প্রতিনিধি মুমীনের।
তার বুকে ছবি সব মানুষের পূর্ণ কল্যাণের।
তল্ওয়ারধারী, সে তস্‌বী-বাহী সে দরদী সর্দার
খুলেছে কা’বার পথে সে রুদ্ধ লাখো জং-ধরা দ্বার।

হে মদীনা মস্জিদের খাদিম! সুমহান ঝাড়ুদার
তোমার ঝাড়ুর ঝড়ে উড়ে যায় ক্লেদ মানবাত্মার,
বন্ধু তোমার দারাজ দস্তে শিলাদৃঢ় যে আইন,
তার সম্মুখে সমান কাতারে খলিফা ও মিস্কিন,
সূর্য প্রখর ন্যায়-রশ্মিতে নাই তিল অন্যায়
সকলে সমান নবীজীর দেওয়া সে বিধান-বন্যায়!
সব অসাম্য, সব বিভেদের করিয়াছো অবসান
শান্তি সাম্যে পুলকিত বুকে ওঠে গোলাবের গান।

মহাজীবনের বিকশিত ফুল নিয়ে সকলের আগে
তার কাফেলার বাঁশী বেজে চলে দুর্বার অনুরাগে,
কী বিচিত্র জৌলসে রাঙে নিথর রাত্রিতল,
জমাট পাথর জুলমাত ছিঁড়ে জাগে শিখা প্রোজ্জ্বল।
নতুন পথের মুবারক-বাদে আগ্নেয় বোররাক
সাত সাহারার সাইমুমে শশানে খোর্মাবীথির ডাক,
লাখো সিতারার মাঝে সে উজালা প্রদীপ্ত রোশ্নিতে;
উমর স্মৃতির আতশী বেদনা মখ্লুকাতের ভিতে।

আজকে এখানে মৃত মরুভূমি অচল এ মরুপোত,
বহে অসংখ্য বালুর তুফানে দিন রাত্রির স্রোত,
লু’ হাওয়ায় হেথা তীব্র পিপাসা,মৃত্যুর হাহাকার:
আজকে এখানে নিশীথ প্রহরী উমর জাগে না আর।
তবু অতীতের প্রশ্বাসে আজো ভরে নিখিল,
দরদী উমর। বন্ধু উমর। দারাজ দিল।।