বাঙালির মগজ, বাঙলা ভাষা ও পরীক্ষার খাতা

এক মার্কিন লেখক বলেছেন যে শতকরা নব্বইজন মানুষ মুক্তিসঙ্গত, সুশৃঙ্খল চিন্তা করতে পারে না; আর ভাষা যেহেতু চিন্তার প্রকাশ, তাই তাদের পক্ষে সুশৃঙ্খল শুদ্ধ বাক্য লেখাও অসম্ভব। পশ্চিমের বিদ্যালয়গুলোতে বেশ যত্নের সাথে শেখানো হয় কীভাবে লিখতে হয় শুদ্ধ, সুশৃঙ্খল, ব্যাকরণসম্মত বাক্য; কিন্তু অধিকাংশ ছাত্ৰই লিখে থাকে নিকৃষ্ট বাক্য। ওইসব বাক্যে যে ভুল শব্দ ব্যবহৃত হয়, কর্তাক্রিয়ার সঙ্গতি নষ্ট করা হয়, তাই সব নয়; ওই সব বাক্যে যে-চিন্তার প্রকাশ ঘটে, সে-চিন্তাই ব্যাধিগ্রস্ত। লেখক জানে না সে কী বলতে চায়, সে জানে না কোন শব্দের সাহায্যে সে বলতে পারে তার মনের কথা। তাই তার লেখা হয়ে ওঠে ব্যাধিগ্রস্ত; ভাষা হয়ে ওঠে দূষিত। পশ্চিমের সমাজবিজ্ঞানী, অর্থবিজ্ঞানী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও অন্য বিজ্ঞানীরা সরল ভাষায় কথা না ব’লে ব্যবহার করেন অসংখ্য নিরর্থক জাৰ্গন; তাতে বেশ গালফোলা ভাব প্রকাশ পায়, মনে হয় যেনো খুবই গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য বেরোচ্ছে; তবে হিসেব নিলে দেখা যায় ভেতরে বিশেষ বক্তব্য নেই। অরওয়েল এমন ভাষার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করেছিলেন। বাইবেলের একটি অসামান্য বক্তব্যকে জার্গনভরা ভাষায় প্রকাশ করলে কেমন হাস্যকর হয়ে ওঠে, অরওয়েল তা দেখিয়েছিলেন। দূষিত চিন্তা ভাষাকে দূষিত করে। রাজনীতিক কপটতাও ভয়াবহভাবে দূষিত করে ভাষাকে। স্বৈরাচারী ব্যবস্থায় কেমন ভাষা ব্যবহৃত হ’তে পারে, আর তাতে বাস্তব জগত হয়ে উঠতে পারে কতোটা অবাস্তব অরওয়েল তার বিভীষিকা জাগানো বিবরণ দিয়েছেন ‘নিউস্পিক’ নামক এক বিস্ময়কর ভাষারীতি তৈরি করে। স্টেইনার দেখিয়েছেন হিটলারের জার্মানিতে স্বৈরাচার ভাষাকে কতোটা দূষিত, নিরর্থক ও নিষ্প্রাণ করে তুলেছিলো। নাটশিরা উদ্ভাবন করেছিলো ‘চূড়ান্ত সমাধান’-এর মতো শব্দ, যার আক্ষরিক অর্থটি বেশ ভালোই মনে হয়; কিন্তু আসল অর্থ হচ্ছে ছয় লক্ষ মানুষকে গ্যাসের চুলোয় পুড়িয়ে মারা। সুভাষণ এখন রাজনীতিকদের খুবই প্রিয়; তাতে কালোকে রঙিন ব’লে প্রচার করা যায়। অনুন্নতকে ‘উন্নয়নশীল’ বললে বেশ চমৎকার লাগে, শক্তিহীনদের ‘ক্ষমতার উৎস’ বলতে বুক ভ’রে যায়, ভৃত্যকে ‘মন্ত্রী’ বললে মর্যাদার সীমা থাকে না। তোষামোদ করার জন্য সুভাষণ ব্যবহার করতে হয় অনবরত। নির্বোধকে ‘ধীরমেধাসম্পন্ন’, একনায়ককে ‘ত্রাণকর্তা’, স্বাধীনতাযুদ্ধে অনুপস্থিত ব্যক্তিকে ‘স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা’ বললে সুখশান্তিতে সময় কাটে। ভাষা প্রয়োগে যে-সমস্ত সাধারণ ত্রুটি ঘটে, সেগুলো কিছুটা যত্ন নিলে এড়ানো সম্ভব হয়; কিন্তু যেখানে গোলমাল ঘটে চিন্তায় সে-ত্রুটি কাটানো কঠিন। কারণ তাতে দরকার পড়ে মগজের চিকিৎসা। মগজকে সুস্থ ক’রে তোলা, তাকে সুশৃঙ্খল চিন্তায় শিক্ষিত ক’রে তোলার প্রক্রিয়া এখনো আবিষ্কৃত হয় নি। যারা বুঝতেই পারে না কী বলতে চায় তারা, যাদের চিন্তা জটপাকানো, যারা শব্দগুলোকে যথাযথ অর্থে অনুভবই করে না, তাদের পক্ষে সুস্থ বাক্য লেখা অসম্ভব। বাঙালির মগজ যে সুস্থ নয়, তারা যে বক্তব্য ঠিকমতো বিন্যস্ত করতে পারে না, এবং পারে না ওই বক্তব্যকে যথাযথ শব্দে প্রকাশ করতে, তা বোঝা যায় বাগ্মীদের বক্তৃতা শুনলে, সাপ্তাহিক ও দৈনিক পত্রিকাগুলো উল্টোলে, এবং চারপাশে যে-সব জ্ঞান ও সাহিত্যের বই চলছে, সেগুলো পড়লে। পুরোপুরি নির্ভুল লেখা আজকাল আর চোখে পড়ে না। একটি পুরোপুরি শুদ্ধ বাক্য শোনা এখন দুর্লভ ঘটনা। ‘সাতদিন থেকে বৃষ্টি হচ্ছে’, ‘বক্তৃতা প্রসঙ্গে তিনি বলে’ন, ‘পরবর্তীতে’ খুবই চলছে, এমনকি ‘মাতার ঔরসে’ও দেখেছি একটি পত্রিকায়। বাগাড়ম্বর করে চলছে সবাই, শুধু খেয়াল নেই শব্দ ও বক্তব্যের দিকে। এক পাঠক লিখেছেন, ‘প্রবন্ধে চমৎকার শব্দচয়ন, হৃদয়স্পর্শী মূল্যবোধ, শৈল্পিক অলংকারায়ন, অন্ন ও আশ্রয়হীন শিশুর প্রতি প্রচণ্ড মমত্ববোধ বাস্তবিক অর্থেই সাম্যবাদী সমবেদনায় বিদগ্ধ।’ খুবই গালভরা কথা; কিন্তু শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দূষিত ও নিরর্থক মূল্যবোধ কীভাবে হৃদয়স্পর্শী হয়, বোঝা কঠিন; এবং আরো কঠিন ‘সমবেদনায় বিদগ্ধ’ হওয়া। শব্দে যথাযথ অর্থও অধিকাংশ বাঙালি জানে না। টেলিভিশনের ‘অংকুর একদিন হবে কিশলয়’ গানটির কথাই ধরা যাক। অংকুর একদিন কিশলয় হবে, শুনতে বেশ; কিন্তু শুধু কিশলয় হওয়াই লক্ষ্য? কিশলয়-এর অর্থ ‘নতুন পাতা’; কিন্তু গানটি বোঝায় অংকুর একদিন মহীরূহ হবে। গানটি শুনে এখন কিশোরকিশোরীরা মনে করে কিশলয়ের অর্থ বিশাল গাছ। এভাবেই দূষিত হয়ে পড়ছে বাঙলা ভাষা; কারণ বাঙালির মগজই এখন দূষিত।

পরীক্ষার খাতায় পাওয়া যায় বাঙালির মগজের মর্মস্পর্শী প্রকাশ। বানান ভুলের কোনো শেষ নেই, বক্তব্যের কোনো ব্যাকরণ নেই, বাক্যের কোনো রূপ নেই- এ হচ্ছে পরীক্ষার খাতা; অধিকাংশ খাতা। পরীক্ষার খাতা দেখা হচ্ছে চিন্তার নর্দমায় সাঁতার কাটা বক্তব্যকে কতোটা অভাবিত, বাক্যকে কতোটা অসম্ভব বিকৃত এবং ভাষাকে কতোটা নিরর্থক করা যায়, তা দেখতে হলে পরীক্ষার খাতার কাছে আসতে হবে। কারো পক্ষে ইচ্ছে করে এতোটা বিকৃত বাক্য লেখা অসম্ভব, যেমন অসম্ভব এতোটা অস্বাভাবিক চিন্তা করা। এগুলো দেখেই বুঝতে পারি ওই যে চমৎকার জিনসপরা যুবকটি তার মগজে কী আছে; আর ওই যে লিপস্টিকরাঙানো যুবতীটি, তার মগজে কী ঘটছে। ‘সোনার তরী’ কবিতা সম্পর্কে এক পরীক্ষার্থী লিখেছে, রবীন্দ্রনাথ অনেক ধান বুনিয়াছেন, কিন্তু তাহার সমস্যা হইলো কবির কোনো নাও নেই।’ খুবই মৌলিক কাব্যসমালোচনা। অনার্স পরীক্ষার্থী একজনের এমন একটি খাতা পেয়েছিলাম যেটি তুলনাহীন। তার পাতায় পাতায় সোনা ছড়ানো। কিছুতেই বোঝা যাবে না তার মাথা থেকে কীভাবে এসব বস্তু উৎসারিত হয়েছে। তার খাতাটি থেকে আমি বেশ কিছু উদ্ধৃতি দিতে চাই, কারণ পুরো খাতাটিই উদ্ধৃতিযোগ্য। পরীক্ষার্থী লিখেছে, ‘কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র গৃহদাহ উপন্যাসের অপূর্ব সৃষ্টি। নায়ক চরিত্র অবলম্বনে মহিম ও সুরেশ প্রধান। সমসাময়িকভাবে নায়ক-নায়িকার প্রগাঢ় ভক্তি ও সহিষ্ণুতার বলে গৃহদাহ উপন্যাসখানি লিখে লেখক যশস্বী হয়েছেন।’ সে আরো লিখেছে, ‘মহিমা তার ভালোবাসার প্রতি স্নেহবশত সুরেশকে দিয়ে অচলার সান্নিধ্য লাভ করিয়েছে। অচলা দুর্বল হলেও ভালবাসা তাকে বিসর্জন দিতে পারে নি।’ সে আরো লিখেছে, ‘প্রেম চিরন্তন। ইহা জলে ডুবে না। প্রেমের মাধুরী মিশিয়ে লেখক এই দুই বিরোহীর জীবন রচনা করেছেন।’ অবরোধবাসিনী সম্পর্কে সে লিখেছে, ‘নারীরা বেগানা পুরুষদেরকে দেখা দিত না বলেই সে যুগের মুসলিম সমাজ বঙ্গ ভারতে এক অন্যতম প্রতিভার সৃষ্টি করে। রাজদরবারেও বেগম রোকেয়া স্মরণীয় হয়ে আছেন।’ সধবার একাদশী সম্পর্কে সে লিখেছে, ‘নাট্যকার এ নাটকটি লিখে সধবার একাদশীতে তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্তু দিয়েছেন। কবি মানসলালিত এই নাটকটি দীনবন্ধু মিত্রের হাস্যরসাত্মক এক অপরূপ সৃষ্টির সার্থকতা।’ সে আরো লিখেছে, ‘নাটক ও প্রহসন লিখে দীনবন্ধু মিত্র সধবার একাদশীতে তার উজ্জ্বল প্রাণমনের সন্ধিহান করেছেন। দীনবন্ধু মিত্রের সধবার একাদশী কার দোষে দোষী। এ কথার তুলনা করা বিরল।’ এ-ধরনের অলোকসামান্য উক্তি ব্যাখ্যা ভাষ্যে খাতাটি পুরিপূর্ণ। আমি এ-অসামান্য পরীক্ষার্থীর অপূর্ব মগজের ঘ্রাণ নেয়ার জন্যে দূরপাল্লার একটি টিকেট প্রায় কিনে ফেলেছিলাম, এখন দুঃখ হয়, কেনো যাই নি; কোটি টাকার মাথাটি কেনো দেখে আসি নি।

স্নাতক পরীক্ষার্থীদের কিছু খাতা দেখলাম সম্প্রতি। ওই সব খাতায় যে-বানান, ভাষা আর বক্তব্য, তা অলৌকিক। এগুলো দেখে মনে হয় শুদ্ধ বানান ব’লে কিছু নেই, বক্তব্য ব’লে কিছু নেই। রবিন্দ্রনাথ, শাধিনতা ষায়ত্ত্ব-সাশন, পৃয়া, হড়প্রাসাধ-এর মতো অভিনব বানান, আর ‘কবিগুরু শুকান্ত ভট্টাচার্য’, ‘বিশ্বকবি নজরুল ইসলামের’ মতো ভবিষ্যতের সাহিত্যসভার প্রধান অতিথির উক্তিতে এগুলো পৃর্ণ। একজন লিখেছে, ‘ভাষা হইচ্ছে মানুষের মূখজবানী’, আরেকজন লিখেছে, ‘হুজুর কেবলা রাত্রি হইলেই নারী জাতির জন্য বেশি আসক্ত হইতেন। বিশেষ করিয়া রূপবতী মহিলা দেখলে যৌন আসক্তে খুবই মশগুল থাকিত’; আরেকজন লিখেছে, ‘একটি পল্লীগ্রামে জীবনব্যবস্থা কিভাবে বিশৃঙ্খলা হয়ে গেল তারই আলেখ্যে সামশুদ্দীন আবল কালামের পথ জানা নেই গল্প হইতে আলোচনা হয়।’ একজন লিখেছে, ‘ক্ষুধিত পাশান গল্পে ক্ষুদার জালায় মানুষ কেমন পাষাণ হইয়ে যায় তাহার একটি ছায়াচিত্র আলোচনা করা হইয়াছে’, আরেকজন ‘একুশের রাজনৈতিক চেতনা’ সম্পর্কে লিখেছে, ‘তাই প্রতি বৎসর রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে প্রতি বৎসর ঐ দিনে কেন্দ্রিয় শহীদ মিনারে সমাবেশ তাদের আত্মার রুহের মাগফেরাত কামনা করে বারংবার নিজেদের রাজনৈতিক চেতনাকে জাগরিত করে’; এবং ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ সম্পর্কে একজন লিখেছে, ‘পৃথিবীর এই লিলাময় ভুবনের পরিবর্তনকে রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর ক্ষুদিত পাষাণে উল্লেখ করিয়াছেন যে মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জিব অথচ এই মানব জাতীয়ই সব প্রানির চেয়ে নিষ্টুর এবং পাষাণ।’ আরেকজন লিখেছে, ‘ক্ষুধিত পাশাণ গল্পে ক্ষুধার জ্বালায় যে মানুষ সব কিছু করিতে বাধ্য থাকে কবি শাসক ও শোশক শ্রেণীর প্রতি লক্ষ রেখে ‘ক্ষুধিত পাসান’ গল্পটি মূল্যায়ন করিয়াছেন।’ ‘ভিক্ষুকের জীবন’ সম্পর্কে একজন লিখেছে, ‘আমাদের প্রত্যেকের উচিত আমরা যারা স্বচ্ছল ব্যক্তি তারা যেন ভিক্ষুককে দেখে হিংসা করি না। ভিক্ষুকের জীবনে যে আত্মা আছে আমাদের প্রত্যেকের সেই আত্মা দিয়ে সৃষ্টি।’ বিভিন্ন বাগধারা দিয়ে তারা যে-সব বাক্য লিখেছে, সেগুলোও চিরস্মরণীয়। ‘কাকজ্যোৎস্না’ দিয়ে একজন বাক্য রচনা করেছে, ‘করিম ভালবেসে এক মহিলাকে বিবাহ করে তার চেহারা যেন কাকজোৎস্না’; আরেকজন লিখেছে, ‘রহিম কি যে লিখল যেন কাকজ্যোৎস্না’, আরেকজন লিখেছে, ‘তুমি আমার সাথে মিথ্যা কথা বলে কাকজ্যোৎস্না মেরেছো’ আর উদাহরণ দিতে চাই না। এগুলো থেকে কি বুঝতে পারি না সম্ভাব্য এ-স্নাতকদের মগজ পুরোপুরি প’চে গেছে? তারা হয়তো বিএ পাশ করবে, কি প্রশ্ন হচ্ছে মাধ্যমিক পাশ করলো কী ক’রে? বিসিএস-এর খাতাও দেখেছি একই রকম অবস্থা। পচা মগজের গন্ধে ভরপুর সে-সব খাতা। সংবাদপত্রেও দেখি নিউজপ্রিন্টের গন্ধ ছাপিয়ে ওঠে পচা মগজের সুঘ্রাণ, চাররঙা প্রচ্ছদের বইও পড়ি, সেখানেও একই সুগন্ধ। বাচাল মুদ্রাযন্ত্র এখন অক্লান্ত ছেপে চলেছে বাঙালির পচা মগজ; ও তার দুর্গন্ধ।