বস্ত্রবালিকারা

সকালে যখন ওদের দেখি, দেখি ওরা দল বেঁধে ছুটছে। একঝাঁক রােগা, কালচে, বিপন্ন বালিকা সমস্ত যানবাহনের কথা ভুলে কোনাে দূর গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ছুটে চলেছে, এবং সন্ধ্যার পরে, কখনাে রাত নটা, কখনাে দশটার দিকে, দেখি ওরা ছুটে ফিরছে। তবে এখন বেশ ক্লান্ত, ফেরার গতিও কম। ওরা বস্ত্রবালিকা। অধিকাংশেরই বয়স বেশ কম, থাকে হয়তাে কোনাে বস্তিতে হয়তাে শিশুকাল থেকেই ভালাে করে খায় নি, হয়তো এক সময় কোনাে বাসায় পরিচারিকার কাজ করতো; এখন দেশের পুঁজিবিকাশের জন্যে কাঠখড়লাকড়ির মতো পুড়ছে। চলার সময় ওরা কোনাে দিকে তাকায় না; কেউ ওদের দিকে তাকাক, তাও ওরা হয়তাে চায় না। লিপস্টিকরাঙা আধুনিকদের থেকেও ওদের আমি অনেক শ্রদ্ধা করি, মনে হয় এরাই খাঁটি নারীবাদী, যারা সমাজের অনেকগুলো শেকল ছিড়ছে। ঘরে না থেকে যে ওরা কোনো কাজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ছে, এটা এক বড়াে ঘটনা; এবং ওরা যে হেঁটে যায় গন্তব্যের দিকে, পয়সার অভাবেই হাঁটে, তবুও এটা প্রগতিশীলতার দিকে একটি বিশাল পদক্ষেপ। ওরা লিপস্টিকরঞ্জিতদের মতো সারাক্ষণ নিজেদের যৌনসামগ্রী ভাবে না, ভাবে কর্মী। বস্ত্রশিল্প পুঁজির কী বিকাশ ঘটিয়েছে, জানি না; তবে একগোত্র বন্দি, পীড়িত ৰালিকা, নারীকে মুক্ত করেছে স্যাঁতস্যাঁতে বস্তি ও সমাজ থেকে। বস্ত্রশিল্পের এ- এলাকাটি দেখা না দিলে এ-বালিকারা না খেয়ে থাকতাে, বাসায় ঝিয়ের কাজ করতাে, একবার কোনাে বুড়াের সাথে আরেকবার কোনাে বদমাশের সাথে বিয়ে বসতো, কয়েকটি সম্ভান জন্ম দিয়ে এক সময় হয়তাে দ্বারে দ্বারে ফিরতো। তখনাে হাঁটতাে, তবে কোনাে গন্তব্য থাকতাে না। এখন তারা কাজে যায়; কাজে যাওয়াই এক রকম মুক্তি। যে-বালিকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে কোনাে কাজে যায় না, ব্যবহৃত হয় কারাে বিনােদন সামগ্রীরূপে ও তাতে ধন্য বােধ করে, তার থেকে ওই নিরক্ষর, বিপন্ন আবেদনহীন বালিকাটি অনেক প্রগতিশীল ও শ্রদ্ধেয়। তবে পুঁজিবাদ দাতা নয়, শোষক, ওই বালিকাদের কল্যাণে দেশ জুড়ে বস্ত্রকারখানাগুলো খােলা হয়নি, খােলা হয়েছে পুঁজিপতিদের পুঁজি বাড়ানাের উদ্দেশ্যে। বস্ত্রশিল্পের মালিক হয়েছে চতুর ব্যক্তিরা, যারা সরকারি টাকা বাগাতে দক্ষ, যাদের উদ্দেশ্য অল্প সময়ে প্রচুর টাকা উৎপাদন করা। বস্ত্রশিল্প অল্পদিনের মধ্যেই পরিণত হয়েছে এক কেলেংকারিতে।

অবসরপ্রাপ্ত সামরিক ও অসামরিক কর্মকর্তারা, শ্রম ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের ঝানু আমলারা, সরকারের অনুগৃহীতরা মালিকরূপে দেখা দিয়েছে বস্ত্রশিল্পের; অনেক সুবিধা আদায় ক’রে নিয়েছে তারা রাষ্ট্রের কাছ থেকে; এবং বেশ ভালাে ব্যবসা করছে। উৎপাদন করছে, রপ্তানি করছে, কালােবাজারি করছে, আরো অনেক কিছু করছে, যা অসৎ পুঁজিবিকাশে অপরিহার্য। পুঁজিবিকাশের সাথে সাথে পাপের বিকাশ না ঘ’টে পারে না; তবে বস্ত্রশিল্পে পাপের পরিমাণটা একটু বেশি। আর ওই বস্ত্রবালিকারা, যারা উৎপাদন ক’রে চলছে নানা ধরনের শার্ট, খাদের ঘামের গন্ধলাগা শার্ট পরছে মার্কিন যুবক, তাদের অবস্থা কী? তারা কি ভালাে আছে, নতুন পুঁজিপতিরা কি তাদের মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার পারিশ্রমিক দিচ্ছে? নাকি বস্ত্রশিল্প দেশে সৃষ্টি করছে একটি করুণ, শােষিত নব্য দাসীসম্প্রদায়?

টমাস হুড “শার্টের গান” নামে একটি করুণ কবিতা লিখেছিলেন প্রায় দুশাে বছর আগে, যাতে শার্টশেলাইকারী এক বালিকার দুঃখ-দারিদ্র্য-যন্ত্রণা পুঁজিবাদের কলেপড়া প্রাণীর চিৎকার হয়ে বেজেছে। তার আঙুল অবশ ও জীর্ণ হয়ে পড়েছে, ভারী ও লাল হয় উঠেছে চোখের পাতা, তবু সে সুতাে গেঁথে চলেছে সুচে, শেলাই ক’রে চলেছে ভােরের মোরগের বাক শোনার সময় থেকে সন্ধ্যার পর আকাশে তারা ফোটা পর্যন্ত। তার জীবনে দুটি শব্দ স্টিচ! স্টিচ! স্টিচ! আর ওঅর্ক! ওঅর্ক! ওঅর্ক! ওঅর্ক! বেজে চলে শলাইকলের শব্দের মতাে। ফিতা পটি, জোড়া; আর জোড়া পটি, ফিতা করতে করতে বােতাম লাগানাের সময় সে ঘুমিয়ে পড়ে এবং স্বপ্নেই সে শেলাই ক’রে ফেলে জামার বােতামগুলাে। তবে তার জীবনসাথী ক্ষুধা ও দারিদ্র-পুঁজিবাদের অসহায় ক্রীতদাসী সে।

বাঙলাদেশের বস্ত্রবালিকারা বয়ে চলছে তারই উত্তরাধিকার- চৌদ্দ ঘন্টা খাটতে হয় তাদের, সকাল আটটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত; বেতন অতি তুচ্ছ। শোনা যায় মাসের শেষে তাদের পুরাে বেতন দেয়া হয় না, যার বেতন ছশাে টাকা তাকে দেয়া হয় চারশাে, বাকিটা চিরকালে জন্য বাকি থেকে যায়। অতিরিক্ত কাজের পারিশ্রমিকের আশ্বাস দেয়া হয় তাদের, তবে পারিশ্রমিকটা তারা হাতে পায় না। তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই, অসুখের সময় তারা কোনাে পারিশ্রমিক পায় না, চাকুরি ছেড়ে দেয়ার পর তারা তাদের প্রাপ্য অর্থ পায় না। তাদের অভিযােগ করারও কোনাে জায়গা নেই। তাই বস্ত্রশিল্প বস্ত্রবালিকাদের পরিণত করেছে বস্ত্রক্রীতদাসীতে, যারা গৃহপরিচারিকাদের থেকেও অসহায়। একটি মেয়ে এক সময় বস্ত্রশিল্পে কাজ করতাে, এখন কাজ করে আমাদেরই বাসায়। সে ওই কাজ ছেড়ে দিয়েছে, কারণ যা বেতন সে পেতো তাতে তার একারই চলতাে না। বস্ত্রশিল্প শােষণ শিল্পরূপে দেখা দিয়েছে; তা কয়েক লাখ অসহায় বালিকাকে শােষণ ক’রে কিছু লােকের পুঁজি বাড়িয়ে চলছে। আমাদের শোষণমূলক সমাজে পুরুষেরাই শােষিত পথে পথে, তবে পুরুষদের পুরুষত্ব সাধারণত শােষিত হয় না, কিন্তু শােষিত হয় নারীদের নারীত্বও। বস্ত্রবালিকারা মালিকদের যৌনশােষণেরও শিকার হয়ে থাকে। আর্থ ও যৌন শােষণ মিলে বস্ত্রশিল্প অমানবিকরূপ নিয়েছে।

বস্ত্রশিল্প দেশের পুঁজির বিকাশ ঘটাতে গিয়ে বিকাশ ঘটিয়েছে শােষণ ও পীড়নের; বস্ত্রবালিকাদের নারীশ্রমিক হওয়ার গৌরবও দেয় নি, দিয়েছে ক্রীতদাসীর কলঙ্ক। যে- বালিকাটি সকালে ঘুম থেকে ওঠেই প্রায় না খেয়ে ছোটে কারখানার উদ্দেশ্যে, সারাদিন খাটুনির পর ক্লান্ত পায়ে বস্তিতে ফেরে, পয়সার অভাবে যে রিকশার কথা ভাবতে পারে না, সে যদি জীবনে ন্যূনতম নিশ্চয়তাও না পায়, তাহলে সে কেনাে ওখানে ছুটবে? তবু তাকে ছুটতেই হবে, সে এমন সমাজে জন্ম নিয়েছে, যেখানে শােষিত বাধ্য হয়ে এগােয় শােষকের দিকে, অসহায় হরিণ এগােয় নেকড়ের দিকে। বস্ত্রশিল্পের জন্যে অবিলম্বে তৈরি করা দরকার মানবিক শ্রম আইন, যা বস্ত্রবালিকাদের সমস্ত স্বার্থ রক্ষা করবে। দেখতে হবে যাতে তারা ঠিক বেতন পায় ঠিক সময়ে, অতিরিক্ত পরিশ্রমের জন্যে যেনাে পায় অতিরিক্ত পারিশ্রমিক; যেনাে থাকে তাদের উপযুক্ত চিকিৎসা ও যানবাহন ভাতা, যেনাে অবসর নেয়ার পর তারা পায় উপযুক্ত ভাতা। এ-বিষয়ে এখনাে যে কোনো সুষ্ঠু নীতি প্রণীত হয় নি, এটাই বিস্ময়। প্রণীত না হওয়ার হয়তো কারণ আছে- সরকার সাধারণত অকাজেই ব্যস্ত থাকে, ঠিক কাজটি করার সময় হয় না তার; আর বস্ত্রশিল্পের মালিকেরা শক্তিমান পুরুষবর্গ, তারাই হয়তাে প্রতিরােধ ক’রে চলছে কোনাে নীতি প্রণয়নের সম্ভাবনাকে। এখন যেভাবে চলছে, সেভাবে চললে বস্ত্রশিল্প একটি জাতীয় কেলেংকারিতে পরিণত হবে; পুঁজিবাদের মুখ রক্ষার জন্যেই তাদের জন্যে সুষ্ঠু শ্রমনীতি অচিরেই প্রণীত হওয়া দরকার। যে-বালিকাটি ভাের হওয়ার সাথে সাথে ছুটছে কারখানার অভিমুখে, চোখ আর আঙুল জীর্ণ করে শেলাই করছে সতার মুখােশ, তার সাথে সভ্যতা যেনাে সভ্য আচরণ ক’রে: তাকে দেয় খাদ্য, বাসস্থান, নিরাপত্তা, তাকে ক্রীতদাসী না ক’রে তাকে যেনো দেয় মানুষের মর্যাদা, যা তার প্রাপ্য সহজাতভাবে।