বিভিন্ন রকম গন্ধ

বহু দিন পর আমি এসে এইখানে দাঁড়ালাম, একশো বর্গকিলোমিটার
জুড়ে আমার সামনে এখন অখণ্ড উদ্দাম সবুজ, আমি একে চিনি,
এবং চিনতে পারি না। ক-বছর হলো এখানে দাঁড়াই নি আমি? দশ?
বারো? বিশ? না পচিশ? হিশেব করতেআেমার ইচ্ছে হয় না।
উগ্র চৈত্রে আমি দাঁড়াই একটি অচেনা গাছের সবুজ ছায়ায়,
গাছটি চিনি না আমি, যখন ছিলাম আমি এ-পল্লীর
এ-গাছ ছিলো না; তবে তার ছায়া তার মতোই সবুজ, আমি ভালোবেসে
ফেলি তাকে; আমার সামনে একশো বর্গকিলোমিটার জুড়ে সবুজ ধানখেত।
আমার হৃদয়- নাকি মাংস- নাকি রক্ত ভ’রে ওঠে কোমল সবুজে।
আমি ঠিক বুঝতে পারি না আমার কেমন লাগছে,
যদি হতাম কৃষক এই প্রান্তরের হয়তো বুঝে উঠতে পারতাম
আদিগন্ত সবুজের অনুভূতি। যখন ছিলাম আমি এ-মাটির,
যখন ছিলাম আমি এ-জলের তখন নিবিড় সম্পর্ক ছিলো এসব জমির
সাথে এক বালকের। কতোবার সে-বালক দাঁড়িয়েছে।
এইখানে, চোখ ভ’রে দেখেছে সুন্দর, বুক ভ’রে নিয়েছে সুগন্ধ।
আমার বাল্যকালে এ-প্রান্তর এরকম একটানা সবুজ ছিলো না।
কোথাও কালচে ছিলো, ফিকে সবুজ কোথাও,
কোথাওবা ছিলো ঝলমলে সবুজ যেনো মাটির ভেতর থেকে
গলগল ক’রে উঠে আসছে সবুজের প্রচণ্ড প্রপাত, কোথাও বিবর্ণ,
আর কোথাও বিছিয়ে থাকতো রাশিরাশি অবর্ণনীয় সোনা।
আজ আমার চোখের সামনে আদিগন্ত ধানের সবুজ। আমি চিনি
এই ধান, এর নামও আমি জানি, আর যাকেই জিজ্ঞেস করি
সে-ই একটি অসুন্দর নাম বলে, তবে তাদের সবার চোখেমুখে
সুখ দেখে আমি সুখী হই। শুধু দুঃখ লাগে ওর কি কোনো
নাম হ’তে পারতো না রূপশালি আমন বা আউশের মতো হৃদয় ব্যাকুল
করা? তবে আমি সুখী, অজস্র রূপসী ধান আমার বাল্যকালকে
বাঁচাতে পারে নি ক্রুদ্ধ আকালের গ্রাস থেকে, দিকে দিকে আমি
দেখেছি ক্ষুধার আগুন, আমি সুখী এ-সবুজ নিভিয়েছে সেই
ভয়াবহ অগ্নির তাণ্ডব। আমি নেমে যাই ধানখেতে, হাঁটি আলপথে,
গন্ধ শুঁকি দুটি-একটি পাতা ছিড়ে! দিকে দিকে একই অভিন্ন গন্ধ আর রঙ
আমাকে বিবশ করে। তবু আমি হাঁটতে থাকি, হঠাৎ আমার
চোখের সামনে ঝলমল ক’রে ওঠে তিরিশ বছর আগের
এই সব জমি, রঙে আর গন্ধে ভ’রে ওঠে আমার শরীর। এটা সরষের
খেত ছিলো, সরষের তীক্ষ্ণ গন্ধ ঢুকতে থাকে
আমার গেঞ্জি আর জিন্স ভেদ করে, আমি দু-হাতে জড়িয়ে
ধরতে থাকি সরষের সরু সরু গাছ কে’পে উঠি
স্পর্শে; এই খেতে তিল হতে,দেখতে পাই, ঘন কালচে
সবুজ পাতায় মেঘলা হয়েছে জমিগুলো দেখতে পাই
হঠাৎ বর্ষা এসে গেছে, থইথই করছে চারদিক, তিল কাটা
হয় নি এখনো কেননা পাকতে তার আরো দু-একদিন
বাকি। এই খেতে পাট হত্যা, বিশাল বনের মতো এই খেতের ভেতরে
লুকিয়ে থেকেছি কতো দিন; পাটের পাতার গন্ধে
ভ’রে উঠেছে শরীর। এখানে তরমুজ হতো, এটা ছিলো ঘাসখেত,
এইগুলো বোরোজমি, সোনার মতোই ধান্ বিছিয়ে থাকতো,
ওখানে বেগুন হতো, লাউ আর কুমড়ো প’ড়ে থাকতো
মাটির চাকার মতো; এই চৈত্রে মাঠে কেনো গরু নেই?
দেখতে পাই লাল কালো শাদা গরু, ষাঁড়, অণ্ডহীন অসংখ্য বলদে
ভ’রে উঠেছে দূরের ঘাসখেত। এই একটানা সবুজের মধ্যে আমি ব’সে পড়ি,
আমার ভেতরে ঢুকতে থাকে ধান, পাট, তিল, সরষে, মটর,
তরমুজ, বাঙি, আমন, আউশ আর বোরোর সুগন্ধ।
কে যেনো আমাকে ডাকে দূর থেকে আমার হারানো নাম ধ’রে।