বন্ধুরা, আপনারা কি জানেন আপনারা শোষণ উৎপাদন করছেন

ঘামে গোশল করা, কালিঝুলিমাখা আমার প্রিয় শ্রমিক বন্ধুরা,
আমার আদমজির বন্ধুরা,
ডেমরার বন্ধুরা,
টঙ্গির বন্ধুরা,
খালিশপুরের বন্ধুরা,
আপনাদের সাথে আমার কিছু কথা আছে। তবে আপনাদের সাথে
আমার দেখা হওয়ার কোনো উপায়ই নেই। এই সমাজ
এই রাষ্ট্র আপনাদের ও আমার মধ্যে
তুলে দিয়েছে
আকাশের সমান উঁচু আর পাথরের থেকে শক্ত আর মৃত্যুর চেয়ে
হিংস্র নির্মম দেয়াল। ওই দেয়ার পেরিয়ে আপনারা
আমার দিকে আসতে পারেন না, আর আমি যেতে পারি না
আপনাদের দিকে। আমার চুলের ভাঁজ,
শার্টের রঙ,
আর কথা বলার ভঙ্গি থেকেই বুঝতে পারছেন আমরা পরস্পরের
থেকে কতো দূরে। আমরা দেয়ালের এ-পারে ও-পারে।
এই ধরুন রোম্যাটিসিজম শব্দটি আপনারা কেউ শোনেন নি,
বোদলেয়ারের নাম আপনারা জানেন না,
শীততাপনিয়ন্ত্রিত ঘরে আপনারা কেউ কোনো দিন ঘুমোন নি।
আর আমি জানি না হুইশালের শব্দে লাফিয়ে ছুটতে কেমন লাগে,
আমি জানি না বস্তিতে ঘুমোতে কেমন লাগে,
আমি জানি না খালিপেটে থাকার অভিজ্ঞতাটা কেমন।
বন্ধুরা, আপনাদের ও আমার মধ্যে হিংস্র দেয়াল
এই রাষ্ট্র এই সমাজ।
তবু আপনাদের সাথে আমার কিছু কথা আছে। জানি না
আমার সাথে আপনাদের কোনো কথা আছে কিনা?
বন্ধুরা একঝাঁক পিঁপড়ের মতো আদমজির বন্ধুরা
বন্ধুরা, একপাল ক্রীতদাসের মতো ডেমরার বন্ধুরা
বন্ধুরা, একদল দণ্ডিতের মতো টঙ্গির বন্ধুরা
খালিশপুরের,
রাজশাহির,
চাটগাঁর বন্ধুরা,
আপনারা কি জানেন আপনারা শোষণ উৎপাদন করছেন?
আপনাদের বলা হয় আপনারা উৎপাদন করছেন সম্পদ।
কিন্তু আপনারা কি জানেন কী ভয়াবহ, নিষ্ঠুর,
দানবিক সম্পদ আপনারা উৎপাদন ক’রে চলেছেন শরীরের রক্ত
ঘামে পরিণত করে? বন্ধুরা, প্রিয় শ্রমিক বন্ধুরা,
আপনারা দিনের পর দিন উৎপাদন ক’রে চলেছেন শোষণ।
আপনারা যখন সুইচ টিপে একটা কারখানা চালু করেন
তখন আপনারা চালু করেন একটা শোষণের কারখানা।
এই সমাজে এই রাষ্ট্রে
একটা চাকা ঘোরার মানে হচ্ছে
একটা ক্রূর শোষণের চাকা ঘোরা। এই সমাজে এই রাষ্ট্রে
একটি বেল্ট গতিশীল
হওয়ার অর্থ হচ্ছে শোষণের একটা দীর্ঘ বেল্ট গতিশীল হওয়া।
এই সমাজ এই রাষ্ট্র একটা বিশাল শোষণের কারখানা।
যখন কারখানার যন্ত্রপাতি থেকে ঝকঝক ঝিকঝিক শব্দ ওঠে তখন কি
আপনারা শুনতে পান না শোষণ, আরো শোষণ ব’লে
উল্লাসে চিৎকার করছে পুঁজিপতিদের আত্মা? এই সমাজে এই রাষ্ট্রে
যে-কোনো উৎপাদনই হচ্ছে ভয়াবহ হিংস্র শোষণ-উৎপাদন।
যখন আপনারা ব্লো-রুমে তুলো উড়োন,
কার্ডিং করেন, টাকুতে সুতো প্যাঁচান,
একটার পর একটা মাকু চালু করেন,
তখন আপনারা নিজেদের অজান্তে চালু করেন স্বেচ্ছাচারী স্বয়ংক্রিয় শোষণ।
যখন আপনারা একগুচ্ছ সুতো তৈরি করেন,
তখন আপনারা উৎপাদন করেন একগুচ্ছ শোষণ।
যখন আপনারা এক বেল কাপড় উৎপাদন করেন,
তখন আপনারা উৎপাদন করেন এক বেল শোষণ।
যখন আপনারা এক পাউণ্ড চা উৎপাদন করেন
তখন উৎপাদন করেন এক পাউণ্ড কালচে শোষণ।
আপনাদের ঘামে যুখন তৈরি হয় একটি সুতোর তন্তু
তখন পুঁজিপতির ঝকঝকে টেবিলে আসে এক ক্যান ঠাণ্ডা বিয়ার।
আপনাদের রক্তে যখন তৈরি হয় আধখানা শাড়ি
তখন গুলশানের পুঁজিপতির শীতল সেলারে ঢোকে এক বাক স্কচ।
যখন আপনারা একটি পুরো শাড়ি বানান,
তখন তার দরোজায় হাজির হয় ঝকঝকে নতুন মডেলের একটা জাপানি গাড়ি।
যখন এক ট্রাক পণ্য বেরিয়ে যায় কারখানার গেইট দিয়ে,
তখন সে নিউইয়র্কের অভিজাত এলাকায় কোনে একটা সুরম্য প্রাসাদ।
কিন্তু তখন আপনাদের পেট খালি,
আপনাদের স্ত্রীদের শরীর উদোম
আর চাষীদের ঘরে ঘরে হাহাকার। অর্থাৎ বন্ধুরা,
আপনারা যখন উৎপাদন করেন, তখন উৎপাদন করেন কুৎসিত শোষণ।
কিন্তু এই রাষ্ট্র এই সমাজ আপনাকে তা বুঝতে দেবে না, শুধু গোপনে গোপনে
দশকোটি মানুষকে শোষণের শেকলে জড়াবে।
বন্ধুরা, যখন আপনারা একটা সুইচ বন্ধ করেন তখনই
আসল উৎপাদন করেন আপনারা। তখন আপনারা উৎপাদন করেন
শোষণ
থেকে
মুক্তি।
একটা সুইচ বন্ধ করলে আপনারা
শোষণের একটা সুইচ বন্ধ করেন।
একটা চাকা বন্ধ করলে
আপনারা শোষণের একটা চাকা বন্ধ করেন।
একটা বেল্ট বন্ধ করলে
আপনারা শোষণের একটা বেল্ট বন্ধ করেন।
একটা কারখানা বন্ধ করলে আপনারা বন্ধ করেন একটা শোষণের কারখানা।
আর যখন আপনারা ডাকেন ধর্মঘট, হরতালে যান, শহরের পর
শহর আর রাষ্ট্র জুড়ে বন্ধ ক’রে দেন কারখানার পর
কারখানা, সমস্ত চাকা বন্ধ ক’রে দেন ডেমরায়, আদমজিতে,
খালিশপুর আর টঙ্গিতে তখন সারা রাষ্ট্রের শোষণ ব্যবস্থাকে
বন্ধ ক’রে দেন আপনারা। আর তখনি আপনারা উৎপাদন করেন
আসল সম্পদ। সেই সম্পদের নাম
শোষণ
থেকে
মুক্তি।
বন্ধুরা, যখন আপনারা শোষণ উৎপাদন বন্ধ ক’রে
শোষণ-থেকে-মুক্তি উৎপাদন করতে থাকবেন
দিনের পর দিন
সপ্তাহের পর সপ্তাহ
মাসের পর মাস
তখন বন্ধ হ’য়ে যাবে শোষণের সবচেয়ে বড়ো কারখানা,
যার নাম পুঁজিবাদী রাষ্ট্র। আর তখন দিকে দিকে
বাঙলার মেঘে মেঘে নদীতে নদীতে খেতে খেতে মাঠে মাঠে
ঘরে ঘরে কারখানায় কারখানায় সোনার সুতোর মতো উৎপাদিত
হ’তে থাকবে
শোষণ-থেকে-মুক্তি
শোষণ-থেকে-মুক্তি
আর শোষণ-থেকে-মুক্তি…