বন্যা ১৯৮৮

কিছু কিছু ভয়ঙ্করের জন্যে আমার মোহ আছে।
এমনকি ভালোবাসাও রয়েছে। ঝড়, দাবানল, বজ্রবিদ্যুৎ
আমাকে মোহিত করে। আমি মনে মনে এসবের
স্তব ক’রে থাকি। বন্যা আমার প্রাকৃতিক দেবতাদের একজন।
বন্যার কথা ভাবতেই এক প্রচণ্ড – বিশাল- মহৎ-
সুন্দরের স্রোত আমাকে প্লাবিত আচ্ছন্ন করে; আমি তার
আদিম ঐশ্বর্যে খড়কুটোর মতো ভেসে যাই। নুহের প্লাবনের গল্প
আমি প্রথম যখন শুনেছিলাম, আমার তখন
খুব ইচ্ছে হয়েছিলো ওই প্লাবনের সাথে ভেসে যেতে। আমি যদি
তখন থাকতাম, তাহলে নুহের নৌকোয় উঠতে
অনিচ্ছা প্রকাশ করতাম। ছেলেবেলায় একবার বন্যা দেখেছিলাম-
যেনো মাটি আর বস্তু আর মানুষের আশ্চর্য স্বাদ
পেয়েছে জলের জিভ, এমনভাবেই বাড়ছিলো জলের প্রবল সত্তা।
আমাদের বাড়িতে পানি উঠলো, আমরা ঘরে
উঠলাম। বুক জুড়ে ভয়, কিন্তু ভয়ের মধ্যেই আমি জলের রূপের
দিকে তাকিয়ে ভয়ঙ্কর মুগ্ধ হলাম। তারপর ছোট্ট নৌকো
নিয়ে কতো দিন ভেসে গেছি বন্যার জলে।
আমাদের কাজের মেয়েটিকে একদিন আমি ওই জলের দিকে
এমনভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখেছিলাম, মনে হয়েছিলো ও এখনি
ঝাঁপিয়ে পড়বে ঢেউয়ের বুকের ওপর। চারদিকে মানবিক
অসহায়ত্বের মধ্যেও ছড়িয়ে ছিলো আশ্চর্য
অসহ্য সুন্দর। আটাশির এই প্রচণ্ড বন্যায় ভাসছে বাড়ি, ঘর
পশু ও মানুষ। জলের কি দোষ আছে? জলের শুধু স্বভাব
রয়েছে। জলকে যেতেই হবে সমুদ্রের দিকে, সমুদ্রযাত্রায় জল কোনো
বাধাই মানে না। ওই শক্তিমান সহজেই তৈরি করতে পারে
পথ, শহরকে রূপান্তরিত করতে পারে থইথই সাগরে।
তাই তো তার পথ আজ কৃষকের কুঁড়েঘর, ধনীর দোতলা, পৌরসভা,
ঝকমকে শহর, আর তথাকথিত তিলোত্তমা রাজধানি।
বন্যা কি শত্রু? যে-বন্যা হানা দেয় গুলশান, বারিধারা আর
উত্তরপাড়ায় তাকে কি শত্রু ভাবা যায়?
একাত্তরে একবার আশ্চর্য বন্যা এসেছিলো, ওই বন্যায় ভেসে
গিয়েছিলো পাকিস্তান নামক একটা নোংরা বাঁধ।
আটাশির বন্যা আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে এক গভীর বন্যার
কথা। বন্যা এলে হেলিকপ্টার ওড়ে, কিন্তু আজ
এমন একটা প্রবল বন্যা দরকার যাতে বাঙলার মাটিতে কোনো
একনায়কের হেলিকপ্টার নামতে না পারে।
পানি কোথা থেকে এসেছে, তা নিয়ে বেশ তর্ক হচ্ছে আজকাল-
নষ্ট রাজনীতিক আর পচা পানিবিশেষজ্ঞরা
এরই মাঝে ঘোলা ক’রে ফেলেছে বন্যার বিস্তৃত জল। কেউ বলে,
পানি ভারত থেকে, হিমালয় থেকে এসেছে, কেউ আবার
পানির ভিন্ন ব্যাখ্যা দেয়। হিমালয়, অত্যন্ত দূরে,
এ জন্যে আমার খুবই দুঃখ হয়। আমার তো মনে হয়, এখুনি
আমাদের দরকার একটা একান্ত নিজস্ব হিমালয়।
পরদেশি প্লাবনে নয়, আমরা নিজদেশি প্লাবনে ভাসতে চাই।
আমাদের হিমালয় নেই ব’লে আমাদের এখনি
সৃষ্টি করা দরকার একটা নিজস্ব হিমালয়- স্রোত আর প্লাবনের
অনন্ত উৎস। কোথায় পাবো সেই হিমালয়?
আমি স্বপ্ন দেখি- দশকোটি বাঙালি কঠিন বরফের মতো জ’মে
গ’ড়ে তুলছে একটি বিশাল বঙ্গীয় হিমালয়। একদিন
বরফ গলতে শুরু করবে সেই গণহিমালয়ের চূড়োয়, প্রবল বর্ষণ
শুরু হবে পাদদেশে। গণহিমালয়ের গণবন্যায়
ভাসবে গ্রাম, উপজেলা, শখের রাজধানি, খড়ের কুটোর মতো
ভেসে যাবে শিরস্ত্রাণ, রাষ্ট্রধর্ম, জলপাইরঙ,
সাজানো তোরণ, সচিবালয়, শুয়োরের ঘৃণ্য খোয়াড়।
প্লাবনের ভেতর থেকে জেগে উঠবে বাঙলাদেশ:
পলিমাটির ওপর বাতাসে থরোথরো ধামের অঙ্কুর।