এক সপ্তাহ

বিশ্ববিদ্যালয় খুলেছে, অবশেষে শেষ হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অশুভ অনির্দিষ্ট কাল। ছাত্রছাত্রীরা ফিরে এসেছে, ফিরে এসেছে অধিকাংশই: – তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে, চোখের ঝিলিক দেখে, কষ্ঠস্বরের ভঙ্গি শুনে বোঝা যায় ফিরে আসার জন্যে তারা ব্যাকুল ছিলো কতোটা। যেনো প্রিয় মাতৃভূমি থেকে নির্বাসিত হয়েছিলো, অনেকে দিন উদ্বাস্তুর মতো ফিরেছে বিভুঁয়ে, ছিঁড়ে গিয়েছিলো তাদের সমস্ত শেকড়, নিভে গিয়েছিলো স্বপ্ন; কিন্তু ব্যাকুল হয়ে ছিলো মাতৃভূমির জন্যে; একদিন হঠাৎ মাতৃভূমিতে ফিরে আসার অনুমতি পেয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসতে পারাটাই সুখ, যদিও তাদের অসুখের অভাব নেই। ঝলমল করছে বিশ্ববিদ্যালয়, চৈত্রের রোদ তাকে আরো আলোকিত ক’রে তুলেছে। এক সপ্তাহ ধ’রে তারা আবার ক্লাশ করছে, ছুটছে কক্ষ থেকে কক্ষান্তরে, বারান্দাগুলো মুখর ক’রে রাখছে, ঢুকছে গ্রন্থাগারে, কেউ কেউ গিয়ে বসছে তাদের নিভৃত স্থানটিতে। কয়েক বছরে এতোটা শান্তির এক সপ্তাহ দেখি নি বিশ্ববিদ্যালয়ে। মিছিলের পর মিছিল নেই, হঠাৎ বোমা ফাটার আতংক নেই, সবাই যেনো বিশ্বাস করছে এখন কোনো অশুভ ঘটনা ঘটবে না। পরিবেশ এতো শান্ত, এতোই গ্রীতিকর যে পথে পথে দাঁড়ানো পুলিশের মুখের দিকে তাকিয়েও বিরক্তি জাগে না। যদি এমন শান্তি এক সপ্তাহের না হয়ে এক শতাব্দীর জন্যে আসতো, তাহলে সুখী হতাম। ছাত্ররা (=ছাত্রছাত্রী) ফিরে এসেছে, তবে শেষ নেই তাদের সমস্যার। পড়াশুনো কেমন হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে? খুব বেশি হয় না। ছাত্রদের যতোটা জ্ঞান দেয়ার কথা ততোটা দিতে পারে না বিশ্ববিদ্যালয়; এবং জ্ঞানসৃষ্টিতে অনুপ্রাণিত তো করেই না। আমাদের পাঠ্যবস্তু সংক্ষিপ্ত, অনেকাংশে পুরোনো ও বাতিল, তাও ঠিকমতো পড়ানো হয় না। অনেক শিক্ষক ক্লাশেই যান না, বা যান অনিয়মিত; অনেকে ক্লাশে গেলেও যে পাঠ দেন, তা না দিলেই হয়তো উপকার হতো। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এদিকে চোখ দেয় না। কোনো কোনো বিভাগে পড়ানো হয় শিক্ষকদের লেখা ভুল বই, ছাত্ররা ওই সব বই পড়তে বাধ্য হয়, কেননা শিক্ষক তার লেখা ভুল বইই পড়ান। যে-শিক্ষক বিষয়ই ঠিক মতো জানেন না, তিনিও বই লেখেন, আর তা অন্তর্ভুক্ত হয় পাঠ্যসূচিতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এদিকে মনোযোগ দেয়ার নৈতিকতা নেই। ছাত্ররা একবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকলে আর বেরোতে পারে না। চার বছরের পড়াশুনো, যা শেষ করা সম্ভব তিন বছরেই, তা গড়িয়ে গড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ে সাত-আট বছরে, ছাত্ররা প্রবীণ থেকে প্রবীণতর হ’তে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যে-কোর্স পদ্ধতি প্রবর্তন করেছে, তা পড়াশুনোকে সংকীর্ণ ক’রে দিয়েছে; পরীক্ষার ফলকে করেছে দূর থেকে দূরতর। এখন প্রথম বর্ষ অনার্স পরীক্ষা দিয়ে ফলের জনো ছ-মাস ব’সে থাকতে হয়, দ্বিতীয় বর্ষের পর ঘুমোতে হয় আটমাস; তৃতীয় বর্ষের পর এক বছর। ফলের অপেক্ষায়ই কেটে যায় জীবন। এখন যারা ফিরে এসেছে বিশ্ববিদ্যালয়ে, তারা সবাই ভুগছে এ-সমস্যায়। অনেকের পরীক্ষা হয়েছে আগে, কিন্তু জানে না কখন ফল বেরোবে; অনেকের পরীক্ষার কথা ছিলো অনেক আগে, জানে না কখন দিতে পারবে ওই পরীক্ষা। রাষ্ট্র তো তাদের নিষিদ্ধ ক’রেই রেখেছে। বছরের পর বছর ধ’রে বন্ধ রেখেছে ও রাখবে সরকারি নিয়োগ, কিন্তু রাষ্ট্র মেতে আছে তোরণ নির্মাণে, শীততাপ নিয়ন্ত্রণে, বিদেশযাত্রায়। অনেক দিন পর ছ-দিন পড়াশুনো হলো বিশ্ববিদ্যালয়ে, এক আশাতীত ভাগ্যের মতো মনে হয়। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের, এর পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব তাদেরই। তাদের বোঝা দরকার এখানকার পরিবেশ নষ্ট হ’লে ক্ষতি হয় শুধু তাদেরই। তারা কারা? তারা মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীর সন্তান। রাষ্ট্রকে যারা শাসনাশোষণ করছে, তাদের সন্তানেরা দেশে পড়ে না, থাকে না; তাই বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে শাসকশোষকদের কোনো উদ্বেগ নেই; বরং বিশ্ববিদ্যালয় নষ্ট হলেই তাদের লাভ। বিশ্ববিদ্যালয়ু বন্ধ রাখা, এর পরিবেশ নষ্ট ক’রে জ্ঞানচর্চা ব্যাহত করা আসলে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত বাঙালির বিরুদ্ধে এক সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। নিজেদের বিরুদ্ধে এ-ষড়যন্ত্র বাস্তবায়িত করার ভার নেবে কি তারা নিজেরাই?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জীবনে একটি নতুন পর্বও শুরু হয়েছে। এক উপাচার্য পদত্যাগ করেছেন, হয়তো তাকে বলা হয়েছে পদত্যাগ করতে এবং আরেক উপাচার্য দায়িত্ব নিয়েছেন। যিনি দায়িত্ব পেয়েছেন, তাঁর উপর শুধু নিজের সাফল্য নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাফল্যই নির্ভর করছে অনেকখানি। তাঁর বড়ো দায়িত্ব দুটি: বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা বা স্বায়ত্তশাসন রক্ষা ও প্রসারিত করা, আর বিশ্ববিদ্যালয়কে জ্ঞানচর্চায় উদ্যোগী ক’রে তোলা। তাঁর নিয়োগ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটি ছোটোগোত্র সংকট সৃষ্টির চেষ্টা করেছিলেন, এখন তারা হয়তো নিজেদের ভুল বুঝতে পেরেছেন। ওই সংকটটুকুর সৃষ্টি উদ্যোগ না নিলে পরিবেশ আরো সুন্দর হতো। যে-অধ্যাদেশটি রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের সবার, সেটিতেও রয়ে গেছে অনেক ত্রুটি। হয়তো এর প্রণেতারা মনোযোগ দেন নি রচনার সময়, বা তারা অনুকরণ করেছিলেন কোনো বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশ, তাই এখানে সেখানে খুঁত রয়ে গেছে অধ্যাদেশে। অধ্যাদেশটি ইংরেজিতে লেখা। এটিই অধ্যাদেশটির প্রধান দুর্বলতা। একটি দেশ স্বাধীন হলো, যে-স্বাধীনতার পেছনে রয়েছে দেশের ভাষাটি, ওই দেশের সংবিধান রচিত হলো রাষ্ট্রভাষায়, কিন্তু বিস্ময়কর ও লজ্জাজনক ব্যাপার হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশ রচিত হলো বিদেশি ভাষায়, ইংরেজিতে। এখনো আছে ইংরেজিতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকেরা যে বাঙলায় একটি অধ্যাদেশও লিখতে পারেননি- অধ্যাদেশের খসড়াটি তৈরি করেছিলেন তারাই, এটা তাদের বড়ো ব্যর্থতা ও অগৌরর। এ-লজ্জা ও অগৌরব কি কাটিয়ে ওঠার কোনো পথ নেই? বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট আড়াই বছর ধ’রে বসে নি, বসানোর উদ্যোগও নেয়া হয় নি। রেজিস্ট্রিকৃত স্নাতকদের কেউ কেউ মামলা ক’রে স্থগিত ক’রে দিয়েছিলেন সেনেট অধিবেশন। এই মামলাটির পেছনে কাজ করে নি শুভবুদ্ধি, অশুভবুদ্ধিই ছিলো তাতে প্রবল। আমাদের দেশে অশুভ এমনভাবেই শুভকে পর্যুদস্ত ক’রে রাখে। রেজিস্ট্রিকৃত স্নাতকদের মধ্যে থেকে সেনেটসদস্য নির্বাচনের যে-পদ্ধতি নির্দেশিত আছে অধ্যাদেশে, তা অপব্যবহার ক’রে রেজিস্ট্রিকৃত স্নাতকদের একগোত্র অধ্যাদেশকে অসম্মান করেছেন। একটি মাত্র ঠিকানায় যদি যায় হাজার হাজার ভোটপত্র, আর তা যদি পূরণ করেন কয়েকজন, নির্বাচিত করিয়ে নেন নিজেদের, তাহলে তাকে সৎ পদ্ধতি বলা যায় না। তাই প্রস্তাব করা হয়েছে সরাসরি ভোটের। এ ছাড়া অধ্যাদেশের চেতনাকে মূল্য দেয়ার কোনো উপায় নেই। এখনও আরো কোনো কোনো অংশে সংশোধিত হ’তে পারে অধ্যাদেশ, তৰে ওই সংশোধনের পেছনে থাকতে হবে শুভবোধ, ষড়যন্ত্রমূলক অণ্ডত কোনো সংশোধন গ্রহয়োগা হবে না। সরকারকে পুরোপুরি হাত গুটিয়ে নিতে হবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পেশাগতভাবেও আকৃষণীয় ক’রে তোলা দরকার বিশ্ববিদ্যালয়কে। পেশাগতভাবে বিশ্ববিদ্যালয় একটি নিকৃষ্ট স্থান, এখানে যোগ দেয়ার অর্থ হচ্ছে জীবন দুর্বিষহ ক’রে তোলা। পারিশ্রমিক এখানে এতো কম, সুযোগ-সুবিধা এতো সীমাবদ্ধ যে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হওয়ার চেয়ে দারোগা বা শুল্কপরিদর্শক হওয়া অনেক সুবিধাজনক। এ-অবস্থা থেকে উদ্ধার করা দরকার জ্ঞানকেন্দ্রকে। সামনের কয়েকটি মাস অত্যন্ত গুরুতুপূর্ণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যে; এ-সময়েই আমরা বুঝতে পারবো বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসবে কিনা জ্ঞানের প্রশান্ত পরিবেশ, থাকবে কিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা। চাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনেক দিন পর এক সপ্তাহ শান্তি পেয়েছে, তবে তার দরকার অন্তত একশতকের শান্তি।