গুন্টার গ্রাসের নায়ক শৈশবেই ঠিক করেছিলো সে আর বড়ো হবে না। ওটুকু বয়সেই সে চারপাশে যতো পাপ দেখেছে, তাই যথেষ্ট তার জন্যে। বড়ো হওয়ার বদলে সে বেছে নিয়েছিলো তার টিনের ঢাক বাজিয়ে বেড়ানোর সুখ। আমার এখন বড়ো বেশি ইচ্ছে হয় শিশু হয়ে যেতে; ইচ্ছে হয় ফিরে যাই শৈশবে, সে-পুকুরপাড়ে, গাছের ছায়ায়, ধানখেতের আলে, খেলার মাঠে, বৃষ্টির শব্দের ভেতরে, খেজুর রসের সুগন্ধে। যদি থেকে যেতে পারতাম বাঁশবাগানের চাদের নিচে, থোকায় থোকায় জোনাকির আলোতে, কার্তিকের কুয়াশায়, মাঘের শিশিরে; থেকে যেতে পারতাম যদি মাছরাঙা আর আমের বোলের সংস্পর্শে, তাহলে এতো বিষ পান করতে হতো না, এতো পাপের কামড় সহ্য করতে হতো না। আমার মতো অনেকেই হয়তো এরকম বোধ করে আজকাল। যদি শিশু হয়ে যেতে পারতাম বা থেকে যেতে পারতাম সেই গ্রামের কিশোর, তবে ভোগ করতে হতো না শয়তানের কপটতা, একনায়কের গণদরদ, মূর্খের পণ্ডিতি, স্বার্থপরায়ণের নিঃস্বার্থপরতা, অসতীর সতীত্ব, শোষকের সমাজসেবা, প্রতিক্রিয়াশীলের প্রগতিশীলতা, অন্ধের অন্তদৃষ্টি, বামনের আকাশচুম্বিতা, ষড়যন্ত্রকারীর মহত্ত্ব, অসত্যের সততা। যা শুনতে চাই না, তা শুনতে হতো না; যা দেখতে চাই না, তা দেখতে হতো না; যা বিশ্বাস করি না, তা বিশ্বাস করতে হতো না। এখন ডুবে আছি অতল আবর্জনার মধ্যে। এ-সমাজরাষ্ট্রসভ্যতা হয়ে উঠেছে এক বিশাল আবর্জনাস্থল, একে বদলে দেয়ার শক্তি নেই আমার, এর বদলের কোনো সম্ভাবনাও নেই। এতে গ্রস্ত হচ্ছি আমি ও আমার মতো অসংখ্য মানুষ। তাই ইচ্ছে হয় চলে যাই শৈশবে। যদি। যেতে পারতাম শৈশবে, যখন আমার চোখের সামনে শুধু স্বপ্ন ছিলো। এখন কোনো স্বপ্ন নেই, চোখে শুধু অন্ধকার। যা দেখছি চারপাশে, তাতে প্রতিটি শিশুকে বলতে ইচ্ছে হয়: শিশুরা তোমরা বেড়ো না; শিশু থেকে যাও। যদি বাড়ো, কিছু পাবে না; শুধু স্বপ্নটুকু হারাবে। তুমি যদি বেড়ে ওঠো শিশু, তবে দেখবে পাপের কোনো শেষ নেই, তুমিও জড়িয়ে পড়বে ওই পাপে। এ-সমাজ নষ্ট করবে তোমাকে, যদি তুমি নষ্ট না হও তবে বিনষ্ট করবে তোমাকে। এ-রাষ্ট্র তোমার ভেতরের মানুষটিকে ক’রে তুলবে পশু। এ- সভ্যতা তোমাকে পরিণত করবে মধ্যযুগের অন্ধে। শিশু, তুমি বেড়ো না; তবে আমার মতো যন্ত্রণায় জ্বলবে। দানবেরা নিয়ন্ত্রণ করবে তোমাকে, লুসিফার হয়ে উঠবে তোমার প্রভু। তার হাতে তুলে দিতে হবে তোমার আত্মা। শিশু তুমি বেড়ো না। আমি যে- ভুল করেছি, তুমি সে-ভুলের শিকার হয়ো না। বরং আমি তোমার মতো শিশু, তোমার মতো কিশোর হয়ে যেতে চাই।
মনে পড়ে পুকুরের হাঁসগুলোকে, কচুরিপানাকে, হিজলের লাল চেলিকে। একটি বাছুর লাফিয়ে চলছে বিলের দিকে, আকাশে মেঘ করেছে, খেজুরের রস জমছে হাঁড়িতে, কুয়াশা নেমে আসছে, টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ হচ্ছে। এসবের মধ্যে কোনো পাপ ছিলো না, আবর্জনা ছিলো না। অঘ্রাণের পাকা ধানে, জমিতে ছড়িয়ে থাকা খড়ে কোনো কপটতা ছিলো না। ওই নিষ্পাপতার পৃথিবী থেকে আমি এখন কোথায় উঠে এসেছি ভাবলে হাহাকার ক’রে উঠতে ইচ্ছে হয়। যে-রাজনীতি নিয়ে দিনরাত ব্যস্ত থাকছে রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপক থেকে নর্দমার কীটেরা, তার কথা ভাবলে ঘেন্নায় সৌরলোক প্লাবিত হয়ে যায়। ক্ষমতাধিকারী দল আর বিরোধী দল, জনসভা, মিছিল, হরতাল, ভেতরে ভেতরে সম্পর্ক, আমদানিরপ্তানি, পারমিট, দুপুরে সরকারে বিরুদ্ধে সংগ্রাম রাতে সম্প্রীতি, গরিবের নামে উত্তাল আবেগ আর শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসবাস হোষ্টেল, মোটেল, পাঁচতার, শহীদ মিনার, দালালি, বড়ো বড়ো বুলি, প্রগতিশীলতা আর গোপনে সুবিধাবাদ এসব দেখে শুনে কার ইচ্ছে হয় থাকি এ-অতলান্তু আবর্জনার মধ্যে? বেড়ে ওঠায় বিশেষ সুখ নেই। বেড়ে ওঠার অর্থ কামড়াকামড়ি, বেড়ে উঠার অর্থ থুতু ছিটাছিটি, বেড়ে উঠার অর্থ পেছনে ছুরি মারামারি। দাঁতে সবসময় লেগে থাকে প্রতিদ্বন্দ্বী কুকুরের ছেড়া মাংস আর রক্ত, মুখে লেগে থাকে বদমাশের থুতু, পিঠে সব সময় গেয়ে থাকে বিষাক্ত ছুরি। এই তো বেড়ে ওঠা বাঙলাদেশে বেড়ে ওঠা হচ্ছে স্বর্গ ছেড়ে নরকের দিকে যাত্রা, বেড়ে ওঠা হচ্ছে চাঁদের দিকে পিঠ ফিরিয়ে মারাত্মক চুল্লির দিকে এগোনো। কোনো বেড়ে-ওঠা মানুষের বুক যদি খুলে দেখা যেতো, তাহলে দেখা যেতো সেখানে কোনো বৃষ্টির ফোঁটা নেই, পানির কম্পন নেই, ফুল নেই, নদী নেই, সবুজশ্যামল বনভূমি নেই। সেখানে আছে পোড়া কাঠ, কয়লা, জংধরা ছুরিকা, নিহত প্রতিদ্বন্দ্বী, এমন কি নিজের লাশ। এই তো বেড়ে ওঠা। বেড়ে উঠতে হ’লে পেরিয়ে আসতে হয় অনেক নিষিদ্ধ গলি, পিষে আসতে হয় নিজেরই অসংখ্য মৃতদেহ। আমি এভাবে বেড়ে উঠতে চাই নি, চাই না শিশুরা বেড়ে উঠুক এভাবে।
জানি শৈশবে ফিরে যাওয়ার কোনো পথ নেই; কোনো উপায় নেই শৈশবে থেকে যাওয়ার। কিন্তু এ-অসম্ভবেরই আরাধনা করি আমি। এ যদি পলায়নবাদ হয়, তবে তাই। নষ্ট সময়, সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতিতে থাকার চেয়ে পালিয়ে বাল্যকালে চ’লে যাওয়া অনেক ভালো। কোনো সংঘের প্রধান হওয়ার চেয়ে ভালো বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকা, মুখে কুয়াশা মাখা। রাজপথকে উচ্ছ্বসিত ক’রে তোলার চেয়ে অনেক সুখের ভোরের রোদে ব’সে থাকা। শীততাপনিয়ন্ত্রিত কক্ষে ব’সে থাকার চেয়ে অনেক সুখকর শিশিরে পা ভিজিয়ে কুড়েঘরের দিকে ফিরে আসা। অজস্র মাইক্রোফোনের আকুল চিৎকারে সাড়া দেয়া থেকে একটি বুনোপাখির ডাকে কেঁপে ওঠা অনেক মধুর। তাত্ত্বিকদের উৎকট তত্ত্ব, প্রয়োগবাদীদের প্রণালিপদ্ধতি, অজস্র সম্মেলনের থেকে সুখকর পুকুরের ঠাণ্ডা পানিতে সাঁতার দেয়া। বাঙলার দিকে দিকে লাখ লাখ শিশু বেড়ে উঠছে, যেমন বেড়ে উঠেছিলাম আমি একদিন। তাদের অধিকাংশরই অবশ্য পরার পোশাক নেই, ঘুমোনোর ঘর নেই, মাটির বাসনে ভাত নেই। তাদের বাল্যকালই নেই। তাদের বাল্যকালই দোজখের চেয়ে দুঃস্বপ্ন। তাদের তো ফিরে যাওয়ার কথা মায়ের উষ্ণ জরায়ুতে। তাদের আর কোনো ভালো গন্তব্য আমি দেখি না। যারা বেড়ে উঠেছে আমার মতো, পোশাক-ভাত-ঘর যাদের সমস্যা নয়, তারা একদিন স্বপ্ন নিয়ে সমসায় পড়বে। বাঙলার কর্কশ আগুনে তাদের সবুজ পুড়ে যাবে, কয়লা হয়ে উঠবে তাদের আত্মা। তাদের মর্মস্পর্শী ভবিষ্যতের কথা ভেবে শিউরে উঠি। জড়িয়ে পড়বে তারা অজস্র পাপে। রাজনীতি তাদের শয়তান ক’রে তুলবে, সমাজ তাদের ক’রে তুলবে পিশাচ, রাষ্ট্র তাদের করে তুলবে পাপিষ্ট। শিশুদের জন্যে এমন ভবিষ্যৎ কী করে প্রার্থনা করি? আমি নিজেই তো ফিরে যেতে চাই শৈশবে, আম আঁটির ভেঁপু বাজিয়ে জানাতে চাই: শিশুরা, তোমরা বেড়ে না, বাড়লে একদিন তোমাদের অনুশোচনা করতে হবে। এখানে বেড়ে ওঠা পাপ, এখানে বেড়ে ওঠা দুঃস্বপ্ন।