জীবনযাপনের শব্দ

এক সময় আমরা শহরের এমন এক এলাকায় থাকতাম, যেখানে
আমিই ছিলাম সবচে গরিব। গাড়ির কোমল হর্ণ
ছাড়া আর কোনো শব্দই শোনা যেতো না সেখানে
সোনালি নৈঃশব্দে পা থেকে মাথা পর্যন্ত মোড়া ছিলো
আবাসিক এলাকাটি। আমিই ছিলাম সবচে গরিব,
তাই আহারের পর মাঝে মাঝে আমি আয়েশের সাথে খক খক ক’রে কাশতাম।
আমার কোনো অসুখ ছিলো না। কিন্তু একটু কাশলে আমার বেশ
ভালোই লাগতো। আমি যখন তখন চিৎকার ক’রে কাজের
মেয়েটিকে ডাকতাম। আমার স্ত্রী সম্ভবত আমার চেয়ে ধনী ছিলো, চিৎকার
ক’রে সে কখনো কাউকে ডাকতো না। অবাক হয়ে আমি শুনতাম
আমার স্ত্রীর কাশি কখনোই চুম্বনের শব্দের থেকে একটুও উঁচু নয়।
তার হাঁচি গোলাপের পাপড়ি ঝরার মতোই নিঃশব্দ নীরব।
আমার মেয়ে দুটি জন্মে ছিলো সম্ভবত আরো ধনী হয়ে।
ওদের কখনো আমি কাঁদতে বা হাসতে শুনি নি।
একবার সাতদিন আমি ওদের কোনো কথা না শুনে ছুটে গিয়েছিলাম
এক নাককানগলা বিশেষজ্ঞের কাছে। তিনি জানিয়েছিলেন
আমার কন্যাদের স্বরতন্ত্রি জোহাবার্গের সোনার চেয়েও উৎকৃষ্ট
ধাতুতে গঠিত। তাই সেখান থেকে
নীরবতার সোনা ছাড়া আর কোনো বস্তুই ঝরে না।
একবার বাধ্য হ’য়ে আমাকে থাকতে হয়েছিলো শহরের এমন এক এলাকায়,
যেখানে গরিব কাকে বলে তা কেউ জানে না।
সেখানে গাড়ির হর্ণ থেকেও কোনো শব্দ ওঠে না, শুধু ঝলকেঝলকে
তাল তাল সোনা ঝ’রে পড়ে।
ওই এলাকার গোলাপগুলো গান গাওয়া দূরে থাক, অন্যমনস্ক হয়েও
উঁচু গলায় কারো নাম ধ’রেও ডাকে না। একটা গোলাপকে আমি- ‘এই যে গোলাপ’
বলতেই সে নিঃশব্দে লুটিয়ে পড়লো। বুঝলাম ওই রঙিন নিঃশব্দ সৌন্দর্য
এমন বর্বরের মুখোমুখি ইহজন্মে কখনো পড়ে নি।
একটু শব্দের জন্যে আমি প্রচণ্ড জোরে বন্ধ করলাম দরোজা,
ঐন্দ্রজালিক দরোজা কেমন নিঃশব্দে বন্ধ হয়ে গেলো।
স্নানাগারে পিছলে পড়লাম, আমার পতনে একটুও শব্দ হলো না।
একটা বেড়ালের সাথে কথা বলার চেষ্টা করলাম,
কিন্তু ওই রূপসীর গলা থেকে শুধু গলগল ক’রে সোনা ঝরতে লাগলো।
এখন আমরা শহরের এমন এক এলাকায় থাকি, যেখানে
আমরাই সবচেয়ে ধনী। আমাদের পাঁচতলা ঘিরে আছে গরিবেরা।
গরিবদের প্রাণ কি বাস করে স্বরতান্ত্রিতে? তাদের জীবন কি গলা দিয়ে
গলগল ক’রে বেরিয়ে আসে প্রচণ্ড প্রচণ্ড শব্দ হ’য়ে?
ঘরে ঢোকার সময় গরিবেরা ভয়ংকরভাবে ডাকাডাকি করে,
আবার ঘর থেকে বেরোনোর সময় ডাকাডাকিতে কাঁপিয়ে তোলে পাড়া।
এমন জোরে তারা ঝাপ করে যে
ওই ঝাপ আরো অনেক বেশি ক’রে খুলে যায়।
এক সন্ধ্যায় মাইক বাজিয়ে বিকট শব্দে তারা ফিল্মিগান শোনে,
পরের সন্ধ্যায় একই মাইকে শোনে ধর্মের কাহিনী।
তাদের অধিকাংশেরই ঘরে বিদ্যুৎ নেই, কিন্তু পাড়ায় বিদ্যুৎ চ’লে গেলে
তারা স্বয়ংক্রিয়ভাবে একজোটে চিৎকার ক’রে ওঠে
আবার যখন বিদ্যুৎ ফিরে আসে, তখনো তারা চিৎকার ক’রে ওঠে একজোটে।
ওদের হাসির শব্দ শোনা যায় পাঁচতলা থেকে।
ওদের কান্নার শব্দ সম্ভবত শোনা যায় দশতলা থেকে।
সকালে বস্তির কোনো পুরুষের গলার আওয়াজ শুনেই বোঝা যায়
রাত্রে শারীরিক মিলনে সে অসম্ভব তৃপ্তি পেয়েছে।
আর নারীর হাসির ঝংকার থেকে বোঝা যায় শরীর
সারারাত দলিতমথিত হয়ে ভোরবেলা তার কণ্ঠে
জন্ম নিয়েছে এই বিস্ময়কর কলহাস্য।
পাঁচলায় যখন নিচ থেকে একটা শিশুর তীক্ষ্ণ চিৎকার ছুটে আসে
তখন বোঝা যায় মায়ের স্তনের বোঁটা থেকে খ’সে গেছে তার ওষ্ঠ।
ক্ষুধা এখানে চিৎকার হ’য়ে গলা দিয়ে বেরিয়ে আসে।
আনন্দ এখানে কোলাহল হ’য়ে গলা দিয়ে বেরিয়ে আসে।
গরিবদের অশ্রু বেরোয় গলা দিয়ে বিশাল বিশাল শব্দের ফোঁটা হয়ে।
গরিবদের কাম গলা দিয়ে বিস্ফোরিত হয়।
তাদের জীবন গলা দিয়ে বেরিয়ে আসে বজ্রের মতো।
শুনেছি বার বার যে নৈঃশব্দ সোনালি।
কিন্তু এখন কে জানে না নৈঃশব্দ হচ্ছে কূটচক্রান্তের মাতৃভাষা?
তাহলে ধনীদের জীবন কি এক ধারাবাহিক
নিঃশব্দ সোনালি চক্রান্ত?