যদি তুমি বাঙলায় জন্ম নিয়ে থাকো

ভাগ্য বলে কিছু নেই তবে একটি ক্ষেত্রে আছে, সেটি জন্মের ক্ষেত্রে। জন্মটাই একমাত্র ভাগ্য, যা জীবনটাকে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত শাসন করে। রাজার পুত্র হয়ে জন্ম নিলে জীবন এক রকম হয়, ভিখিরির পুত্র হয়ে জন্ম নিলে হয় পুরোপুরি উল্টো। রাজপুত্র গাধা হ’লেও মহাপুরুষ, গরিবপুত্র সিংহ হ’লেও সামান্য। রাজাকারের পুত্র হ’লে জীবন চমৎকার, মুক্তিযোদ্ধার পুত্র হ’লে দুর্বিষহ; সৎমানুষের পুত্র হ’লে জীবনটা কাঠকয়লা আর কালোবাজারির পুত্র হ’লে জীবনটা হিন্দি ছায়াছবির মতো উত্তেজক। তারপর কোন দেশে জন্ম হলো, সেটা এক বিরাট ব্যাপার। দেশটিই ঠিক করে দেয় জীবনটা স্বর্গবাস হবে নাকি হবে বাস্তব নরকবাস। আমেরিকায় জন্মালে জীবন যা হয়, বাঙলাদেশে জন্মালে হয় তার বিপরীত; বিলেতে জন্মালে জীবন যা হয়, বাংলাদেশে জন্মালে হয় তার সম্পূর্ণ উল্টো। বাংলাদেশে জন্মালে কী হয়, কেমন হয় জীবন? বাঙলাদেশে জন্মালে ধ’রে নিতে হবে জন্মের সময়ই মৃত্যু হতে পারে; বেঁচে থাকলে অনাহারে খাকতে হতে পারে; বাঙলাদেশে জন্মালে রোগ খুবই হবে, চিকিৎসা হবে না, হ’লেও নামমাত্র হবে; হাসপাতালে গেলে ওষুধ মিলবে না, ওগুলো হাসপাতালের শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিরা গোপনে বিক্রি ক’রে দেবে; বাঙলাদেশে জন্মালে ধ’রে নিতে হবে লেখাপড়া হবে না, পরীক্ষা দিলেও অধিকাংশই পাশ করবে না, পাশ করলেও চাকুরি পাবে না। বাঙলাদেশে জন্মালে, ধ’রে নিতে হবে, জীবনটা কাটবে শক্তিমানদের খামখেয়ালির ওপর। শক্তিমানেরা চাইলে নদী শুকিয়ে ফেলা হবে, না চাইলে পথের ওপর দিয়ে নদী বইবে; শক্তিমানের চাইলে অসম্ভব সম্ভব হয়ে উঠবে, না চাইলে সম্ভবপর সব কিছু চিরঅসম্ভব থাকবে। শক্তিমানেরা চাইলে এখানে নিষ্পাপ দণ্ডিত হতে পারে; না চাইলে মৃত্যুদণ্ডিত মুহূর্তে নিষ্পাপ হয়ে উঠতে পারে। এখনো কোনো নিয়ম নেই, সবই চলে অনিয়মে, ও শক্তিমানদের কামনাবাসনা অনুসারে। বাঙলাদেশে জন্ম নিলে, ধরে নিতে হবে, জীবনটা পুরোপুরি অন্যের খেয়ালের ওপর ভর ক’রে থাকবে, পদ্মপাতায় টলমল করবে; যে-কোনো মুহূর্তে ঝরে যাবে। এখানে কোনো অধিকার নেই, কোনো যুক্তি দিয়ে এখানে কাউকে ন্যায়সঙ্গত কিছু বোঝানো যায় না। বাঙলার অধিকাংশ মানুষই যে গুরুত্বপূর্ণ কিছু করে উঠতে পারে না, তার কারণ গুরুত্বহীন বিষয়গুলো নিয়ে তাদের এতোই উদ্বিগ্ন থাকতে হয় যে জীবনে কিছুই ক’রে ওঠা হয় না। অন্যের স্বেচ্ছাচার ভরসা করে যাদের জীবন ধারণ করতে হয়, তাদের জীবন পশুর জীবনের থেকেও করুণ ও অসহায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙলা বিভাগে প্রথাগত দ্বিতীয় পর্বে যে-ছাত্রছাত্রীরা ভর্তি হওয়ার অনুমতি পেয়েছিলো, এবং এখন যারা শুনছে যে তারা ভর্তি হতে পারবে না, তাদের জীবনটা এর চমৎকার উদাহরণ। তারা পত্রিকায় পত্রিকায় যুক্তি ও আবেদনে পরিপূর্ণ চিঠি লিখছে, উপাচার্যকে ‘মাননীয় উপাচার্য’, ‘প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ’ রূপে সম্বোধন ক’রে আকুল আবেদন জানাচ্ছে, সভাপতির কাছে করুণা প্রার্থনা করছে, সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষকে কলংকজনক অপরাধের সাথে জড়িত’ ব’লে ধিক্কার দিচ্ছে, কিন্তু আসল কাজটি হচ্ছে না; তাঁরা যে ভর্তি হ’তে না পারার কোনো সঙ্গত কারণ নেই। তাঁরা যে ভর্তি হ’তে পারছে না, এটা নিতান্তই শক্তিমানদের স্বেচ্ছাচার।

বাঙালি একটি সামরিক জাতি, তাই বছরে বছরে সৈন্যাবাস হচ্ছে; বাঙালি শিক্ষানুরাগী নয়, তাই এখানে নতুন কোনো বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে না। যেগুলো হচ্ছে বলে রটনা করা হচ্ছে, সেগুলো পঙ্গুবিশ্ববিদ্যালয় হবে মাত্র। অপরাজনীতি এখানে শিক্ষাকে দূষিত ক’রে ফেলেছে; অপরাজনীতিক কারণে কতকগুলো মহাবিদ্যালয়কে ‘বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ’ নামক একটি হাঁসজারুতে পরিণত করা হয়েছে। কিছু মহাবিদ্যালয়ে সম্মান ও এমএ শ্রেণী খোলা হয়েছে। ওসব কলেজের অধিকাংশে উচ্চমাধ্যমিক পড়ানোরও ভালো ব্যবস্থা নেই। অধিকাংশ কলেজেই যথেষ্ট শিক্ষক নেই, শিক্ষকদের পদোন্নতি নেই এবং তাদের ছুটতে হয় উচ্চমাধ্যমিক থেকে বিএ পাসে, সেখান থেকে সম্মানে, কোনো কোনো কলেজে এমএ-তে। পড়াশুনোটা কী হয়, তা সবাই বোঝে। ঢাকার কলেজগুলো তো আমলাদের ও শক্তিমানদের পত্নীদের অধ্যাপনা নামক অবসর বিনোদনের ক্ষেত্র। অধিকাংশ কলেজে সম্মান শ্রেণীতে পড়ানোর কোনো বাবস্থাই নেই; বই নেই, অধ্যাপক নেই; অধ্যাপকদের, সঙ্গত কারণেই, জ্ঞান অর্জনের ও বিতরণে কোনো উৎসাহ নেই। যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেই ভাল পড়াশুনো হয় না, সেখানে কলেজে সম্মান ও এমএ শ্রেণীতে ভালো পড়াশুনো হাস্যকর দুরাশা। তবু ওই পড়াশুনো চলছে। কোনো কলেজেই এমএ শ্রেণীতে পড়ানোর সামান্য ব্যবস্থাও নেই তবুও পড়ানো হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্প্রতি একটি নিয়ম করেছে যে কলেজে এমএ শ্রেণী আছে, সেখানকার ছাত্ররা সম্মান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর সেখানেই এমএ পড়বে, তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ পড়তে আসতে পারবে না। যে-সব কলেজে এমএ নেই, শুধু সেখানকার সম্মানিতরাই বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ প্রথাগত শ্রেণীতে ভর্তি হতে পারবে। নিয়মটি পুরোপুরি নীতিবিরোধী, ও বিদ্যার শত্রু। এ নিয়মে তৃতীয় শ্রেণীতে শেষস্থান অধিকার ক’রে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার অধিকার থাকে, কিন্তু প্রথম বা দ্বিতীয় শ্রেণীতে প্রথম হয়েও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার অধিকার থাকে না। কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে এলেই একটি গুণগত পরিবর্তন ঘটে; অন্তত এক বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া জীবনকেই বদলে দিতে পারে।

বাঙলা বিভাগে প্রথাগত দ্বিতীয় পর্বে যে-ছাত্রছাত্রীরা ভর্তি হ’তে এসে বিপদে পড়েছে, তারা বিদ্যাবিরোধী নিয়ম ও খামখেয়ালির শিকার। বিভাগ তাদের ভর্তি করার জন্যে ভর্তি পরীক্ষা নিয়েছে, ভর্তির ফর্মও দিয়েছে; তাই তাদের ভর্তি করা বিভাগ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বের মধ্যে প’ড়ে। তাদের ভর্তি করতে কোনোই অসুবিধা নেই- দ্বিতীয় পর্বে একশোটির মতো আসন রয়েছে, সেখানে নিয়মিত ভর্তি হয়েছে মাত্র তেইশজন, তাই সাতাত্তরটি আসন শূন্য পড়ে আছে। ওই ছাত্রছাত্রীরা শূন্য সাতাত্তরটি আসনের জন্যে মেধানুসারে মনোনীত হয়েছিলো, কিন্তু হঠাৎ শক্তিমানদের কোথাও কিছু গোলমাল ঘটেছে, আর অমনি সিদ্ধান্ত হয়েছে যে ভর্তি করা হবে না। তাদের ছুটতে হচ্ছে শক্তিকেন্দ্র থেকে শক্তিকেন্দ্রে; সভাপতি থেকে উপাচার্য থেকে ঢাকা ডাকসু। ডাকসুরও নাকি ভর্তির ব্যাপারে মতামত রয়েছে; এতেই বোঝা যায় শিক্ষার অবস্থা কী। ওই ছাত্রছাত্রীরা আশ্বাস পেয়ে পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাশ করছে, নিজেদের কলেজে ভর্তি হয়নি, ভর্তি হওয়ারও কোনো সুযোগই নেই আর। তারা কী করবে এখন? তাদের মাথা পেতে নিতে হবে বাঙলায় জন্ম নেয়ার জন্মগত অপরাধ? ওই ছাত্রছাত্রীরা ভর্তির আবেদন করেছিলো, ভর্তির মৌখিক পরীক্ষা দিয়েছিলো, ভর্তি ফর্ম পেয়েছিলো, সব অনুষ্ঠানিকতা শেষ করেছিলো, কিন্তু হঠাৎ কর্তৃপক্ষ জেগে উঠলে তারা ভর্তি হ’তে ব্যর্থ হয়। তাদের কোনো অপরাধ নেই, তবুও তারা শিকার; আর যারা ভর্তি পরীক্ষা নিয়েছে, ফর্ম দিয়েছে তাদের কোনো দায় নেই। একটি বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লে তাঁরা যে মানুষ হয়ে বেরোবে, কয়েক বছর কলেজে পড়লেও তা হবে না। বিশ্ববিদ্যালয় কি বিশ্বাসঘাতকতা করবে তাদের সাথে, সেচ্ছাচারিতাকেই গণ্য করবে বিধি ব’লে? ওরা অধিকার অর্জন করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার, তবু যদি ভর্তি হ’তে না পারে তাহলে অপরাধী হবে বিভাগ ও বিশ্ববিদ্যালয়। এদের কোনো অপরাধ নেই, বা একটিই অপরাধ ওদের- ওরা জন্মেছে বাঙলায়, যেখানে স্বেচ্ছাচারই সংবিধান।