জলপাই রঙের অন্ধকার

আগে ওই অন্ধকারের রঙটা অন্য রকম ছিলো; খাকি ছিলো, এবং অনেক বেশি কর্কশ দেখাতো; এখন রঙের বদল ঘটেছে, বেশ স্নিগ্ধ দেখায়, কিন্তু ভেতরে তা হয়ে উঠেছে অনেক বেশি হিংস্র। আমরা যারা বেড়েছি ও বছরের পর বছর, দশকের পর দশক বাস করেছি সামরিক অপশাসনের মধ্যে, তারা জানি কতো নৃশংস অমানবিক ওই অন্ধকার। সামরিক শাসন অন্ধকারই, অন্ধকারের থেকেও অনেক খারাপ; তা মানবিক সমস্ত রঙ শোষণ ক’রে নষ্ট করে সব কিছু। গত তিন দশকে পৃথিবী জুড়ে প্রবলভাবে দেখা দিয়েছ সামরিক একনায়কেরা; তারা কেড়ে নিয়েছে মানুষে সমস্ত অধিকার, বিকাশ ঘটতে দেয়নি তাদের, চারদিকে ছুড়িয়ে দিয়েছে মধ্যযুগ, এবং প্রতিটি দেশকে পরিণত করেছে আর্থনীতিক ধ্বংসস্তুূপে। আমি ছেলেবেলায়ই দেখেছিলাম এক সামরিক একনায়কের আবির্ভাব; সে চারদিকে সাড়া জাগিয়ে এসেছিলো, প্রচারযন্ত্রকে মুখর ক’রে তুলেছিলো তার বন্দনায়, এমন ধারণা তৈরি করেছিলো যে সে দেখা দিয়েছে ত্রাণকর্তারূপে।

সামরিক একনায়কেরা প্রথমে ত্রাণকর্তার ভাবমূর্তি নিয়েই দেখা দেয়, রাজনীতি ও রাজনীতিকদের নিন্দিত ক’রে তারা একনায়কত্ত্বের মহিমা প্রচার করে, কিন্তু তারা ত্রাতা নয়, জাতির ধ্বংসকারী। পাকিস্তানটিকে ধ্বংস করেছে সামরিক একনায়কেরা, এখনো করছে, ভবিষ্যতে আরো করবে; সামরিক শাসকেরা কিছু সৃষ্টি করে না, তারা ধ্বংস করে। পাকিস্তানিরূপে আমরা সামরিক একনায়কত্ব দেখেছি, বাঙলাদেশিরূপে দেখেছি; আমাদের যে-দুর্গতি, তার প্রায় সবটাই সামরিক শাসনের ফল। আমাদের সব কিছু যে ব্যর্থ হয়ে গেছে, আমরা যে ধারাবাহিকভাবে পতনের দিকে এগিয়ে চলছি, তার কারণ সামরিক অপশাসন। রাজনীতিকদের দোষের শেষ নেই; গরিব অঞ্চলগুলোতে। রাজনীতিকেরা অসৎ হয়ে থাকে, তারা দেশের কথা না ভেবে ভাবে নিজেদের কথা; কিন্তু তারাও অনেক উৎকৃষ্ট সামরিক শাসকচক্রের থেকে।

সামরিক শাসন হচ্ছে দেশের সাথে চরম বিশ্বাসঘাতকতা। তাদের ভার দেয়া হয়েছিলো দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার, তারা তার শপথও করেছিলো, কিন্তু প্রতিজ্ঞা পালন করেনি। বিশ্বাসঘাতকতা করেছে শপথের সাথে। সামরিক বাহিনী একটি প্রথা; সব দেশেই সামরিক বাহিনী রয়েছে, যদিও সব দেশের জন্যে সামরিক বাহিনী জরুরি নয়। কোথাও সামরিক বাহিনী না থাকলেই ভালো হতো, ভবিষ্যতে একদিন মানুষ হয়তো এ-বাহিনীর দরকার বোধ করবে না; কিন্তু এখন রয়েছে অনেকটা প্রথারূপেই। খুব কম দেশের সামরিক বাহিনীর পক্ষেই স্বদেশ রক্ষা করা কঠিন, কিন্তু প্রতিটি দেশের সামরিক বাহিনীই ইচ্ছে করলে দখল করে ফেলতে পারে নিজের দেশ। গত চার দশকে তৃতীয় বিশ্বের বহু দেশের সামরিক বাহিনী নিজের দেশ দখল করেছে, কি পরাজিত হয়েছে শত্রুর কাছে। যুদ্ধের কৌশলের ব্যাপারেও উন্নত দেশগুলো সেনানায়কদের সিদ্ধান্ত নিতে দেয় না, সিদ্ধান্ত নেয় রাষ্ট্রব্যবস্থাপকেরা। তারা মনে করে যুদ্ধের মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার শুধু সেনাপতিদের ওপর ছেড়ে দেয়া যায় না। যুদ্ধই যাদের ব্যাপার, তাদের ওপর যদি যুদ্ধও ছেড়ে দেয়া না যায়, তাহলে তার চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারগুলো- রাষ্ট্র, সমাজ, সভ্যতা প্রভৃতি তো তাদের ওপর ছাড়ার কল্পনাও যায় না। তাদের শিক্ষা দেয়া হয় বিশেষভাবে, বিশেষ কাজের জন্যে উপযুক্ত করে তোলা হয় তাদের; তাই তারা যখন অন্য কাজে হাত দেয়, তখন তা সম্পূর্ণরূপে পন্ড করে।

সামরিক বাহিনী বদ্ধ বাহিনী, ওই বাহিনীর স্বপ্নকল্পনাও বদ্ধ; তাদের পক্ষে মুক্ত সভ্যতা ও সমাজ, রাষ্ট্র পরিচালনা করা অসম্ভব। তারা শেখে আদেশ মানতে ও আদেশ দিতে, তারা জানে ওপরের আদেশ মানতেই হবে, তারা জানে সমস্তু সমস্যার সমাধান জানে ওপরের ব্যাক্তিটি। তারা জানে আমি কিছু জানি না, জানে আমার সেনাপতি; আমার কাজ শুধু তার আদেশ মানা। এ-শিক্ষা মুক্ত সমাজের শিক্ষা নয়; এ-শিক্ষা মুক্ত সমাজের ওপর প্রয়োগ করতে গেলে অনিবার্য হয়ে ওঠে বিপর্যয়। সামরিক বাহিনীতে যে-নিয়ন্ত্রণ, তাতে মানুষ হয়ে ওঠে নিয়ন্ত্রিত প্রাণী তাদের চোখে ব্যক্তির স্বাধীনতা অত্যন্ত আপত্তিকর। তাই তারা যখন কোনো রাষ্ট্র দখল করে, তখন কেড়ে নেয় মানুষের সমস্ত অধিকার; অন্যের অধিকার স্বীকার করে তাদের পক্ষে আত্মরক্ষা অসম্ভব।

সামরিক চক্র স্বভাবেই প্রতিক্রিয়াশীল; তার অগ্রগতিতে বিশ্বাস করে না, বিশ্বাস করে স্থির হয়ে থাকতে, চায় পেছনের দিকে যেতে। কেননা যতো পেছনে যাওয়া যায়, ততোই কেড়ে নেয়া যায় মানুষের অধিকার; সামনের দিকে এগোনোর অর্থ হচ্ছে নিজের অধিকার কমা, অন্যের অধিকার বাড়া। তাই সামরিক চক্র বাস করে মধ্যযুগেই; তারা সব ধরনের হাতিয়ার ব্যবহার করে জনগণকে পর্যদুস্ত করার জন্যে। সামরিক শাসনে নষ্ট হয় রাজনীতি, সমাজ রাষ্ট্র, সভ্যতা, অর্থনীতি; কিন্তু সবচেয়ে বেশি নষ্ট হয় মানুষ ও তার মস্তিষ্ক। মানুষের লক্ষণ সৃষ্টিশীলতা, নব নব উদ্ভাবন, কিন্তু তা-ই নিষিদ্ধ হয়ে যায় সামরিক অপশাসনে। মানুষের উদ্ভাবিত যন্ত্রগুলো খুবই আকর্ষণীয়, কিন্তু আসলে সবচেয়ে আকর্ষণীয় উদ্ভাবন হচ্ছে অভিনব চিন্তা। সৃষ্টিশীল মানুষের মস্তিষ্ক শুধু একই রকম কুচকাওয়াজ, একই রকম অভিবাদনে তৃপ্ত থাকতে পারে না। মানুষের মগজ চায় নতুন চিন্তার জন্ম দিতে। কিন্তু সামরিক শাসন তার বিরুদ্ধে; কেননা তার বিশ্বাস হচ্ছে চিন্তার কোনো দরকার নেই, সব বিষয়ে সেনাপতি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, এখন বাকি শুধু সেগুলো প্রয়োগ করা। তবে জনগণ সেনাপতির অধীনস্থ বাহিনী নয় যে সেনাপতির নির্দেশ মেনে নেবে অভিবাদনের সাথে। কোনো সামরিক শাসনই যে সফল হয় নি, তার কারণ তার মধ্যেই নেই সাফল্যের বীজ।

বাঙলাদেশে একাধিক সামরিক অপশাসনের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে; এবং তার মারাত্মক কুফল পড়েছে সারা জাতির বাস্তব জীবন ও চেতনার ওপর। বাঙলাদেশের রাজনীতিক বিকাশ খুবই বিকৃত হয়ে গেছে, রাজনীতিকেরা নষ্ট হয়ে গেছে, গণতন্ত্র এখানে পরিণত হয়েছে একটি নিরর্থক শব্দে, অর্থনীতি উদ্ধারহীন অবস্থায় পৌঁছেছে, সমাজের উচ্চ শ্ৰেণীটি সম্পূর্ণ নৈতিকতা হারিয়ে ফেলছে, এবং জাতির সৃষ্টিশীলতা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। রাজনীতিকেরা রাজনীতি রেখে মন দিয়েছে দালালিতে, তারা মনে করেছে রাজনীতিতে সাফল্য আসবে না, সাফল্য আসেব সামরিক চক্রের দালাল হ’লে। তারা সফল হয়েছে, কিন্তু ব্যর্থ হয়ে গেছে দেশের রাজনীতি। হাজার হাজার কোটি টাকা বাঙলাদেশ ঋণ হিসেবে পেয়েছে, কিন্তু তাতে দেশের সাধারণ মানুষের কোনো উপকার হয়নি; ওই টাকা লুট করেছে সামরিক চক্র ও তাদের আজ্ঞাবহ দালালেরা।

বাঙলাদেশের উচ্চবিত্ত শ্রেণীটি এতো যে অনৈতিক হয়েছে, তার কারণ সামরিক শাসন: তারা দেখেছে সামরিক চক্রের দালাল হ’লে বিনাশ্রমে কোটিপতি হওয়া যায়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ধনী থাকবে, তারা শোষণও করবে; কিন্তু তারা ধন সৃষ্টির জন্য সাধনা করবে। কিন্তু বাঙলাদেশে কোনো সাধনার দরকার পড়ে নি, দলািলি করেই হওয়া গেছে কোটিপতি। ধনসৃষ্টিও এক ধরনের সৃষ্টিশীলতা, যা দেখা যায় উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলোতে; কিন্তু বাঙলাদেশে ধন সৃষ্টি করা হয় নি। লুট করা হয়েছে। সামরিক অপশাসনের সময় খুব লাভবান হয় আমলারাও, বালাদেশের আমলারাও লাভবান হয়েছে। তারা শুধু দলে দলে মন্ত্রী হয় নি, ধনপতি হয়েছে; এবং জনগণের ওপর করতে পেরেছে প্রচণ্ড আমলাবৃত্তি। বাঙলাদেশের মননগত সৃষ্টিশীলতা শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে সামরিক শাসনের ফলে। এখানে কোনো বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী যে দেখা দেয় নি, তাই নয়; সাহিত্য নিয়ে আমাদের যে কিছুটা গৌরব ছিলো, তাও নষ্ট হয়েছে। বিশ্ববদ্যালয়গুলো এখন কোনো জ্ঞান বিতরণ করার সুযোগ পায় না, সৃষ্টির সুযোগ তো কখনোই পায় নি। অর্থাৎ আমাদের সব কিছু ঠেকে গেছে জলপাই রঙের অন্ধকারে। এক দর্শকের সামরিক শাসন একটি জাতিকে এক হাজার বছর পিছিয়ে দিতে পারে, দেড় দশকের সামরিক শাসনে বালাদেশ কতোটা পিছিয়েছে তা পরিমাপ করাও কঠিন। জাতিকে মুক্ত করা দরকার ওই অন্ধকার থেকে, ওই অন্ধকারের সব রকম ছোঁয়া থেকে, নইলে দেশের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। জলপাই রঙের অন্ধকারের মধ্যে নষ্ট হয় সব কিছু; স্বাধীনতা, দেশ, সমাজ, রাষ্ট্র, সৃষ্টিশীলতা, সভ্যতা।