নষ্টদের কবলে দুই কবি

আমাদের যা-কিছু ভালো, তার সবটাই প্রায় নষ্টদের অধিকারে চলে গেছে; এখনো যে দু-এক ফোঁটা ভালো প’ড়ে আছে অগোচরে, তাও শিগগিরই তাদের কবলে পড়বে, নষ্ট হবে। রাষ্ট্রযন্ত্র অনেক আগেই নষ্টদের কবলে পড়েছে; ধর্ম তাদের কবলে, সংস্কৃতিও তাদের কবলে। সৌন্দর্য, মেধা, প্রতিভাও তাদের কবলে; এমন কি অমরতাও এখন পুরোপুরি তাদের কবলে। কবিতার জন্যে নষ্টদের লোভ থাকার কথা ছিলো না; কিন্তু সেটাকে তারা বাদ দেয় নি; তাকেও কয়েক দশকে নষ্ট করেছে। একজন কবি অনেক আগেই চলে গিয়েছিলেন নষ্টদের কবলে; -তিনি নজরুল ইসলাম, মুসলমানদের রবীন্দ্রনাথ। তিনি বিখ্যাত বিদ্রোহী কবিরূপে, কিন্তু তাঁকে শোচনীয়ভাবে ব্যবহার করেছে প্রতিক্রিয়াশীলেরা; এমনভাবে তাঁকে ব্যবহার করেছে প্রতিক্রিয়াশীলেরা যে মনে হতে পারে নজরুল তাদেরই কবি। পাকিস্তানি নষ্টরা তাকে ব্যবহার করেছে; তাকে এক বিশেষ সম্প্রদায়ের ও ধর্মের কবিতে পরিণত করেছে। বাকি ছিলেন আরেকজন- রবীন্দ্রনাথ, যাঁকে বাতিলের চেষ্টা করে আসছে নষ্টরা পবিত্র পাকিস্তানের কাল থেকে; পেরে ওঠেনি। এমনই প্রতিভা ওই কবির তাঁকে বেতার থেকে বাদ দিলে তিনি জাতির হৃদয় জুড়ে বাজেন; তাকে পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ দিলে তিনি জাতির হৃদয়ের কাব্যগ্রন্থে মুদ্রিত হয়ে যান; তাকে বঙ্গভবন থেকে বাদ দেয়া হলে তিনি সমগ্র বঙ্গদেশ দখল করেন, তার একটি সঙ্গীত নিষিদ্ধ হলে তিনি জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠেন।

প্রতিক্রিয়াশীল নষ্টরা অনেক লড়াই করেছে তার সাথে, পেরে ওঠে নি; তাঁকে মাটি থেকে বহিষ্কার করা হলে তিনি আকাশ হয়ে ওঠেন; জীবন থেকে তাকে নির্বাসিত করা হলে তিনি রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন জাতির স্বপ্নলোকে। নষ্টরা তাঁকে মুছে ফেলার চেষ্টা করেছে আপ্রাণ। যদিও তিনি জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা, তবুও তিনি জাতীয় কবি নন; তার নামে ঢাকায় একটি রাস্তাও নেই; সংস্থা তো নেইই। তাতে কিছু যায় আসে নি তাঁর; দশকে দশকে বহু একনায়ক মিশে যাবে মাটিতে, তিনি বেঁচে থাকবেন বাঙলায় ও বিশ্বে। ওই মহান কবির সাথে লড়াইয়ে না পেরে জয়ের বিপরীত পথ বের করেছে নষ্টরা। এবার তারা তাঁকে দখল করেছে, নিজেদের কবলে নিয়ে এসেছে। তারা বুঝতে পেরেছে রবীন্দ্রনাথকে নষ্ট করার শ্রেষ্ঠ উপায় তাঁকে কবলে নিয়ে আসা, তাঁকে সরকারি করে তোলা; তাঁকে কবিতাকেন্দ্র নামের দুষ্ট সংঘের একটি সদস্যে পরিণত করা।

ভালো জিনিসের অপব্যবহার ক’রে মানুষের যতোটা ক্ষতি করা সম্ভব, ক্ষতিকর বস্তু দিয়েও ততোটা ক্ষতি করা সম্ভব নয়। এটা তারা বুঝেছে, তাই তারা অধিকার করেছে রবীন্দ্রনাথাকে; -তারা এখন নিজেদের মতো একটি রবীন্দ্রনাথ তৈরি করতে পারবে, যেমন তারা অনেক দিন ধ’রেই তৈরি করছে নিজেদের নজরুল। তারা যদিও পুরোপুরি রবীন্দ্রবিরোধী; তাদের সভাপতি পাকিস্তানের শুরুতেই পাকিস্তানের কল্যাণের জন্যে রবীন্দ্রনাথকে প্রত্যাখ্যানের প্রস্তাব দিয়েছিলো, তবু তারা শিলাইদহে দখল করেছে রবীন্দ্রনাথকে। পীড়ন করেছে কবির আত্মাকে, দূষিত করেছে বাঙলায় শুদ্ধতম সৌন্দর্যকে। তারা রবীন্দ্রনাথকে এখন থেকে দীক্ষা দেবে রাষ্ট্রধর্মে, তাঁকে করে তুলবে সাম্প্রদায়িক; তারা দেখাবে রবীন্দ্রনাথ একনায়কত্বের অনুরাগী ছিলেন, দেখাবে রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাসী ছিলেন না গণতন্ত্রে; দেখাবে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সমাজতন্ত্রবিরোধী; দেখাবে রবীন্দ্রনাথ ধর্মান্ধ কবি। নষ্টরা কোনো শুদ্ধতাকেই শুদ্ধ থাকতে দেয় না, রবীন্দ্রনাথকেও থাকতে দেবে না; তাঁকেও নষ্ট করবে।

নষ্টরা নজরুলকে যেভাবে নষ্ট করেছে, মুছে দিয়েছে নজরুলের প্রতিভার আসল পরিচয়, তা খুবই মর্মস্পর্শী। পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িকেরা খুব পৃষ্ঠপোষকতা করেছে তাঁর; তাঁকে সংশোধন ও সংশোধন ও সংশোধন ক’রে তাঁকে পরিণত করেছিলো এক সাম্প্রদায়িক কবিতে। তারা তাঁর কবিতায় খুঁজে পেয়েছিলো অসংখ্য অবাঞ্ছিত বস্তু, সেগুলো বর্জন করার জন্যে তারা ছিলো উদগ্রীব। বিদ্রোহী নজরুল তাদের প্রিয় ছিলো না, ছিলো শত্রু; তাই তারা খুঁজেছে নজরুলের রচনার এমন সব অংশ, যা দিয়ে তারা ভেঙে ফেলতে পারে নজরুলের বিদ্রোহী ভাবমূর্তিটি। তারা রবীন্দ্র-নজরুল বিরোধিতাও সৃষ্টি করেছে, প্রচার করেছে রবীন্দ্রনাথের থেকে অনেক বড়ো কবি নজরুল। পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িকতার ফলে তাতে বিশ্বাসও করেছে অনেকে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে উঠছে নজরুলব্যবসা। নজরুলসাহিত্যের আলোচকেরা সাহিত্যও ভালো বোঝে না, তাদের অধিকাংশই প্রগতিবিরোধী, অনেকেই রাজাকার, তবে তারা মেতে উঠেছে নজরুলবিষয়ক নানা নিম্নমানের পুস্তক লিখতে। নজরুলকে নিয়ে এদের লেখা বইপত্র অপাঠ্য, কেননা এগুলো লেখার পেছনে কোনো সাহিত্যবোধ কাজ করে নি, কাজ করেছে স্বার্থবোধ। সরকার যে একটি ইনস্টিটিউট তৈরি করেছে, এ-কারণেই সেটি গবেষণাকেন্দ্রের বদলে হয়েছে মাজার। নষ্টদের কবলে পড়ে নজরুল হারিয়েছেন তার প্রকৃত পরিচয়; তাঁকে ব্যবহার করা হয়েছে প্রগতিবিরোধী কাজে, এবং দেখা দিয়েছে। গৃধণু একদল নজরুব্যবসায়ী। তাদের কাজ নজরুলকে বার বার নষ্ট করা, নজরুলের মুখের ওপর সরকারি মুখোশ পরিয়ে দেয়া। নজরুল-অধ্যাপক নামে কিছু পদ সৃষ্টি করা হয়েছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে; এও এক প্রতারণা। ওই পদ সৃষ্টিতে কোনো নিয়ম মানা হয়নি, কোনো নতুন পদ সৃষ্টি করা হয় নি; সরকারের অনুগৃহীত কিছু ব্যক্তির গায়ে ছাপ মেরে দেয়া হয়েছে নজরুল অধ্যাপকের। কিন্তু এর কোনো বৈধতা নেই। যে-ভাবে তাদের নিয়োগ করা হয়েছে তা সম্পূর্ণ অবৈধ, ও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্ত্বশাসনবিরোধী। যাঁদের নিয়োগ করা হয়েছে, তারা আপাদমস্তক অযোগ্য। তাই নষ্টদের কবলে প’ড়ে নজরুল জড়িয়ে পড়েছেন অনেক অপরাধের সাথে, নিজের অনিচ্ছায়। এবার রবীন্দ্রনাথ কবলে পড়েছেন নষ্টদের, তাঁর পরিণাম ভেবে ভয় পাচ্ছি। শুরুতেই দেখছি রবীন্দ্রনাথ একদল প্রগতিশীলকে টেনে নিয়েছেন অধঃপতনে; -তারা এতোকাল কষ্টেসৃষ্টে প্রগতির দড়িটার ওপর দাঁড়িয়ে ছিলো; কিন্তু বৈশাখী ঝড়ে লুটিয়ে পড়লো পাতালে। আগামী শ্রাবণের বৃষ্টিতে আরেকদল পা পিছলে পড়বে পাতালে। রবীন্দ্রনাথ তো একা যাবেন না, পাতালে টেনে নেবেন একদল সুবিধাবাদীকে। রবীন্দ্রনাথের জন্যে দুঃখ করি না, মহান তিনি, একদিন তিনি নিজেকে মুক্ত করবেনই নষ্টদের কবল থেকে; শোক বোধ করছি ওই অধঃপতিতাদের জন্যে, কেননা তাদের শক্তি এতো সামান্য লোভে এতো অসামান্য যে তারা কোনো দিন উঠে আসতে পারবে না পতনের পঙ্ক থেকে। এরপর থেকে তারা সেবা করে যাবে একনায়কত্বের, নষ্টামোর, প্রগতিবিরোধিতার, স্বার্থের, চরিত্রহীনতার। নষ্টদের কবলে পড়ে প্রথমেই রবীন্দ্রনাথের সুন্দর মুখে লাগবে একরাশ কালি, ওই কালি মাখিয়ে দেবে নষ্টরাই; অনেকের মনেই সন্দেহ জাগবে অশুভ শক্তির প্রতিনিধিরা যাঁর প্রশংস্য করে, তিনি কি শুভ, তিনি কি মহৎ; তিনি কি মঙ্গল? অচলায়তনের প্রবক্তারা করছে অচলায়তন-এর রচয়িতার প্রশংসা; তারা ভোঁতা করে ফেলবে রবীন্দ্রনাথকে। তারা বুঝিয়ে দেবে রবীন্দ্রনাথ আসলে অচলায়তনেরই পক্ষপাতী; আমরা এতোদিন ভুল বুঝে এসেছিলাম যে তিনি মুক্তির পক্ষের। তারা বুঝিয়ে দেবে রবীন্দ্রনাথ চেয়েছেন তাসের দেশ; তিনি মানুষ হওয়ার কথা বলেন নি। প্রতিক্রিয়াশীলেরা উঠে প’ড়ে লাগবে এরপর, দেখিয়ে দেবে বীন্দ্রনাথ তাদেরই লোক। মহান রবীন্দ্রনাথ তাদের কবলে প’ড়ে হয়ে উঠবেন ক্ষুদ্র, মুক্ত রবীন্দ্রনাথ হবেন বন্দি রবীন্দ্রনাথ; মানুষের কবি, মানুষের শক্রদের কবলে প’ড়ে হয়ে উঠবেন মানুষের শত্রু; প্রতিক্রিয়াশীলতার পৃষ্ঠপোষক; -যেমন কয়েক দশকে হয়ে উঠেছেন নজরুল। বাঙলার দুই কবি এখন নষ্টদের কবলে, এতেই বোঝা যায় বাঙলার অবস্থা এখন কতোটা শোচনীয়।

(গ্রন্থ: জলপাই রঙের অন্ধকার, ১৯৯২)