নৌকো, অধরা সুন্দর

একটি রঙচটা শালিখের পিছে ছুটে ছুটে
চক পার হ’য়ে ছাড়াবাড়িটার কামরাঙা গাছটার
দিকে যেই পা বাড়িয়েছি, দেখি- নৌকো-
ভেসে আসে অনন্ত দু-ভাগ ক’রে। পাল নেই
মাঝি নেই, শুধু ঢেউয়ের ধাক্কায় ভেসে আসে
ধ্রুবতারা আমারই দিকে। রঙধনু একবার খেলে
গেলো আগ থেকে পাছ-গলুই পর্যন্ত, চড়াটে গুড়ায়
আছড়ে পড়লো চাঁদ। একটা শাদা-লাল রুই
বৈঠার মতো লাফিয়ে উঠলো পাছ-গলুইয়ের কাছে।
কামরাঙা গাছ থেকে ছুটলাম সেই স্বপ্নের দিকে-
লাফিয়ে উঠতে যাবো দেখি সাতাশে বাদামে
ফুলে উঠেছে লাল-নীল-হলদে বাতাস। বাদামের
দিগন্তে দিগন্তে রাঙা মেঘপাঁচশো সূর্যাস্ত ও
উদীয়মান সূর্য, আমার সামনে দিয়ে ভেসে যায়
জ্যোতির্ময়! আমি ছুটছি পেছনে, দেখি দিন অস্ত
গেলে পাটাতনে ঝনঝন বেজে দুলে কেঁপে ওঠে একঝাঁক
শাদা নাচ! তাদের শরীর থেকে খ’সে পড়ে এলোমেলো
রঙিন আকাশ- তখন চোখের চারদিকে শুধু ঢেউ
অন্তহীন। এমন সময় কোথা থেকে উঠে এলো
এক স্বাস্থ্যবান নর্তক কিষাণ, মেতে উঠলো সকলের
সাথে এক বিস্ময়-খেলায়! ধানে ভ’রে উঠলো নৌকো
গানে ভ’রে উঠলো গলা, ঝলমললো পাটখেতের
দুর্দান্ত সবুজ, ইলশের রঙে গন্ধে আপাদমস্তক নৌকো
অবিকল পূর্ববঙ্গ। আমি তখনো ছুটছি সেই নাচ-গান-
ইলশের পিছে পিছে, কিন্তু যতো কাছে আসি
ততো দূর ছুটে যায় গতিময় পরম সুন্দর!
থেকে থেকে বদলে যায় রঙ, রূপ বদলায়
পলকে পলকে। কখনো সে মাস্তুল মাস্তুলে ফাড়ে
মেঘ, বৃষ্টি নামে ঝড় ওঠে নৌকোর গুড়ায় গুড়ায়,
আবার কখনো পাল নেই মাঝি নেই শুধু নৌকো
অনন্তের অনন্ত মধ্যে- স্থির পদ্ম। ভাটিয়ালি টান
শোনা যায় কখনো বা, পরমুহূর্তেই আবার
বুকের রক্তাক্ত তন্ত্রি থেকে ওঠে শর-গাঁথা পাখির চিৎকার।
সেই যে শৈশবে সাত বছর বয়সে নৌকোর পেছনে
পেছনে ছোটা শুরু হয়েছিলো, তারপর
আমার শরীরে একসময় ঝলমল ক’রে উঠেছিলো
স্বাস্থ্য, বহুবার কলকল করেছে অসুখ,
কখনো সমস্ত চোখে নেমেছে অন্ধতা, সব ইন্দ্রিয়ে
ঘনিয়েছে বধিরতা। তবু আজো ছুটছি সেই
নৌকোর পেছনে পেছনে;- আমি ছুটি আর
আমার সামনে দিয়ে ভেসে যায় চিরকাল অধরা সুন্দর।