পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশে

ক্রাচে-ভর-দেয়া স্টেনগান
হুইলচেয়ারে ধ’সে-পড়া বিধ্বস্ত মর্টার
ফুটপাতে প’ড়ে থাকা বাতিল গ্রেনেড
নষ্ট বোমা থাবাহীন রয়েলবেঙ্গল

যখন খুঁড়িয়ে চলো পা-আর-ডানা-ভাঙা আলবাট্রসের মতো
শেরেবাংলা নগরের বাস ট্রাক পুলিশিগাড়ির
বিবেকহীন সন্ত্রাসের মধ্য দিয়ে
হামাগুড়ি দিয়ে কাৎ হ’য়ে পড়ে থাকো নাবাবপুরের
ড্রেন কিংবা আবর্জনাস্তূপের পাশে
আলুর বস্তার মতো প’ড়ে থাকো হৃদস্পন্দনহীন বঙ্গভবনের
দেয়াল আর সান্ত্রীদের পদতলে
যখন প্রচণ্ড ক্রোধে চিৎকার করতে গিয়ে ব্যাকফায়ার করা
রাইফেলের মতো আর্তনাদ ক’রে ওঠে তোমাদের কণ্ঠস্বর
বিকল মেশিনগানের নলের মতো একেকবার
ঝিলিক দিতে গিয়ে অসহায়ভাবে ঢ’লে পড়ে একদা উদ্ধত
মাটি থেকে আকাশে ছড়ানো বাহু
তোমাদের হাজার হাজার চোখের দুপাশে যখন
ভয়ঙ্কর বিস্ফোরকের মতো বিস্ফোরিত হ’তে গিয়ে
ভেজা বারুদের মতো গ’লে পড়ে এক একটা বিশাল অশ্রুবিন্দু
তখন মনে হয় তোমরা আর যুদ্ধাহত নও
তোমরা সবাই পঙ্গু, আভিধানিক অর্থেই পঙ্গু।

ক্রাচে-ভর-দেয়া স্টেনগান
এখন তোমরা পঙ্গু
তোমাদের ট্রিগারের সাথে
কোনো ম্যাগাজিন সংযুক্ত নয়।
হুইলচেয়ারে ধ’সে-পড়া বিধ্বস্ত মর্টার
এখন পঙ্গু তোমরা
তোমাদের ভেতরে এখন আর
বারুদ আর ইস্পাতের সংমিশ্রণ নেই।
ফুটপাতে প’ড়ে-থাকা বাতিল গ্রেনেড
এখন পঙ্গু তোমরা
তোমাদের ছুঁড়ে দিলে এখন আর
সামান্য শব্দও হবে না।
নষ্ট বোমা
এখন পঙ্গু তোমরা
দশবছরের প্রতিক্রিয়াশীল বর্ষণে
তোমাদের ভয়ঙ্কর হৃৎপিণ্ড নষ্ট হ’য়ে গেছে।
থাবাহীন রয়েলবেঙ্গল
এখন পঙ্গু তোমরা
তোমাদের থাবা আর ভয়াবহভাবে
ঝকঝক ক’রে উঠবে না।

এক দশকেই যুদ্ধাহত তোমরা সব পঙ্গু হ’য়ে গেছো।
এখন বাঙলাদেশে সব বাঙালিই পঙ্গু।

যে-বাঙালিকেই কুশল জিজ্ঞেস করি
সে-ই জানায় সে আপাদমস্তক পঙ্গু হ’য়ে গেছে।
নদীর ঘোলাটে জলকে জিজ্ঞেস করি; কেমন আছো?
ছলছল ক’রে জল: আমরা পঙ্গু।
পাখির ঝাঁককে জিজ্ঞেস করি: কেমন আছো?
চর জুড়ে উত্তর আসে: আমরা পঙ্গু।
বিমর্ষ জোনাকিকে জিজ্ঞেস করি: কেমন আছো?
নিভে যেতে যেতে জবাব দেয়: আমরা পঙ্গু।
ধানের হলদে শিষকে জিজ্ঞেস করি: কেমন আছো?
আর্তনাদ ক’রে ওঠে ধানখেত: আমরা পঙ্গু।
আত্মীয়কে জিজ্ঞেস করি: কেমন আছেন?
উত্তর পাই: আমি পঙ্গু।
স্ত্রীকে কাছে টানলে কান্না শুনি: আমি পঙ্গু।
আমার যে-কন্যা সমস্ত প্রতিরোধ সত্ত্বেও জন্মাতে পেরেছে
তাকে জিজ্ঞেস করি: আম্মু, তুমি কেমন আছো?
তার স্বর শুনি: আমি পঙ্গু।
আমার যে-সন্তান ভ্রূণ হ’য়ে মায়ের অভ্যন্তরে যুদ্ধরত
তাকে জিজ্ঞেস করি: অনাগত, কেমন রয়েছে?
তার কণ্ঠ শুনি: আমি পঙ্গু।
ছাত্রকে জিজ্ঞেস করি: কেমন আছো?
উত্তর: পঙ্গু।
তার প্রেমিকাকে জিজ্ঞেস করি: কেমন আছো?
উত্তর: পঙ্গু।
চাষীকে জিজ্ঞেস করি: কেমন আছেন?
উত্তর: পঙ্গু।
শ্রমিককে জিজ্ঞেস করি: কে আছেন?
উত্তর: পঙ্গু।
রিকশঅলাকে জিজ্ঞেস করি: কেমন আছেন?
উত্তর: পঙ্গু।
ঠেলাঅলাকে জিজ্ঞেস করি: কেমন আছো?
উত্তর: পঙ্গু।
কাজের মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করি: কেমন আছিস?
উত্তর: পঙ্গু।

আমার স্বপ্নকে আলিঙ্গনে বেঁধে ওষ্ঠে ঠোঁট রেখে
নিঃশব্দে জানতে চাই: কেমন রয়েছে প্রিয়তমা?
নিঃশব্দে জানায় সে: পঙ্গু।

পঙ্গু
পঙ্গু
পঙ্গু
পঙ্গু
পঙ্গু
পঙ্গু

এখন বাঙলাদেশে সব বাঙালিই আপাদমস্তক পঙ্গু।

ক্রাচে-ভর-দেয়া স্টেনগান
এখন বাঙলাদেশ তোমাদের মতোই পঙ্গু
হুইলচেয়ারে ধ’সে-পড়া বিধ্বস্ত মর্টার
এখন বাঙলাদেশ তোমাদের মতোই পঙ্গু

এক দশকেই মুক্তিযোদ্ধা
বাঙালি
আর বাঙলাদেশ
মাথা থেকে হৃৎপিণ্ড থেকে পা পর্যন্ত পঙ্গু হ’য়ে গেছে।