প্রেম

পুঁজিবাদী পর্বের সবচেয়ে বড়ো ও জনপ্রিয় কুসংস্কারের নাম প্রেম। পশ্চিমে আড়াই শো বছর, আর আমাদের দেশে একশো বছর ধ’রে প্রেম হয়ে উঠেছে লৌকিক ধর্ম। প্রেমের কথা এতো রটানো হয়েছে, এবং চারপাশে এর কথা এতো বলা হয় যে এতে আক্রান্ত হওয়ার জন্যে ব্যগ্র হয়ে প্ৰাকে সবাই, যদিও মানুষ প্রেমে বাঁচে না। মানুষের জীবনের চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে দাঁত মাজা, জুতো পরা, খাওয়া, বদমাশি কাজ, ঘুম, কামের জন্যে বরাদ্দ থাকে নির্দিষ্ট সময়, প্রেমের জন্যে কোনো সময় বন্ধ থাকে না; তবু প্রেমকে মনে করা হয় মহৎ। এটা মানুষের এক মহৎ ভণ্ডামো। প্রেম জীবনের নয়, শিল্পকলা ও ব্যবসার শ্রেষ্ঠ পুঁজি, পৃথিবী জুড়ে প্রেমের নামে এখন প্রতিদিন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা হয়, এবং টাকাটা তুলে নেয়া হয় সুদে আসলে। প্রেম পণ্য হিসেবে সবচেয়ে ভালো, বাজারে এর চাহিদা তেলের থেকে অনেক বেশি; নিশ্চিন্তে নিশ্চিতভাবে এর ওপর টাকা খাটানো যায়। জীবনে এর দরকার খুবই কম; সিগারেট না থাকলে রক্তে জ্বালা ধ’রে, কিন্তু আজ বুকে কোনো প্রেম বোধ করিনি ব’লে কেউ বুকে জ্বালা বোধ করে না। বিয়ে ব’লে, যে প্রথাগত ব্যাপারটি রয়েছে, প্রেম তার শর্ত নয়; বরং প্রেম না থাকলেই বিয়েটা আদর্শ বিয়ে হয়ে ওঠে। বিয়ে ও সংসারের মতো একটা পিতৃতান্ত্রিক ব্যাপারে প্রেম বিপত্তির মতো। প্রেম হচ্ছে নিরন্তর অনিশ্চয়তা; বিয়ে ও সংসার হচ্ছে চুড়ান্ত নিশ্চিন্তির মধ্যে আহার, নিদ্রা, সঙ্গম, সন্তান, ও শয়তানি।

চোদ্দো-পনেরো-ষোলো বছর বয়সের দিকে বালকবালিকারা বুকের বাঁ পাশে একটা কেমন কেমন কাতরতা বোধ করতে থাকে। স্বপ্নে দেখতে থাকে রাজপুত্র রাজনাকে এক সময় ওই রাজপুত্র রাজকন্যার রূপ ধ’রে দেখা দেয় পাশের বাড়ির ছেলে বা মেয়েটি। তাকে দেখতে থাকে সবখানে: মেঘে, গাছের পাতায়, পুকুরের জলে, দেয়ালে; তার চারদিক কুয়াশায় ভ’রে যায়, বুকের ভেতর শিশির জমতে থাকে। বদলে যায় বুকের ভেতরের জলবায়ু, রক্তের রঙও হয়তো, হয়তো ঘোলাটে হয়ে যায় একটু। প্রেম এক মানসিক রোগের মতো অবস্থা; সেটা সুস্থ অবস্থায়। প্রেমিকপ্রেমিকা কখনোই সুস্থ নয়। তাদের জগত আগ্নেয়গিরির চূড়োয়, সব সময় কম্পমান। বাঙলায় বলা হয় ‘প্রেমে পড়া’; ব্যাপারটি পতনের, কোনো খাদে প’ড়ে যাওয়ার। এর নানা লক্ষণ দেখা দেয়। প্রেমিকপ্রেমিকা ঘুমোতে পারে না, ক্ষুধা থাকে না তাদের, তারা থাকে নিরন্তর উদ্বেগের মধ্যে।

প্রেম ঝড়, বিস্ফোরণ, জোয়ার, বা ফুল ফোটার মতো অচিরস্থায়ী আবেগ। ঝড় দিনের পর দিন চলতে পারে না, ফুল ফুটে থাকতে পারে না বছর ধ’রে। প্রেমের ঝড়ের বিস্ফোরণের পর থাকে ভাঙা ঘরবাড়ি, জোয়ারের পর থাকে নদীতে ভেসে-আসা পোড়াকাঠ, ময়লা মাটি। যে-ফুল মাসের পর মাস ফুটে থাকে, তা ফুল নয়; প্লাস্টিকের ফুল। প্রেম মাসের পর মাস ফুটে থাকতে পারে না। প্রেম হচ্ছে প্রেমের তীব্র আবেগটুকু, যখন তা বিয়ারের ক্যানের মতো কানায় কানায় ভরা থাকে; খুললে উপচে পড়ে, তারপর সমস্ত শীতল।

দিনের পর দিন অবিরাম চলতে পারে না ভূমিকম্প।
মাটি ও মানুষকে কয়েক মুহূর্তে থরথর ক’রে
আলোড়িত এলোমেলো ক’রে থেমে যায়-
যে-রকম আমাদের ভালোবাসা।

চৈত্রের গোলাপ টকটকে লাল হয়ে জ্বলে তিন চার দিন।
দীর্ঘশ্বাসের মতো এক গোপন বাতাসে
অগোচরে ঝ’রে যায় অমল পাপড়ি-
যে-সকম আমাদের ভালোবাসা।

তোমার চোখের পাতায় অশ্রুবিন্দু এতো সুন্দর ক্ষণায়ু।
আমাদের অস্তিত্বে এতো টলমল ক’রে উঠে
মুহুর্তেই অনন্তে ঝ’রে যায়-
যে-রকম আমাদের ভালোবাসা।

প্রেমের মধ্যে সবচেয়ে ভালো বাল্যপ্রেম। পাশাপাশি বাড়িতে পাশাপাশি বাড়তে বাড়তে চোদ্দ পনেরো বছরের দিকে বালকটি দেখে বালিকার চোখে ফুল ফুটছে, মাংসে ফুল ফুটছে, চোখে মুহাসমুদ্রের থেকেও বড়ো বড়ো অশ্রুবিন্দু দেখা দিচেছ; বালিকা দেখে ব্যালকটি অন্ধ হয়ে গেছে, তাকে ছাড়া আর কিছু দেখতে পাচ্ছে না, তার দিকেও ঠিকমতো তাকাতে পারছে না; দেখে বালকটির হাত কাঁপছে, পা কাঁপছে, মহাজগত কাঁপছে। এতোদিন তারা একে অন্যকে বলছিলো, ‘তুই’; ওই দিন তারা বলে ওঠে: ‘তুমি’। সে-মুহূর্তে মহাজগতের ইতিহাসে এক যুগান্তর ঘটে। তারা আকাশ ভ’রে গোলাপ, আর মাটি ভ’রে নক্ষত্র ফুটে থাকতে দেখে। তারা হাতে আঙুল নিয়ে খেলে, হাত ধরে থাকে সকলের চোখের আড়ালে। তারা এক মাসে তিনশো চিঠি লেখে, দিনরাত মনে মনে চিঠি পড়তে থাকে। ওই চিঠি রবীন্দ্রনাথের কবিতার থেকে অনেক কাব্যিক, ঐশী শ্লোকের থেকে অনেক পবিত্র। প্রেমে পড়ার সময় হঠাৎ ভোরের অনেক আগে ঘুম ভেঙে যায়, নিজেকে মনে হয় মহাশূন্যে ভাসমান। কিন্তু যার আবেদনে সাড়া মেলেনি, চার মহাজগত ভ’রে যায় তীব্রতম গরলে; সে ঘুমোতে পারে না, মাঝরাতে একা একা হাঁটে, মনে মনে ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে বা আকা বালিকার মুখটিকে নিজের ক্ষুধার মতো সুন্দর ক’রে দেয়ার জন্যে অ্যাসিডের দোকানে যায়।

প্রেম কামের ভূমিকা, পূর্বরাগ হচ্ছে অজস্র সঙ্গমের জন্যে দীর্ঘপ্রস্তুতি। মুখোমুখি বসা, একটু হাত ধরা, হঠাৎ বুক থেকে গান বা কবিতা লাফিয়ে ওঠা হচ্ছে বিকল্পসঙ্গম। প্রেমিকপ্রেমিকা যখন এগোতে থাকে পরস্পরের শরীরের দিকে কমতে থাকে তাদের গান ও কবিতা, তখন গান শুরু ক’রে মাংস ও রক্ত। প্রেমের মধ্যে আধিপত্যের বোধটিও থাকে প্রবলভাবে, প্রেমিক অধিকার করতে যায় প্রেমিকার দেহটি; সে মনে করতে থাকে ওটি তার সাম্রাজ্য, যেটিকে একদিন সে সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত করবে। প্রেমিকাকে হারিয়ে ফেলার সম্ভাবনা দেখা দিলে তার মনে জেগে ওঠে প্রবল ঈর্ষা; সে দুঃস্বপ দেখতে খাকে ওই দেহটি ভোগ করছে অন্য একটি পুরুষ, আর সে পাগল হয়ে ওঠে। একবার মাংসের স্বাদ পাওয়ার পর প্রেমিকপ্রেমিকা আর বারান্দায় সুখ পায় না, তারা চলে যায় ঝোপের আড়ালে, কথা কমে বাড়ে ওষ্ঠ ও আঙুলের কাজ; তারপর কোনো একান্ত কক্ষ পেলে ঢোকে পরস্পরের ভেতরে। এই তো প্রেম। বাঙলাদেশ প্রেমের জন্যে উপযুক্ত ভূভাগ নয়।

প্রেম জীবনে বারবার আসে। পিতৃতন্ত্র পুরুষের জন্যে যেমন কামের অজস্র দরোজা খোলা রেখেছে, তেমনি প্রেমের জন্যেও রেখেছে; নারীর জন্য রাখে নি। নারীপুরুষ বার বার প্রেমে পড়তে পারে, পড়ে, যদিও চারপাশে রটানো হয় শাশ্বত প্রেমের বিজ্ঞাপন। শাশ্বত প্রেম হচ্ছে একজনের শরীরের ভেতরে ঢুকে আরেকজনের স্বপ্ন দেখা। প্রেমিকপ্রেমিকা স্বামীস্ত্রী হয়ে ওঠার পর প্রেম হয়ে ওঠে হাস্যকর; তারা কামের আবেগ বোধ করে, কিন্তু বুকে একবারও প্রেমের কাঁপন বোধ করে না। কেননা ধারাবাহিক প্রেমের উত্তেজনার মধ্যে মানুষ বাস করতে পারে না, মানুষকে আপন করতে হয় অনুত্তেজিত সাদমাটা জীবন। তবে আবার যখন তারা প্রেমে পড়ে অন্য কারো সাথে, দেখা দেয় তীব্র উত্তেজনা, ঘুমহীনতা, ঝড়, ভূমিকম্প, বা গোলাপ ফোটা। দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম প্রেম বলে কোনো কথা নেই; প্রতিটি প্রেমই প্রথম প্রেম। প্রতিটি প্রেমই শরীরের দিকে যাত্রা।