পৃথিবীতে একটিও বন্দুক থাকবে না

নিত্য নতুন ছোরা, ভোজালি, বল্লম উদ্ভাবনের নাম এ-সভ্যতা।
আমি যে-সভ্যতায় বাস করি
যার বিষ ঢোকে ঢেকে গিলে নীল হ’য়ে যাচ্ছে এশিয়া ইউরোপ আফ্রিকা
তার সারকথা হত্যা, পুনরায় হত্যা, আর হত্যা।

যেদিন আদিম গুহায় পাথর ঘ’ষে ঘ’ষে লাল চোখের এক মানুষ
প্রস্তুত করে ঝকঝকে ছুরিকা, সেদিন উন্মেষ ঘটে এ-সভ্যতার
সে যখন ওই ছুরিকা আমূল ঢুকিয়ে দেয়
প্রতিবেশীর লালরঙ হৃৎপিণ্ডে তখনি বিকাশ শুরু হয়
আমাদের আততায়ী সভ্যতার।

এ-সভ্যতা বাঁক নেয় একটা নতুন অস্ত্র আবিষ্কারের মুহূর্তে-
ভোজালি ছেড়ে বল্লমে উত্তরণ সূচনা করে নতুন যুগের,
বারুদের উদ্ভাবনে এ-সভ্যতা হ’য়ে ওঠে আপাদমস্তক আধুনিক।
এ-সভ্যতার যে-পর্যায়ে
মানুষকে খুবই পরিচ্ছন্ন সুচারুরূপে নিশ্চিহ্ন করা যায়,
সে-পর্যায়ই এ-সভ্যতার স্বর্ণযুগ-
আমাদের গৌরব আমরা আজ সভ্যতার অমানবিক স্বর্ণযুগে উপনীত হয়েছি।

আমাদের সৌভাগ্য আমরা খুনী সভ্যতার
চরম বিকাশ দেখতে দেখতে বিকলাঙ্গ, অন্ধ, বিকৃত
হ’য়ে চিহ্নহীন গোরে মিশে যাবো,
কিন্তু চমৎকার অক্ষত থাকবে নগর, আসবাবপত্র, পুঁজি, অর্থনীতি।

আমার শ্যামল কন্যা জন্ম নিয়ে দোলনায় উঠতেই দ্যাখে
তাকে ঘিরে ফেলেছে লাখলাখ সশস্ত্রবাহিনী।
আমার শ্যামল পুত্র জন্ম নিয়ে দোলনায় উঠতেই দ্যাখে
তার দিকে উদ্যত হ’য়ে আছে দশ কোটি অশ্লীল রাইফেল।
আমার কন্যা তার জননীর স্তনের দিকে তাকাতেই দ্যাখে
তাকে ছিঁড়ে খাওয়ার জন্যে দশ হাজার ডিভিশন
পদাতিক বাহিনী কুচকাওয়াজ শুরু করেছে আমেরিকায়;
আমার পুত্র কোলে ওঠার জন্যে বাহু বাড়াতেই দ্যাখে
তিন শো বিমানবাহিনীর দশ হাজার বিমান
ছুটে আসছে তারই মাথা লক্ষ্য ক’রে;
আমার কন্যার বুক লক্ষ্য ক’রে সমুদ্রে সমুদ্রে
ছোটে আণবিক সাবমেরিন,
আমার পুত্রের মাথা লক্ষ ক’রে দশ দিক থেকে
নির্বিচারে নিক্ষিপ্ত হয় ইন্টারকন্টিনেন্টাল ব্যালাস্টিক মিসাইল।

কিন্তু না, পৃথিবীতে আর একটিও বন্দুক থাকবে না।

মানি কি না মানি
পাঁচ হাজার বছর ধ’রে পৃথিবীর সমস্ত
হোয়াইট হাউজ, ক্রেমলিন, দশনম্বর ডাউনিং স্ট্রিট আর বঙ্গভবন
দখল ক’রে আছে মাফিয়ার সদস্যরাই-
পৃথিবীর প্রতিটি রাষ্ট্রপ্রধান মাফিয়ার সক্রিয় সদস্য।
শিশুর হাসির থেকে বুলেটের খলখল শব্দ ওদের বহু গুণে প্রিয়,
গোলাপের গন্ধের চেয়ে লাশের গন্ধ ওদের কাছে বেশি প্রীতিকর।
শয়তান ওদের আত্মা গন্ধক বারুদ দিয়ে প্রস্তুত করেছে।

কিন্তু না, পৃথিবীতে আর একটিও বন্দুক থাকবে না।

যখন পারমাণবিক তেজস্ক্রিয়ার চেয়েও মারাত্মক এক তেজস্ক্রিয়ায়,
যার নাম ক্ষুধা,
বিকলাঙ্গ হ’য়ে যাচ্ছে আফ্রিকা
অন্ধ হ’য়ে যাচ্ছে এশিয়া
বিকৃত হ’য়ে যাচ্ছে আমেরিকা
পঙ্গু হ’য়ে যাচ্ছে ইউরোপ
তখনো মাফিয়ার সদস্যরা পারমাণবিক তেজস্ক্রিয়ার দুঃস্বপ্নে উন্মাদ।

মানুষের দুর্ভাগ্য মানুষ একটি মিশ্র প্রজাতি।
চিরকাল গাধার গর্ভে আর ঔরসে জন্ম নেয় গাধা,
গরুর গর্ভে ও ঔরসে জন্ম নেয় সরল শান্ত গরু,
বাঘের ঔরসে আর গর্ভে কখনো কালকেউটে জন্মে না,
যেমন কালকেউটে কোনো দিন কালকেউটে ছাড়া
প্রসব ক’রে না হরিণ বা রাজহাঁস বা স্বপ্নের মতো কবুতর।
কিন্তু মানুষের ঔরসে আর গর্ভে আমি জন্ম নিতে
দেখেছি প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড গাধা, নর ও নারীর সঙ্গমে
আমি ভূমিষ্ঠ হতে দেখেছি আফ্রিকার নেকড়ের চেয়েও
ভয়াবহ হিংস্র নেকড়ে। ওই নেকড়েরাই চির দিন পৃথিবী চালায়।

কিন্তু না, পৃথিবীতে আর কোনো নেকড়ে থাকবে না।
কিন্তু না, পৃথিবীতে আর একটিও বন্দুক থাকবে না।
পৃথিবীতে আর কোনো শিরস্ত্রাণ থাকবে না
পৃথিবীতে আর কোনো বুট থাকবে না
পৃথিবীতে থোকায় থোকায় জলপাই থাকবে
কিন্তু কোনো জলপাইরঙের পোশাক থাকবে না
আকাশভরা তারা থাকবে কিন্তু কারো বুকভরা তারা থাকবে না
পৃথিবীতে একটিও বন্দুক থাকবে না।

এখন নতুন সভ্যতায় উঠে যেতে হবে পৃথিবীকে
যাতে জন্মেই শিশু শিউরে না ওঠে
তিন বাহিনীর সম্মিলিত কুচকাওয়াজ দেখে,
ট্যাংকের অন্ধ ঘড়ঘড় আর বিমানের কোলাহল শুনে।

জন্ম নেয়ার পর তার দিকে দুলে উঠবে ধান আর গমের গুচ্ছ
তাকে কোলে নেয়ার জন্যে দু-বাহু বাড়াবে আফ্রিকা
দোলনা দুলে উঠবে ইউরোপে
এশিয়ার সমস্ত আকাশে উড়বে লাল নীল রঙিন বেলুন
ঘুমপাড়ানিয়া গান ভেসে আসবে দুই আমেরিকা থেকে
মনুষ্যমণ্ডল থেকে তার জীবনের মাঠে মাঠে অঝোর ধারায়
ঝরবে মানবিকতার উর্বর মেঘদল

না, পৃথিবীতে আর একটিও বন্দুক থাকবে না।