সাহিত্য পত্রিকাহীন সাহিত্য

এককালে কবিদের সাথে সরাসরি সম্পর্ক ছিলো কবিতা উপভোগীদের; কবিরা কবিতা আবৃত্তি ও অভিনয় করতেন, তাদের ঘিরে বসতো পিপাসু শ্রোতারা, কবিদের বুক আর কন্ঠ থেকে শ্রোতাদের শ্রুতি ও হৃদয়ে সরাসরি ঢুকতো কবিতা। একটি মঞ্চ ছিলো কবিদের, যেখানেই দাঁড়াতেন তারা সে জায়গাটিই হয়ে উঠতে মঞ্চ। ওই মঞ্চ ছিলো তাদের আত্মপ্রকাশের ভূমি। সে-সরাসরি সম্পর্কের সরল সময় আর নেই; আধুনিক যুগ এসে সব কিছুকে পরোক্ষ ক’রে তুলেছে। আধুনিক কালে লেখকদের মঞ্চ সাহিত্যপত্রিকা, একে সেতুও বলা যায় পাঠকের কাছে পৌঁছানোর। আধুনিক সাহিত্য প্রথম মঞ্চস্থ হয় সাহিত্য পত্রিকায়। আধুনিক সাহিত্য মঞ্চটিকে বদলে দিয়েছে, আর মঞ্চ বদলে দিয়েছে সাহিত্যকে। সাহিত্য পত্রিকা ছাড়া সাহিত্য প্রকাশ মঞ্চ ছাড়া নাট্যাভিনয়ের মতো। আধুনিক কালে সরাসরি পাঠকের কাছে পৌঁছানোর উপায় নেই। যেগুলো আছে, সেগুলো বিকল্প উপায়; সেগুলো মূল উপায়ের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, সহায়ক। আধুনিক সময়ের সাথে সাহিত্য পত্রিকার ও তার সাথে উপন্যাসের সম্পর্ক এতোই গভীর যে সাহিত্যপত্রিকা না বেরোলে উপন্যাসের জন্মই হতো না। রচিত হতে না দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর উপন্যাস। লেখক ও উপভোগীর যে-সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গেছে, তাকে বাঁচিয়ে রাখছে সাপ্তাহিক বা মাসিক সাহিত্যপত্রিকা। লেখক প্রথমেই বই আকারে বেরোতে চান না, এ-সময়ও চায় না যে লেখক প্রথমেই গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হোক, পাঠকও চায় না। তাই সাহিত্যপত্রিকা ছাড়া সাহিত্য এখন কল্পনা করা যায় না, তবে বাঙলাদেশে অকল্পনীয় ব্যাপারটিই পুরোপুরি বাস্তব। বাঙলাদেশ, সম্ভবত, একমাত্র দেশ যেখানে সাহিত্য আছে কিন্তু সাহিত্যপত্রিকাই নেই; যেগুলো আছে সেগুলোকে সাহিত্যপত্রিকা বলা অতিশয়োক্তি। কিছু সাপ্তাহিক রয়েছে এখানে, সেগুলো নাম মাত্র সাহিত্য প্রকাশ করে; উপকারের থেকে বেশি অপকার করে সাহিতের। ঈদসংখ্যাই ওসব সাপ্তাহিকের সাহিত্যের পরম পরিণতি। দু-একটি ত্রৈমাসিক রয়েছে, যেগুলোকে মনে হয় বুড়োদের লিটল ম্যাগাজিন- যেমন ক্লান্ত, তেমনি মুমূর্ষু; ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে আছে ব’লে পুরোপুরি মরে না, তবে ওগুলোর বাঁচা মৃত্যুর থেকেও মর্মান্তিক। এ-সুযোগে সাহিত্যকে শুশ্রূষা ও শোষণ করে চলছে দৈনিক পত্রিকাগুলো, যেগুলোতে সাহিত্যের একটি পাতা থাকে, পাতা নিয়ে দলাদলি হয়; কিন্তু সাহিত্য যা হয় তা শোচনীয়। একজন ভালো লেখক দৈনিক পত্রিকার নিউজপ্রিন্টের প্রকাশের কথা ভাবতে পারেন না, কিন্ত্র এখানে দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত হতে পারলেও পরিতৃপ্তি বোধ করতে হয়। দৈনিক সাহিত্যের জন্যে কিশোর পাঠকের আগ্রহ থাকতে পারে, প্রকৃত পাঠকের থাকতে পারে না; কারণ ওগুলো কোনো আগ্রহ বা রুচি সৃষ্টি করে না। দৈনিকে সাহিত্য গৌণ, সংবাদ মুখ্য। ওই সাহিত্য যেমন পাঠককে সাহায্য করে না উপভোগে, তেমনি লেখককে অনুপ্রাণিত করে না সৃষ্টিতে। সাহিত্যপত্রিকার অর্থ হচ্ছে তা নিয়মিত হবে, বিশেষ সময়ে তাকে পাওয়া যাবে, তার চরিত্র খাকবে, তা প্রথাগত সাহিত্যের সাথে নতুন সাহিত্য বিকশিত করবে। জাতি হিসেবে বাঙালি এখন বন্ধ্যা, তার কোনো সৃষ্টিশীলতা নেই; – সাহিত্যপত্রিকার অভাব এ-দিকটি যেমন স্পষ্ট নির্দেশ করে, অন্য আর কিছু বোধ হয় এতোটা করে না।

সাহিত্যপত্রিকা নেই বলেই বাঙলাদেশে সাহিত্য এখন একটা বিশেষ ঋতুর পণ্য হয়ে দাড়িয়েছে। সাহিত্যপত্রিকা থেকে লেখক আত্মপ্রকাশ করেন গ্রন্থাকারে, তা হওয়া স্বাভাবিক বছরের যে-কোনো সময়ে। কিন্তু এখানে উপন্যাস হয়ে উঠেছে ঈদের ও ফেব্রুয়ারির পণ্য;- এক উৎসবের চাপে ওগুলো লেখা হয়, আরেক উৎসবের তাড়ায় ওগুলো বই হয়ে বেরোয়। চাপে ও তাড়ায় গুলো কৃশ থেকে কৃশতর হচ্ছে, ঈদ ওগুলোকে নিউজপ্রিন্টের পঁচিশ-ত্রিশের বেশি পাতা দিতে পারে না, লেখকেরাও তার বেশি পারেন না আর একুশের উৎসবে ওগুলো কোনোরূপে সত্তর-আশি পাতার রূপ ধরে। সাহিত্যচর্চা এখানে খণ্ডকালীন কাজ, বই প্রকাশও ফেব্রুয়ারির কর্ম; ফেব্রুয়ারি এখন গুটিকয় ‘অপন্যাস’ উপহার দিয়ে নিজেকে ধন্য বোধ করে। দেশে প্রকৃত প্রবন্ধ দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে। সাহিত্য, ও অন্য কোনো বিষয়ক চিন্তামূলক প্রবন্ধ এখানে চোখে পড়ে না; অপরাজনীতিক সাংবাদিকতা পরিচিত হয়েছে প্রবন্ধ নামে। গত কয়েক বছরে এমন কোনো প্রবন্ধ বা প্রবন্ধগ্রন্থ পড়িনি যা একটু ভাবতে উৎসাহিত করে। তথাকথিত প্রবন্ধের বই বেশ বেরোয়, তবে তার অধিকাংশই অপসাংবাদিকতা বা অপগবেষণা। কবিতা এখন বড়ো বেশি অসুস্থ। দৈনিক বা বুড়োদের লিটল ম্যাগাজিনের কবিতা পড়ে মনে হয় বাঙলা ভাষা সম্ভবত আর কবিতা লেখার উপযোগী নয়। ভাষার সমস্তু সজীবতা নষ্ট করা হয়ে গেছে, প্রতিটি শব্দ ফ্যাকাশে হয়ে পড়েছে, কামনাবাসনা, আবেগ বা স্বপ্ন, বিশ্বাসঅবিশ্বাস, চিৎকার ও চুম্বন সবই শুয়োরর মাংস হয়ে উঠেছে। রাজনীতিক সামাজিক কারণ রয়েছে এর পেছনে, এবং রয়েছে শিল্পবোধশূন্যতা, যা জন্মেছে সাহিত্যপত্রিকার অভাব থেকে। সাহিত্য পত্রিকা পরিবেশ সৃষ্টি করে শিল্পের, তা ভাবায়, আলোড়িত করে, দিক নির্দেশ করে। বই পাঠকের কাছে পৌঁছাতে সময় নেয়, গৃহীত হয় দেরিতে- বিশেষ ক’রে আমাদের সমাজে, কিন্তু সাহিত্যপত্রিকা সপ্তাহে বা মাসে বা ঋতু ঋতুতে এসে সজাগ ক’রে তোলে, ও সজাগ থাকতে বাধ্য করে। সাহিত্যপত্রিকা মানদণ্ডের মতোও কাজ করে। লেখকেরা ওই পত্রিকার মান অর্জনের ও অতিক্রমের সাধনার প্রেরণাবোধ করেন সব সময়। এখানে সাহিত্যপত্রিকা নেই, কিন্তু উপসংস্কৃতির পত্রিকায় রাস্তা আবর্জনাপূর্ণ হয়ে আছে। সাহিত্যপত্রিকা নির্দেশ করে সংস্কৃতির, সাহিত্যের প্রধান রূপটিকে, উপসংস্কৃতির পত্রিকা প্রচার করে উপরূপটি। সাহিত্যপত্রিকা না থাকার পরিণাম হচ্ছে উপসংস্কৃতির ধারাটির প্রধান সংস্কৃতির ধারা হয়ে ওঠা; বাঙলাদেশে তাই হচ্ছে। এক তরুণী চিকিৎসক, যে ছাত্রী হিসেবে মেধাবী ছিলো, লিখতেও ভালো, আমাকে সম্প্রতি বলেছে যে এখন সে ‘দেশ’ -এর মতো আধা লঘু আধা গুরু পত্রিকা প’ড়েও বুঝতে পারে না, এমনকি পড়তেও ভয় পায়। সাহিত্যপত্রিকা না থাকায়, ও উপসংস্কৃতি পত্রিকা বেশি থাকায়, সে খাদা হয়ে পড়েছে উপসংস্কৃতির। কেলেংকারির বিবরণ সে উপভোগ করে, কিন্তু সাহিত্য ও চিন্তা তাকে পীড়িত করে। সাহিত্যপত্রিকা শুধু সাহিত্য প্রকাশ করে না, গোপনে গোপনে তা সাহিত্য সৃষ্টি করে। সৃষ্টি কোনো স্বতঃস্ফূর্ত ব্যাপার নয়, হ’লেও পুরোপুরি নয়, পেছনে যদি উদ্দীপক থাকে তাহলে সাড়া না দিয়ে পাৱা যায় না। অনেক কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস- পৃথিবী জুড়ে- লেখাই হতো না, যদি না উদ্দীপক হিসেবে কাঙ্গ করতো সাহিত্যপত্রিকা। রবীন্দ্ররচনাবলির অধিকাংশ জন্মেছে সাহিত্যপত্রিকার পীড়নে বা প্রেরণায়: যদি সম্পাদকেরা তাকে পীড়িত না করতেন, তাহলে ওই মহাসৃষ্টিশীল প্রতিভাও বন্ধ্যা অবসর কাটাতেন, মন নিষ্ক্রিয় থাকতো, টেবিলে থাকতো শূন্যপৃষ্ঠা। মন পুরোপুরি শূন্য, মনে হচ্ছে সেখানে কিছুই জন্ম নেবে না। এমনকি আগাছাও নয়, এমন সময় সম্পাদকের কাছ থেকে চাল এলো, কিছুটা বিবশ সময় কাটানোর পর দেখা গেলো মনে চাষ শুরু হয়ে গেছে, কে যেনো বীজ ছড়াচ্ছে, চারা মাখা তুলছে, ফসলে জমি ভ’রে গেছে। ফসল ফলালো কাগজের সাদা জমিতে। সাহিত্যপত্রিকা তা পৌঁছে দিলো গন্তব্যে। আধুনিক মহৎ সাহিত্যের বড়ো অংশ জন্মেছে সাহিত্যপত্রিকার ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে। বাঙলাদেশে লেখকেরা বন্ধ্যাত্বে ভোগেন, সাহিতপত্রিকা তাদের ডাক দেয় না ব’লে। সাহিত্যপত্রিকা, সাহিত্যের অনুপ্রেরক ও মঞ্চ, আমাদের নেই। তাই সাহিত্য আছে, এটা বড়ো বিস্ময়। তবে ওই সাহিত্যের সামানই সাহিত্য, বড়ো অংশই সাহিত্যের ছদ্মবেশ বা ছদ্মরূপ।