শালগাছ

তখন ছিলাম ছোটো,
চোখেমুখে এসে পড়তো অন্যান্য গাছের বুড়ো ডালপালা।
স্বপ্নে-শিরে খ’সে পড়তো মরা পাতা, শুকনো বীজ,
হাড়ের মতোন শক্ত পোক-খাওয়া শাখা।
শিশিরঅবাক চোখে চাইতাম, চারপাশে বিছানো বিস্ময়!
সামনে দাঁড়ানো ছিলো, বেশ উঁচু একটা হিজল;
ক্ষণেক্ষণে ভাবতাম ওর মতো হতে পারি যদি!
একটা বামন তরু- কী রকম রগড় করতো- যেনো সমকালে
পৃথিবীর কোনো বনে ওর মতো আর কেউ নেই।
একদিন দেখলাম: কী-একটা গাছের চুড়োয় ঢেউ খেলছে
লাল-নীল-সবুজ-হলুদ; কিন্তু সেই রঙিন উজান
ভাটায় গড়ালো আস্তে দু-দিন যেতেই।
সামনে আঁধার, পেছনে আঁধার, বাঁয়ে অন্ধকার,
ডানে অন্ধকার; চারপাশে গাছের আঁধার।
কখনো চোখের মণিতে ঢুকতো আঁধারের বিপরীত-
সোনার পানিতে গলছে তরল আঁধার, গ’লে গ’লে রুপো হচ্ছে
আবার গলানো লাল মাণিক্য হ’য়ে রাত্রি নামছে।
সোনা-জল-ঢালা সেই অদেখা সোনাকে মনে মনে ডাকলাম- সূর্য!
তারপর অন্ধকার নিজের মুখের রূপে ধুয়ে ফেললো এক নারী;
স্বপ্নে ডাকলাম- চাঁদ!
তরুণ শালের কোঁড়া গাছের আঁধার ভেদ ক’রে হিজল-বামন ছেড়ে

সোনা ও নারীর দিকে বাড়তে লাগলাম।
পাগল বাতাস এলো- আর সে-বাতাসে ভেসে এলো স্বপ্ন-
কে যেনো বসলো ডালে- কেঁপে উঠলাম আশিরশেকড়-
সে গ্রামার আদিশিহরণ!
কে এসে বসেছিলো?- জানি না- তাকে ডাকলাম: পাখি!
সে উড়ে যাওয়ার কালে যে-জল ছড়িয়ে গেলো,
তাকে আমি আজো বলি- সুর!
বামন গাছটা এর মাঝে হাঁটুর তলায় প’ড়ে গেছে,
মাঝেমাঝে কুড়োয় সে আমার একটি-কী দুটো ঝরাপাতা।
হিজল তাকায় কেমন করুণ দু-চোখে।
এক মোহিনী- ডেকেছিলাম সঞ্চারিণী লতা-
গোপনে রক্তের মধ্যে ঘুমভরা ছোঁয়া ঢেলে
বেয়ে উঠতে লাগলো আমার হৃৎপিণ্ডের দিকে;
হৃৎপিণ্ডের কাছাকাছি এসেই মোহিনী লীলায় ফুটিয়ে দিলো
রঙ- সে-রঙিন লাস্যকে আমি বলি- ফুল!
মোহিনীর রূপ থেকে চোখ তুলে ওপরে তাকিয়ে দেখি নীল!
আন্দোলিত নীলের ভেতর থেকে ভেসে ওঠে একখণ্ড রক্তমাণিক্য
মধ্যমায় প’রে নিই,
দিনান্তে ধোয়ার জন্যে ছুড়ে দিই নীলেজলে;
পুনরায় পরিশুদ্ধ ভোরে এসে ব’সে সে আমার আংটিতে।
টের পেয়েছিলাম অনেক আগে মূল-শেকড়টি বেড়ে বেড়ে
গিয়ে পড়েছে এক মধুঝর্নার বক্ষস্থলে।
যতোই গভীরে যাই, মধু;
যতোই ওপরে যাই, নীল!
শিকড় চালাই, মাটির গভীর থেকে মধুর গভীরে;
শিখর বাড়াই, মেঘের ওপর থেকে নীলের ওপরে।
আমার সঙ্গী সেই বুড়ো ও বামন গাছগুলো আজকাল
ঝ’রে যাচ্ছে।
ম’রে যাচ্ছে
আমি শুধু মধু থেকে নীলে নীল থেকে মধুর ভেতরে
ছড়াচ্ছি নিজেকে।