শামসুর রাহমানকে দেখে ফিরে

চৈত্রের কর্কশ বিকেলে ষোলো নম্বর কেবিনের দরোজায়
গিয়ে দাঁড়ালাম, দেখলাম শামসুর রাহমান, আপনি ঘুমিয়ে আছেন,
দারুণ খেলার শেষে শ্রান্ত শিশুর মতো। আপনার
হাঁ-খোরা মুখগহ্বর ভ’রে গুমোট আবহাওয়া। যে-অমল বাতাসের
স্তব করছেন আপনি বত্রিশটি কাব্যগ্রন্থের ষোলো শো
কবিতা জুড়ে, তার কূট ষড়যন্ত্রে ভয়াবহ পর্যন্ত আপনার সমগ্র
কাঠামো। আপনার বুকের ওপর জিভ বের ক’রে
ঝুঁকে ব’সে আছে সেই কুখ্যাত আঁধার, যার হিংস্র নখের থাবায়
হৃৎপিণ্ড চিৎকার ক’রে ওঠে বুনো শুয়োরের মতো।
আপনার মগজে হয়তো তখন রঙিন আঁচল উড়োচ্ছিলো
রূপসী কবিতা; তার ওষ্ঠের অসহ্য আদরে ও আলিঙ্গনে কেঁপে
উঠছিলেন আপনি অপ্রাপ্তবয়স্ক প্রেমিকের মতো। হয়তো
দুঃস্বপ্নে দেখছিলেন আপনার গৃহপরিচারক কিশোরটি
রবীন্দ্রনাথের রূপ ধ’রে আপনার দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে তার
কল্যাণকম্পিত হাত। হয়তো দেখছিলেন সারিসারি ট্যাংক-
বাঙলার গ্রামগঞ্জ ধানক্ষেত কৃষকের
সামান্য উঠোন সংখ্যাহীন অতিকায় কিম্ভুত ট্যাংকের নিচে
চাপা প’ড়ে যাচ্ছে দ্রুত; দেখছিলেন দিকে দিকে চৌকশ
কুচকাওয়াজ; আর বাঙলার প্রতিটি সড়ক বেয়ে গলগল ক’রে
ব’য়ে যাচ্ছে নামপরিচয়হীন শহিদের রক্তের ঢল; এবং সমস্ত
দুর্দশা, রক্তপাত, বিক্ষোভ, প্রগতি ও প্রতিক্রিয়াশীলতার মাথার ওপর
পদ্মের মতোন পা রেখে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক আশ্চর্য রূপসী।

শামসুর রাহমান, যখন আপনার রক্ত আর বুক জুড়ে
থরোথরো প্রেম আর প্রতিবাদী বিদ্রোহী রাজনীতি, তখনি
হাসপাতাল ডাকলো আপনাকে। আপনার বুক ভ’রে
জন্ম নিলো ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইলব্যাপী বিষণ্ণ বাঙলাদেশের
মতো ভয়াবহ ব্যাধি। ভয়ানক অসুস্থ আপনি, তবে
একা আপনিই অসুস্থ নন শুধু, আমি নিজেও তো বার বার
কেঁপে উঠি প্রচণ্ড ব্যথায়, বুকে হাত চেপে ব’সে পড়ি,
যেনো ভূমিকম্প হচ্ছে সৌরলোক জুড়ে। শামসুর রাহমান,
আপনি নিশ্চয়ই জানেন আমাদের বিপন্ন বিষণ্ণ বাঙলায় আজ
প্রতিটি প্রকৃত মানুষই অসুস্থ, যাদের হৃদয়ে কাঁপে মানবিক
জ্যোৎস্না, যারা মুগ্ধ হয় পালতোলা নৌকো আর সবুজ পাতার
শিহরণে, যারা হাহাকার ক’রে ওঠে ব্যাপক পাশবিকতা
দেখে, তারা সবাই অসুস্থ। এখন অসুস্থ ওই দূরের নীলিমা, নদী,
ধানের গুচ্ছ, বাঁশের বাঁশরী ও কবিতার প্রতিটি স্তবক।
শুধু সুস্থ আজ পাড়ার মাস্তান, গুণ্ডা, খুনি, ছিনতাইকারী, সুস্থ
তারা যাদের মগজ ও হৃৎপিণ্ড অবস্থিত প্রচণ্ড পেশিতে।
আপনি যদি স্বপ্ন আর শব্দের শোভার জন্যে উৎসর্গ না করতেন
এতোগুলো সংরক্ত দশক, যদি যত্নে বানাতেন পেশি,
আপনি হতেন যদি উৎকোচনিমগ্ন আমলা, চোরাকারবারি,
পেশাদার রাজনীতিক দালাল; দশকে দশকে যদি অপদেবতাদের
প্রণাম করতে পারতেন নির্দ্বিধায়, যদি মানুষের সঙ্গ ছেড়ে
সংঘবদ্ধ হ’তে পারতেন দানবদের সাথে, তাহলে এমন অসুস্থ
হ’তে হতো না আপনাকে। মানুষই অসুস্থ হয়
দানবেরা কোনো কালে কখনোই অসুস্থ হয় না।
সম্প্রতি আপনি খুব আশাবাদী আর প্রতিবাদী হ’য়ে উঠেছিলেন।
কিন্তু আপনি কি জানেন যে আমরা কোথাও নেই? যারা
স্বপ্ন দেখে সুন্দরের, প’চে যাওয়া সমাজ-রাষ্ট্রকে যারা গোলাপের
মতো সুন্দর দেখতে চায়, যারা মনুষ্যত্ব-মানবিকতাকে
ভোরের আলোর মতো সত্য ব’লে মানে, আপনি কি জানেন তারা
কোথাও নেই? আমরা তো উদ্বাস্তুর মতোই রয়েছি বাঙলায়।
আপনি কি খুব জোর দিয়ে বলতে পারবেন যে আপনার
পায়ের নিচের মাটি খুবই শক্ত? শক্ত মাটি তো শুধু নষ্টদের
পদতলে। আমরা, শামসুর রাহমান, চোরাবালির ওপর
দাঁড়িয়ে রয়েছি। পচা অমরতা ধুয়ে ধুয়ে খেয়ে বেঁচে থাকতে
চান আপনি লোকন্তরিত হওয়ার পর? তাও মিছে স্বপ্ন আজ,
বাঙলায় এখন নষ্টরাই অমর ও প্রাতঃস্মরণীয়। আপনাকে,
আমাকে সমকাল প্রত্যাখ্যান করেছে, ভবিষ্যৎও অবলীলায়
আমাদের প্রত্যাখ্যান ক’রে কোলাহল করবে নষ্টদের নিয়ে।
তাকিয়ে দেখুন, আপনি কোথায় আর সারাদেশ যাচ্ছে কোন দিকে।
কেনো অকস্মাৎ থেমে যায় রাস্তার গণজাগরণ? কারা লিপ্ত
ষড়যন্ত্রে, কেননা ব্যর্থ হয় শহিদের উদার রক্ত?
আশা কি এখনো আপনাকে নর্তকীর মতোন নাচায়?
শামসুর রাহমান, আপনি যখন হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসবেন
তখন ঢুকবেন এক বিশাল হাসপাতালে, দেখবেন দুরোরোগ্য
বক্ষব্যাধিতে আক্রান্ত সমগ্র বাঙলা, তার মাটি নদী ও আকাশ।