শিশুরা কি পড়বে না?

ঢাকার ঘরে ঘরে এখন শিশুদের বিষণ্ণ মুখ দেখা যাবে। তারা বিষণ্ণ, পীড়িত, কেননা জীবনের প্রধম ব্যর্থতা তাদের দংশন করছে। এর আগে তারা অনেক কেঁদেছে, তাদের চোখে জল ঝলমল করেছে, ওই কান্না আর চোখের জল শৈশবের সোনার মতো; কিন্তু এই প্রথম তাদের চোখে দেখা দিয়েছে ব্যক্তিগত ব্যর্থতার অশ্রু। ব্যর্থতা ও সাফল্যের কোনো ধারণা ছিলো না তাদের, তারা জানতো না পৃথিবীতে আছে ব্যর্থতাসাফল্য নামক এক বাজে ব্যাপার, তবে এই প্রথম, পাঁচ বছর বয়সেই, বুঝতে পারছে এমন কিছু আছে, যাতে চোখে আপনাআপনি জল আসে, বুক থেকে ওঠে অনা রকম কান্না। তারা বুঝতে পারছে তারা ব্যর্থ। জননী বঙ্গভূমি এভাবেই তার সন্তানদের জীবন-অভিজ্ঞ ক’রে তুলেছে। ব্যর্থতাই হয়ে উঠছে তাদের আদি অভিজ্ঞতা। ওই শিশুদের ব্যর্থতা-তারা বিদ্যালয়ে ভর্তির জন্যে পরীক্ষা দিয়েছিলো, কিন্তু ভর্তির জন্যে মনোনীত হয় নি; তারা ভর্তি হতে পারবে না। তারা জানে না কারা মনোনীত করে কেনো করে বা করে না, কিন্তু তারা পাঁচ বছর বয়সেই বুঝে ফেলছে তারা বার্থ। এই তারা প্রথম নিজের দায়িত্ব নিয়েছিলো, কিন্তু তা পালন করছে পারেনি। তারা অনেক রূপকথা শুনেছে, অনেক ভয়ংকর রূপকথা ঘটে গেছে তাদেরই জীবনে; হয়তো ভাবছে যে রূপকথার দৈত্যটিই তাদের মনোনীত করেনি। যে-বিদ্যালয়ে ভর্তির জন্যে তারা পরীক্ষা দিয়েছিলো, সেটিকে হয়তো এখন তাদের কাছে ডাইনিদের পুরী ব’লে মনে হচ্ছে; যারা পরীক্ষা নিয়েছিলো, তাদের মুখ হয়তো ব্যর্থ শিশুদের চোখে দৈত্যের বিকট মুখরূপে ভাসছে। জীবনের শুরুতেই একটি মনস্তাত্ত্বিক আঘাত পেয়েছে তারা, ওই আঘাতে যে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, তাতে বিষণ্ণ ওই শিশুদের মুখ। তারা এখন আর আগের মতো উৎফুল নয়, তারা চিৎকার ক’রে বাড়ি মাতায় না; বিছানায় শুয়েই ঘুমিয়ে পড়ে না, ব্যর্থতা তাদের চোখের ঘুম শুষে নিয়েছে। শিশুরা ঠিক কী ভাবছে, আমরা জানি না; কিন্তু ব্যর্থতার কামড় যে তাদের কষ্ট দিচ্ছে, তাতে সন্দেহ নেই।

একটি করুণ হাস্যকর ব্যাপার হচ্ছে ভীতির জন্যে শিশুরা পরীক্ষা দিয়েছিলো। ওই শিশু, যে-জীবনে প্রথম ঢুকতে যাচ্ছে স্কুলে, তাকেও পরীক্ষা দিতে হয়, মনোনীত হ’তে হয়, ব্যর্থ হ’তে হয়। অনেক প্রস্তুতি নিয়েছিলো তারা; কোনো শিশুবিদ্যালয়ে এক বছর পড়েছে, ইংরেজি বাঙলা অঙ্ক শিখেছে, ছবিও আঁকতে শিখেছে; তারপর বিশেষ একটি বিদ্যালয়ে ভর্তির জন্যে পরীক্ষা দিয়েছে। তাদের পিতামাতারা দামি ফর্ম কিনেছে, পূরণ করেছে; কেউ সত্য তথ্য দিয়েছে, কেউ ভেবেচিন্তে দিয়েছে মিথ্যে তথ্য। কেউ জানে না বিদ্যালয়টি কাদের মনোনীত করবে, কী যোগ্যতা অনুসারে করবে, যোগ্যতা যাচাইয়ের কোনো মানদণ্ড আসলেই আছে কিনা? পরীক্ষায় ভালো করলেও বাদ পড়তে পারে, খারাপ করলেও বাদ পড়তে পারে, বয়স ঠিক মতো জানালেও বাদ পড়তে পারে, না জানালেও বাদ পড়তে পারে। মনোনীত করার অর্থ হচ্ছে বাদ দেয়া, স্কুলগুলো ভর্তির সময় বেশ একটা রাজকীয়ভাৰ নেয়; স্কুলের প্রধান শিক্ষকশিক্ষয়িত্রীরা এমন ভঙ্গি করেন যেনো অভিভাবকেরা কীটপতঙ্গ। ঢাকার স্কুলগুলোর শিক্ষকেরা এতো অভদ্র কেনো? অভিভাবকেরা প্রধান শিক্ষকশিক্ষয়িত্রীর সামান্য করুণার জন্যে ছুটতে থাকে, কিন্তু প্রধানেরা রাষ্ট্রপ্রধানের থেকেও দুষ্প্রাপ্য হয়ে ওঠেন। যে-শিশুরা মনোনীত হয়, তারা যে খুব যোগ্য আর অমনোনীতরা যে অযোগ্য এমন নয়; এক ধরনের খামখেয়ালি, আর ভেতরের নানা সূত্র, কাউকে অমনোনীত আর কাউকে মনোনীত ঘোষণা করে।

কারা কেনো মনোনীত হলো আর কারা কেনো হলো না, এটা বড়ো প্রশ্ন নয়, প্রশ্ন হচ্ছে শিশুদের জীবনে প্রথম শ্রেণীটিতে ভর্তির জন্যে পরীক্ষা দিতে হবে কেনো? কেনো তাদের জীবন শুরু হবে প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে? বাদ পড়ার সম্ভাবনা মাথায় ক’রে? জীবনের শুরুতেই কি তাদের প্রমাণ করতে হবে যে তারা যোগ্য, তারা ভর্তি হওয়ায় যোগ্য, আর পড়াশুনোর অধিকার রয়েছে শুধু যোগাদের? প্রতিটি শিশুরই রয়েছে পড়াশুনোর অধিকার, পড়ানোর জন্যে তার কোনো যোগ্যতা প্রমাণের দরকার নেই। এটা তার অধিকার। এপর হয়তো এ-সমাজে নিশ্বাস নেয়ার যোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে, প্রমাণ করতে হবে বেঁচে থাকার যোগ্যতা। প্রতিযোগিতায় দেশ ছেয়ে গেছে, অধিকাংশ প্রতিযোগিতায় সাধারণত নিকৃষ্টরাই জয়ী হচ্ছে আজকাল, আর শিক্ষাক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে মারাত্মক সংকট। প্রতিবছর কয়েক লক্ষ ছাত্র ব্যর্থ হচ্ছে মহাবিদ্যালয়ে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশে; এটা তাদের অযোগ্যতার জন্যে নয়, শিক্ষাব্যবস্থার অযোগাতারই জন্য। ওপরের দিকে হয়তো প্রতিযোগিতার কিছুটা দরকার আছে, কিন্তু শিশুরা স্কুলে পড়বে, সেখানেও প্রতিযোগিতা? তাহলে কি ধ’রে নেবো শিক্ষাকে আমাদের রাষ্ট্র নাগরিক অধিকার ব’লে গণ্য করে না? রাষ্ট্র কি মনে ক’রে কিছু শিশু ভর্তি হবে স্কুলে, পড়াশুনো করবে, এবং অধিকাংশ শিশু পড়াশুনো করবে না? ঢাকা শহরে যে-কটি স্কুল রয়েছে, সেগুলো খুব কমসংখ্যক শিশুরই শিক্ষার ব্যবস্থা করতে পারে। পাড়ায় পাড়ায় এখন শিশুবিদ্যালয় গড়ে উঠেছে, সেগুলো কিছুটা উপকার করে, কিন্তু সেগুলোতে যেহেতু ওপরের শ্রেণীতে পড়ার কোনো ব্যবস্থা নেই, তাই সেগুলো কোনো প্রকৃত উপকারেই আসছে না। রাষ্ট্র এ নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তিত নয়, রাষ্ট্র সমস্ত নাগরিকের অধিকার কেড়ে এখন শিশুদের মৌলিক অধিকারও কাড়তে শুরু করেছে।

যে-শিশুরা কোনো বিদ্যালয়েই স্থান পায় নি, তারা কী করবে? তাদের পিতামাতারা উদ্বিগ্ন জীবনযাপন করছে, কিছুতেই উদ্ভাবন করতে পারছে না তারা ব্যর্থ সন্তানদের সমস্যা সমাধানের। ওই শিশুরা কি ঘরে বসে থাকবে, তাদের জন্যে আমরা কি পড়াশুনো নিষিদ্ধ করে দেবো? রাষ্ট্র কি পাঁচ ভাগ শিশুর পড়াশুনোর ব্যবস্থা করবে আর অবশিষ্টদের রেখে দেবে জাতীয় মূর্খ হিসেবে। ঢাকা শহরে এখন যতো স্কুল আছে, তার দশগুণ স্কুল হয়তো দরকার; ওই সমস্ত স্কুল স্থাপনের দায়িত্ব সরকারের, কিন্তু গত দশ বছরে হয়তো ঢাকা শহরে দশটি স্কুলও স্থাপিত হয় নি। এভাবেই রাষ্ট্র অবহেলা করছে নাগরিকদের সমস্ত অধিকার;- তাদের খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা, চাকুরির অধিকার নেই; এবং শিশুদের নেই শিক্ষার অধিকার। সরকার সম্ভবত নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার পক্ষপাতী। জন্মনিয়ন্ত্রণে সরকারের অপার উৎসাহ, দু’টি সন্তানকেই সরকার যথেষ্ট মনে ক’রে, এরপর হয়তো মনে করবে একটি সন্তানকে পড়াশুনো করানোই যথেষ্ট। শিক্ষা খানুষের একটি মৌল অধিকার;- প্রাথমিক শিক্ষা লাভের জন্যে কোনো যোগাতার দরকার পড়ে না। বাংলাদেশে কমপক্ষে ত্রিশটি বিশ্ববিদ্যালয় দরকার, সেকথা সরকারের মনে পড়ে না, যদিও বিচিত্র কুক্ষেত্রে সরকার অর্থ অপচয় করে চলছে। দেশ জুড়ে প্রতি বছর কয়েকশো স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠিত হওয়া দরকার, কিন্তু তা কারো চিন্তায় নেই। রাষ্ট্রের চোখে শিশুরা হয়তো খুবই সামান্য, কিন্তু তারা অসামান্য, কারণ তারা আগামীকালের মানুষ। যে-সমাজ আগামী মানুষের কথা ভাবে না ভাবে শুধু নিজেদের কথা, তা বর্বর সমাজ। আমাদের সমাজের বর্বরতা খুবই স্পষ্ট। এখন ভর্তির ক্ষেত্রে যে বাছাই প্রক্রিয়া রয়েছে, তা সম্পূর্ণরূপে বর্বর। শিশুরা যোগ্যতা-আযোগ্যতার উর্ধে, পৃথিবীর সব কিছুতেই রয়েছে তাদের অধিকার, আর সে-সবের মধ্যে শিক্ষা অন্যতম প্রধান। ওই ব্যর্থ বিষণ্ণ শিশুদেৱ মুখ আমি দেখতে পাই। যে-সমাজে এমন বিষণ্ণ শিশুরা রয়েছে, সেখানে কারো হাসা অপরাধ; সেখানে টেলিভিশনে রাষ্ট্রব্যবস্থাপকদের হাস্যোজ্জ্বল মুখ দেখানো অপরাধ। অপরাধীরা কি শিশুদের কথা একটু ভাববে, ভাবার অবসর হবে তাদের?