উপাচার্যগণ, তাঁদের সংস্কৃতি ও পরিণতি

যদি বলি তৃতীয়-চতুর্থমানের অধ্যাপকেরাই উপাচার্য নির্বাচিত ও মনোনীত হন, বেশ খর্ব ব্যক্তি বিস্ময়করভাবে অধিকার করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে উঁচু পদটি- অবশ্য পদের কোনো মূল্য নেই আমার কাছে- তাহলে তা থেকে আমি কতোটা দূরে থাকি? বইপত্র থেকে সাধারণত যারা দূরে থাকেন, জ্ঞানী ব’লে যারা গণ্য হন নি ও হবেন না, অধ্যাপকসাজে যারা ব্যাপক পরিহাস উপহাসের পাত্র, যাদের সাংস্কৃতিক মান অত্যন্ত নিচু, মৃত্যুর পর যারা একটি লাশ ছাড়া আর কিছু রেখে যাবেন না, তারাই একদিন প্রকৃতি ও রাজনীতির অমোঘ বিধানে উপাচার্য হন। আমি বেশ কয়েকটি বা কয়েকজন উপাচার্য দেখেছি; তাঁদের যে-দিকটি আমার মনে দাগ কেটেছে, তা হচ্ছে তাঁদের নিম্ন সাংস্কৃতিক মান। তাঁদের অনেকে উপাচার্য শব্দটিও ঠিকমতো উচ্চারণ করতে পারে না। তারা অশুদ্ধ বাঙলায় কথা বলেন ও নথিপত্র লেখেন, ইংরেজি বলতে গেলে সৃষ্টি করেন একটি নতুন ভাষা যার নাম দিতে পারি ‘উপাচার্যের ইংরেজি’। উপাচার্যরা সভাপতি ও প্রধান অতিথি হ’তে ভালোবাসেন, সুবিধাবাদী সংগঠনগুলোও খুব ভালোবাসে উপাচার্যদের সভাপতি-প্রধান অতিথি ক’রে আনতে; এবং উপাচার্য সেখানে লোমহর্ষক বক্তৃতা দিয়ে থাকেন। গরু, ছাগল, কাতলা মাছ থেকে পিকাসো, রবীন্দ্রনাথ, আরিস্তুতল সম্পর্ক নির্ভয়ে তাঁরা বক্তৃতা দেন; কথায় কথায় ভুল শব্দ প্রয়োগ করেন, উচ্চারণের একশেষ ক’রে ছাড়েন, পিকাসোকে ‘পিসাকো’ লেনিনকে ‘লেলিন’, সাঁঝের মায়াকে ‘সাজের মেয়ে’ বলেন, সত্যজিতের চলচ্চিত্র উৎসবে গিয়ে সত্যজিৎকে মৃত ভেবে তার রুহের মাগফেরাত কামনা করেন। টিভির এক অনুষ্ঠানে এক উপাচার্যকে তার প্রিয় কবিতার পঙক্তি বলতে অনুরোধ করা হয়েছিলো; ওই উপাচার্য অনুরোধ শুনে শিশুর মতো এদিক-সেদিক তাকাচ্ছিলেন, তারপর শিশুর মতোই বলেছিলেন তাঁর প্রিয় কবিতার পঙক্তি হচ্ছে, ‘ওই দেখা যায় তাল গাছ ওই আমাদের গাঁ, সেইখানেতে বাস্ করে কানিবগের ছা।’ আমাদের অধিকাংশ উপাচার্যের সংস্কৃতিকে বলতে পারি কানিবগের সংস্কৃতি। এরা যখন ভার পান একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের তখন সেটিকে নামিয়ে নেন নিজের স্তরে চারপাশে ছড়িয়ে দেন নিজেদের অপসংস্কৃতি। এক উপাচার্য সম্প্রতি শহীদ শিক্ষকদের পত্নীদের আখ্যায়িত করে ‘দুস্থ মহিলা’ রূপে; – এটা যে তিনি খারাপ উদ্দেশ্যে থেকে করেছেন, তা নয়; তাঁর উদ্দেশ্য হয়তো ছিলো খুবই চমৎকার, কিন্তু তাঁর সাংস্কৃতিক নিম্নতার কারণে ঠিক শব্দটি বা ধারণাটি বেছে নিতে পারেন নি তিনি। প্রকাশ করে ফেলেছেন নিজের সাংস্কৃতিক দুস্থতা।

উপাচার্যদের সাক্ষাৎকারগুলো তাঁদের ভাষণের মতোই রোমহর্ষক। কয়েক বছর আগে এক উপাচার্য মুক্তিযুদ্ধকে বলে ‘গণ্ডগোলের সময়’। তিনি যে রাজাকার ছিলেন বা মুক্তিযুদ্ধকে হেয় করতে চেয়েছিলেন, তা নয়’ রিকশাওয়ালারা, শ্রমিকেরা মুক্তিযুদ্ধকে ‘গণ্ডগোলের সময়’ই বলে থাকে। ওই উপাচার্য আমাদের সরল নিরক্ষর রিকশাওয়ালা ও শ্রমিকদের মতোই নির্দোষ, ও একই সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত; তাদের মান এক। এক উপাচার্য গত বছর একটি পত্রিকার সাথে সাক্ষাৎকারে আমার সম্পর্কে এমন একটি উক্তি করেন, যাতে তাঁর সাংস্কৃতিক নিম্নমান সুন্দরভাবে প্রকাশ পায়। আমার যে-লেখা সম্পর্কে তিনি মন্তব্য করেন, আমি বুঝতে পারি তিনি তা পড়েন নি, পড়লেও বোঝেন নি, আমার লেখা তাঁর পক্ষে বুঝে ওঠা খুবই কঠিন। কিন্তু তিনি বলে বসেন যে আমার মানসিক হাসপাতালে ভর্তি হওয়া উচিত। মন থাকলে মনের অসুখও হ’তে পারে, তার চিকিৎসার জন্যে মানসিক হাসপাতালেও যাওয়া দরকার হতে পারে, প্রয়োজনে আমি সেখানে যেতে কখনোই দ্বিধা বা লজ্জাবোধ করবো না, কিন্তু লজ্জাবোধ করেছি ওই উপাচার্যের সাংস্কৃতিক মানের নিম্নতা দেখে। উপাচার্য হিসেবে তাঁর দায়িত্ব ছিলো বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন লেখক-অধ্যাপকের অধিকার ও সম্মান রক্ষা করা, কিন্তু সাংস্কৃতিক দুস্থতাবশত তিনি যে উক্তি করেন, তাতে বোঝা যায় আমার অনেক আগেই তাঁর ওই চিকিৎসানিকেতনে ভর্তি হওয়া অত্যন্ত জরুরি ছিলো। তাঁর উক্তি অবশ্য আমার উপকার করেছে, আমাকে আরো একটি প্রবচন লিখতে অনুপ্রাণিত করেছে। প্রবচনটি হচ্ছে: আমার এক শুভার্থী আমাকে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন, এবং তিনি যে-কেবিনটিতে দশ বছর ছিলেন সেটিই নিতে বলেছেন। তবে আমি ওই কেবিন নিতে রাজি হই নি, কেননা ওই কেবিনে ‘পাগল হয়ে ঢুকতে হয়, আর ছাগল হয়ে বেরিয়ে আসতে হয়।’

বাঙলাদেশের উপাচার্যদের সাংস্কৃতিক মানের নিম্নতা সম্পর্কে উচ্চতর মানববিদ্যা গবেষণাকেন্দ্র একটি গবেষণা প্রকল্প গ্রহণ করতে পারে।

বাঙলাদেশে উপাচার্যদের পরিণতি অত্যন্ত স্পষ্ট। কয়েক মাস তাঁরা সুখে থাকেন, তারপর শুরু হয় তাঁদের দুঃখের দিন। একদিন দেখা যায় ছাত্ররা তাঁদের ঘেরাও করেছে, বাইরে খুবই রুচিকর শ্লোগান চলছে, উপাচার্যের নামের আগের-পরের সমস্ত উপাধি মুছে দিয়ে ছাত্ররা তাদের এমন নাম ধ’রে ডাকছে, যে-নামে বাল্যকালে কেউ ডাকলেও মারামারি বেধে যেতো কিন্তু ছত্রিশ ঘণ্টা ঘেরাও ও তিরস্কার উপভোগ করতে হয় তাঁদের। কোনো এক শুভদিনে ছাত্ররা হামলা চালায় উপাচার্যদের ওপর, কারো মাথা ভাঙে, কারো হাত ভাঙে, কেউ কেউ নিজের অপমান চেপে যান, কেউ কেউ নিজের অপমান গলায় ঝুলিয়ে রাখেন। ছাত্ররা কখনো কখনো উপাচার্যের ভবনও আক্রমণ কৰে, আগুন ধরিয়ে দেয় ঘরবাড়িতে। কেউ কেউ অপমান ও প্রাণের ভয়ে পদত্যাগ করেন, অনেকে করেন না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দু-জন উপাচার্য পদত্যাগ করেছেন আক্রান্ত হয়ে, আরেকজন আক্রান্ত হয়েছেন। চট্টগ্রামের একজনকে পদত্যাগ করতে হয়েছে ছাত্রদের চাপে। তাঁদের এ পরিণতিকে ট্রাজেডি বলা যায় না, কেননা ট্র্যাজেডির নায়কের কোনো বৈশিষ্ট্য তাঁদের নেই; তাঁদের পরিণতিকে মনে হয় প্রহসন। তাঁরা সবাই প্রহসনেরই নায়ক। তবে পদত্যাগই উপাচার্যদের চরম পরিণতি নয়, আরো পরিণতি রয়েছে। কয়েকজন উপাচার্যকেই যেতে হয়েছে কারাগারে; চট্টগ্রামের একজনকে, রাজশাহীর দু-জনকে, ঢাকার একজনকে কারাগার পর্যন্ত যেতে হয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ হয়তো বানানো ছিলো, তবে যেগুলো খাঁটি ছিলো, তার জন্যেও কারাগারে না গিয়ে উপায় থাকে না। উপাচার্যদের মধ্যে যারা পদত্যাগ করে মুক্তি পান, তাঁরা ভাগ্যবান; অন্তত কারাগার তাঁদের ক্ষমা করে। প্রশ্ন হচ্ছে দেশের প্রানকেন্দ্রের প্রধান পুরুষদের এ পরিণতি হয় কেনো, এ-পরিণতির সম্ভাবনা এখনো থেকে যাচ্ছে কেনো? এরকম ঘটে মানুষ হিসেবে তারা বড়ো ক্ষুদ্র ব’লে? সরকার তাঁদের এই পরিণতি দেখতে চায় বলে? ছাত্ররা তাঁদের ব্যবহার করতে চায় ব’লে? তারা বড়ো বেশি ক্ষমতালোভী বলে? তারা অধ্যাপকের বেশে বার্থ আমলা ব’লে? প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি নন; মানুষ ও জ্ঞানী হিসেবে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের থেকে উৎকৃষ্ট অধ্যাপকের সংখ্যা অনেক। উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন গৌণ অধ্যাপক মাত্র। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পদটি তাঁকে পাগল ক’রে তোলে, পদ আঁকড়ে থাকা, ক্ষমতার অপব্যবহার করা তাঁর রোগে পরিণত হয়। তিনি সততা থেকে ভ্রষ্ট হন, বা আগে থেকেই ভ্রষ্ট, জ্ঞান ও বিদ্যার কথা তার মনে থাকে না, ক্ষমতার লোভে তিনি রাজনীতিতে মেতে ওঠেন; অসংখ্য মিথ্যার জালে জড়িয়ে পড়েন। বাংলাদেশের একটি বা একজন উপাচার্য ও জ্ঞানের কথা ভাবেন না, ভাবেন ক্ষমতা ও রাজনীতি। তাই তাঁদের পরিণতি এমন। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি পঞ্জিত উপাচার্য কামনা করি, যিনি অফিসেও বই পড়বেন, ক্লাশও নেবেন, ক্ষমতায় থাকার সময়ও গবেষণা করবেন। তবে আমাদের উপাচার্যরা ক্ষমতার আসার অনেক আগেই জ্ঞানপর্বকে বিদায় জানান; শুরু করেন জীবনের উন্নতিপর্ব: একদিন উপাচার্য হন, এবং একসময় দেখতে পান নিজের পরিণতি। সেদিন তিনি পদচ্যুত, এমনকি ইতিহাস নিষ্ক্রান্ত।