কবির সমাধি

[বনের ধারে নদীর তীরে কবির কুটির। একদিন মালিনীর মেয়ে মালতীলতিকার সাথে তার ভাব হয়ে গেল। প্রেমের প্রথম অভিনয় বেশ ভালই চল্ল। শেষে মালিনীর মেয়ের আর কবিতে ভাল লাগে না। কবির দুঃখ সে বুঝতে পারে না।]

মালিনীর মেয়ে আসে নাই কাল আজও নাই তা’র সাড়া,
ঘরে বসিয়াও কবির পরাণ হইয়াছে ঘর-ছাড়া।
দূর বালু-পথ অঘোরে ঘুমায় ধূলার বসন ধরে,
দখিনের বায়ু গড়াগড়ি যায় তাহার বুকের পরে।
তপ্ত বালুর মুকুরে ঢালিয়া বুকের আগুনরাশি,
দুপুরের রোদ গগন ঘিরিয়া হাসিছে বিকট হাসি।
আজো কি তাহার সময় হবে না, আজো এই নদী-তীর,
বালুর আখরে ছবি আঁকিবে না তাহার চরণটীর।
দূর দিগন্তে মেলি দুই বাহু ডাকে কবি, আয়-আয়-
এই নদী পথে সেই সুর যেন বালু হয়ে উড়ে যায়!

ক্রমে দিন যায়, সন্ধ্যার কোলে রক্তের জাল বুনি’
পশ্চিম তীরে হাসে খল-খল দিবস শেষের খুনী।
নদী-পথ বেয়ে পথিকেরা চলে, তাহাদের পদঘায়
কবির পরাণ ধূলায় মিশিয়া গুঁড়া হয়ে যেন যায়।
এই পথ দিয়ে কত লোক আসে, তার কি আসিতে নাই-
এ পথে কি কেউ কাঁটা গাড়িয়াছে সে আসিবে বলে তাই?
দূর পশ্চিমে এখনো হাসিছে দিক্-বলয়ের মালা,
পল্লী-বধূরা প্রদীপ জ্বালায়ে তাহাতে করেছে আলা।

সেই কালে কবি হেরিল সমুখে, আসে মালিনীর মেয়ে,
এলো চুল হ’তে শিথিল কুসুম পড়িতেছে পথ বেয়ে;
দুটী বাহু তা’র হেলিছে দুলিছে, উড়িছে সুনীল শাড়ী,
অঙ্গে-অঙ্গে বাজিছে গহনা সারা দেহ তা’র নাড়ি।
-এমনি করিয়া মেঘ-পথ বেয়ে হাসে বিজলীর লতা,
-কহে কাল জলে ডুবিতে ডুবিতে সোনার কলসী কথা!
কবি শুধু তা’রে চাহিয়া দেখিল, যেন দুটি আঁখি ভরি,
সারা দেহে তা’র যত রূপ আছে লইল উজাড় করি।
মালিনীর মেয়ে হাসি-মুখে তার আরও মাখাইল হাসি-
কহিল, “আজিকে দেরী করে দিল রাজার কুমার আসি’।
কালিকেও আমি সাজিয়া গুজিয়া আসিব তোমার কাছে
এমন সময় রাজার কুমার ডাক দিল মোরে পাছে।

সেকি ছাড়ে মোরে- দিতে হ’বে তারে বিনা-সুতে গেঁথে মালা,
এমনো নয়কো তেমনো নয়কো সে এক বিষম জ্বালা!
খানিক তাহার পাটল ফুলের, খানিক বকুল ফুল;
তার মাঝে মাঝে গোলাপ গাঁথিতে নাহি হয় যেন ভুল।
সে মালায় পুনঃ লিখিতে হইবে রাজার ছেলের নাম-
কি করিব আমি, সারা রাত জেগে তাই শুধু গাঁথিলাম।
আজ এসেছিল মালা লইবারে- পেয়ে সে কি খুসী তা’র!
বলে সে এমন বিনা-সুতী মালা কভু দেখে নাই আর।
তাহার গলার গজমতি হার আমারে দিয়েছে ডেকে
তোমারে দেখাতে আসিলাম তাই এই সাঁঝে ঘর থেকে।
এখনই আমারে ফিরে যেতে হবে, আজিকে নূতন করে-
সারা রাত জেগে রাজার ছেলের মালা দিতে হবে গ’ড়ে।”
কবি কহে, “শুন মালিনীর মেয়ে, আমিও গেঁথেছি মালা,
কথায়-কথায সূত্র গাঁথিয়া তোমারে পরাতে বালা!
যে কথা আমার গোপন মনের আঁধার গুহার কোণে,
হাজার বরষ ঘুমাইয়াছিল নিশার স্বপন-সনে-
আজিকে বে-বুঝ বেদনার ঘায়ে সে কথারে ছিঁড়ে আনি
আঁখি যমুনার কাল জলে ধুয়ে গেঁথেছি মাল্যখনি।”
মালিনীর মেয়ে হাসিয়া কহিল- “এ সব ত শুনিলাম,
আচ্ছা বলত তোমার মালায় লিখিয়াছ কার নাম?”

কবি কহে “সখি, কি লিখেছি আমি তোমারে বলিব খুলে,
আকাশেতে হাসে আকাশের তারা ধরায় নামে কি ভুলে?
ঊষার কিরণ তড়িতের সিঁথি ভুলিয়া গিয়াছি তাই-
মালিনীর মেয়ে মালতী লতিকা তারও নাম লিখি নাই।
এ মালায় আমি লিখিয়া রেখেছি তোমার ও রাঙা মুখ,
এই ধরণীর মানুষের মনে দিতে পারে যত দুখ!
ও দেহ তরণী বাহিয়া চলেছ মোদের নদীর জলে
আঘাতে তাহার যত ঢেউ উঠে মালায় লিখেছি ছলে।
আর লিখিয়াছি ওই ভাঙা ঘরে তোমার কথাটি স্মরি,
রাতের তারারে সাক্ষ্য মানিয়া জাগিয়াছি বিভাবরি;
অজানা গ্রহের দূর পথ বেয়ে চলে গেছে মুসাফির,
তারা দেখে গেছে কি বেদনা মোর একেলা পরাণটীর।
সেই সব আমি মালায় লিখেছি আরও লিখিয়াছি তাতে-
আরও যে আঘাত হেনে যাবে তুমি আমার জীবন পাতে।”

“এ মালায় মোর কি হইবে কাজ?” মালিনীর মেয়ে কয়,
কবি কহে, “সখি, বেদনার দান জগতে যে অক্ষয়!
তুমি কি জান না তোমার বিধাতা তোমারে পাঠাল ভবে
এই কথা বলে- ও দেহের রূপে জগৎ জিনিতে হবে।
তোমার গলায় মোর মালাখানি এ যে তব জয়-হার,
ও রূপে তোমার কত মোহ আছে, ভাষা এ যে সখি তার।
মোর মালাখানি লয়ে যাও সখি! মহাকাল নদীজলে-
রূপের তরণী করে টলমল ঘটনার হিল্লোলে।
ওই তব হাসি ওই রাঙা মুখ, ও যেন সোতের পানা,
আজ যারে দেখি কালিকে তাহারে অমনি দেখিতে মানা।
আমি যেন আজ দেখিতেছি সখি, তোমার ও রূপখানি।
তটিনীর মত ছুটিয়া চলেছে কূলে কূলে ব্যথা হানি।
ও তব সোনার কান্তি জুড়িয়া নাচিছে কালের ঢেউ,
আজ যারে দেখি কালিকে তাহারে হেন দেখিবে না কেউ
কি জানি যদি বা এই কভু হয়, ও তব সুষমাখানি।
বরষের কোন দৈত্য আসিয়া লয়ে যায় কোথা টানি।
তখন সজনী দেহ-বালুচরে খুলিয়া আমার মালা
দেখিও যা তুমি হারায়েছ পথে- কত সে হানিত জ্বালা।
ও-দেহের সেই ভগ্ন দেউলে এ মোর মাল্যখানি
বিগত দিনের কত ভোলা কথা আনিবে সেদিন টানি।
তখন যদি বা এই অভাগারে পড়ে যায় তব মনে,
ফেলিও সজনী, এক ফোঁটা জল ও দুটি নয়ন-কোণে।
এই আশা লয়ে আজো বেঁচে আছি বুকে করাঘাত হানি;
ভাবি- নখে নখে ছেঁড়া যায় নাকি গোপন বেদনাখানি।”

মালিনীর মেয়ে শুধাইল, “কবি বুঝাইয়া বল মোরে
শুধু কি বেদনা রাখিয়াছ আজ তোমার মালায় ভ’রে?”
“শুধুই বেদনা- কবি কহে কেঁদে, “নিছক বেদনা সখি,
এ পোড়া নয়নে আর কিছু নয় বেদনারে শুধু লখি।”
“কেন ব্যথা পাও” মালিনীর মেয়ে কহে আরও কাছে এসে,
কবি কহে “সখি, ললাটের লেখা এ যে তোমা ভালবেসে।
এ জীবনে যারে ভালবাসি সেই সব চেয়ে দেয় দাগা,
ভাগ্য যাহারে সঁপিলাম সেই বানাইল দুর্ভাগা।
ভরা তরী যারে দিলাম যাচিয়া, সে নিঠুর মোরে আজি-
ধরণীর গাঙে সাজাইয়া দিল শূন্য নায়ের মাঝি।”
“কেন, আমি তব কি করেছি কবি” সুধায় মালীর মেয়ে,
কবি কহে, “কেন তড়িৎ হইয়া এলে মোর মেঘ বেয়ে?
দেশে দেশে আজ গুমরি কাঁদিয়া তোমারে খুঁজিয়া মরি,
তীব্র ব্যথার আগুণ জ্বালিছ মোর বুকখানি ভরি।
ধরিতে ধরিতে পলাইয়া যাও, বাহুর বাঁধন হায়-
এত যে শিথিল, ভালবাসিবার আগে যদি জানা যায়!

যদি জানা যায়- যারে কাছে চাই সেই হয়ে যায় দূর,
তবে কেহ কভু কারো কথা দিয়ে বাঁধিত গানের সুর?
এ মোর নিখিলে এ ব্যথারে সখি জুড়াবার নাহি ঠাঁই।
যারে ভালবাসি সেই দিল মোরে সব চেয়ে বেদনা-ই!
তাই দিয়ে আমি গাঁথিয়াছি মালা, তারি আঁকিয়াছি ছবি,
গজমতি হার কোথা পাব সখি, আমি যে তোমার কবি?”
“হায় হতভাগা” মালিনীর মেয়ে কহে তার হাত ধরি,
“যে ব্যথারে আমি চিনিনে এ ভবে তারে লয়ে কিবা করি।
মালিনীর মেয়ে, ফুল লয়ে খেলি, ফুলে-ফুলে গাঁথি হার;
ফুলের দেশে ত হাসি আছে সখা, বেদনা নাই যে তার!
মোর ফুল-বনে ফুল বিছাইয়া ঘুমাই ফুলের গায়,
সন্ধ্যা-সকালে কবরী এলায়ে গন্ধ ছড়াই বায়।
ফুলের সঙ্গে শিখিয়াছি সখা কেবলি ফুলের হাসি,
সে দেশে আজিকে কেমনে লইব তোমার ব্যথার বাঁশী।
এ জীবনখানি মদের পেয়ালা দোলে তরঙ্গ ভরে;
লহরে লহরে সোণার স্বপন ভেসে ওঠে থরে থরে।
এরি সাথে যারা মনের বীণাতে বঁধিতে পারে না সুর,
চরণের ঘায়ে তাহাদের মোরা ছিটাইয়া দেই দূর।”
কবি কহে, “ওগো ফুলের কুমারী, ফুল লয়ে তুমি থাকো,
সে ফুল যে সখি, ঝরে পড়ে যায় তারে তুমি দেখ নাকো?
ফুলের হাসি যে দুদিনে শুকায় ফোটা ফুল হয় বাসি-
এই কথা স্মরি তোমাদের দেশে বাজে নাই কোন বাঁশী?
যে ফুল তোমরা অলকে বাঁধিছ যে ফুলে গাঁথিছ হার,
তোমাদের দেশে কোন গান নাই সে ফুলের বেদনার?”
“নয়, নয়, নয়,” মালিনীর মেয়ে কহে পুনরায় হাসি,
প্রতিদিন মোরা ঝাটাইয়া দেই পথে ঝরাফুলরাশি।
আমাদের দেশে শুধু হাসি সখা- যার ক্রন্দন থাকে,
পথের ধূলায় দলিয়া আমরা পায়ে পিষে যাই তাকে।”

“তবু- তবু- ওগো সোণার বরণী আমারে করুণা করি
মাঝে মাঝে শুধু দেখে যেয়ো মোরে ব্যথায় যদি না মরি!”
“সময় কোথায়?” মালিনী শুধায়, চলিছে ভাটীর বেলা-
এরি মাঝে সখা, সেরে নিতে হবে জীবন-নাটের খেলা!”