নক্সী-কাঁথার মাঠ – ০৮

“কি কর দুল্যাপের মালো; বিভাবনায় বসিয়া,
আসত্যাছে বেটির দামান ফুল পাগড়ি উড়ায়া নারে।”
“আসুক আসুক বেটির দামান কিছু চিন্তা নাইরে,
আমার দরজায় বিছায়া থুইছি কামরাঙা পাটি নারে।
সেই ঘরেতে নাগায়া থুইছি মোমের সস্র[১] বাতি,
বাইর বাড়ি বান্দিয়া থুইছি গজমতি হাতি নারে।”
-মুসলমান মেয়েদের বিবাহের গান

বিয়ের কুটুম এসেছে আজ সাজুর মায়ের বাড়ি,
কাছারী ঘর গুম্-গুমা-গুম্, লোক হয়েছে ভারি।
গোয়াল-ঘরে ঝেড়ে পুছে বিছান দিল পাতি;
বসল গাঁয়ের মোল্লা মোড়ল গল্প-গানে মাতি।
কেতাব পড়ার উঠল তুফান; – চম্পা কালু গাজী,
মামুদ হানিফ সোনবান ও জয়গুন বিবি আজি;
সবাই মিলে ফিরছে যেন হাত ধরাধর করি।
কেতাব পড়ার সুরে সুরে চরণ ধরি ধরি।
পড়ে কেতাব গাঁয়ের মোড়ল নাচিয়ে ঘন দাড়ি,
পড়ে কেতাব গাঁয়ের মোল্লা মাঠ-ফাটা ডাক ছাড়ি।

কৌতুহলী গাঁয়ের লোকে শুন্ছে পেতে কান,
জুমজুমেরি[২] পানি যেন কর্ছে তারা পান!
দেখছে কখন মনের সুখে মামুদ হানিফ যায়,
লাল ঘোড়া তার উড়্ছে যেন লাল পাখিটির প্রায়।
কাতার কাতার সৈন্য কাটে যেমন কলার বাগ,
মেষের পালে পড়ছে যেন সুন্দর-বুনো বাঘ।
স্বপন দেখে, জয়গুন বিবি পালঙ্কেতে শুয়ে;
মেঘের বরণ চুলগুলি তার পড়ছে এসে ভূঁয়ে;
আকাশেরি চাঁদ সূরুজে মুখ দেখে পায় লাজ,
সেই কনেরে চোখের কাছে দেখ্ছে চাষী আজ।
দেখ্ছে চোখে কারবালাতে ইমাম হোসেন মরে,
রক্ত যাহার জমছে আজো সন্ধ্যা-মেঘের গোরে;
কারবালারি ময়দানে সে ব্যথার উপাখ্যান;
সারা গাঁয়ের চোখের জলে করিয়া গেল সান।

উঠান পরে হল্লা-করে পাড়ার ছেলে মেয়ে,
রঙিন বসন উড়ছে তাদের নধর তনু ছেয়ে।
কানা-ঘুষা করত যারা রূপার স্বভাব নিয়ে,
ঘোর কলিকাল দেখে যাদের কানত সদা হিয়ে;
তারাই এখন বিয়ের কাজে ফিরছে সবার আগে,
ভাভা-গড়ার সকল কাজেই তাদের সমান লাগে।
বউ-ঝিরা সব রান্না-বাড়ায় ব্যস্ত সকল ক্ষণ;
সারা বাড়ি আনন্দ আজ খুশী সবার মন।
বাহিরে আজ এই যে আমোদ দেখ্ছে জনে জনে;
ইহার চেয়ে দ্বিগুণ আমোদ উঠ্ছে রূপার মনে।
ফুল পাগড়ী মাথায় তাহার ‘জোড়া জামা’ গায়,
তেল-কুচ্-কুচ্ কালো রঙে ঝলক্ দিয়ে যায়।
বউ-ঝিরা সব ঘরের বেড়ার খানিক করে ফাঁক,
নতুন দুলার[৩] রূপ দেখি আজ চক্ষে মারে তাক।

এমন সময় শোর উঠিল- বিয়ের যোগাড় কর,
জলদী করে দুলার মুখে পান শরবত ধর[৪]
সাজুর মামা খট্কা লাগায়, “বিয়ের কিছু গৌণ,
সাদার পাতা[৫] আনেনি তাই বেজার সবার মন।”
রূপার মামা লম্ফে দাঁড়ায় দম্ভে চলে বাড়ি;
সেরেক পাঁচেক সাদার পাতা আন্ল তাড়াতাড়ি।
কনের খালু[৬] উঠিয়া বলে “সিঁদুর হল ঊনা!”
রূপার খালু আনিয়া দিল যা লাগে তার দুনা।

কনের চাচার মন উঠে না, “খাটো হয়েছে শাড়ী।”
রূপার চাচা দিল তখন ‘ইংরেজী বোল ছাড়ি’।
“কিরে বেটা বকিস নাকি?” কনের চাচা হাঁকে,
জালি কলার পাতার মত গা কাঁপে তার রাগে।
“কোথায় গেলি ছদন চাচা, ছমির শেখের নাতি,
দেখিয়ে দেই দুলার চাচার কতই বুকের ছাতি!
বেরো বেটা নওশা[৭] নিয়ে, দিব না আজ বিয়া;”
বলতে যেন আগুন ছোটে চোখ দুটি তার দিয়া।
বরপক্ষের লোকগুলি সব আর যে বরের চাচা,
পালিয়ে যেতে খুঁজছে যেন রশুই ঘরের মাচা।

মোড়ল এসে কনের চাচায় অনেক করে বলে,
থামিয়ে তারে বিয়ের কথা পাড়েন কুতূহলে।
কনের চাচা বসল এসে বরের চাচার কাছে,
কে বলে ঝড় এদের মাঝে হয়েছে যে পাছে।
মোল্লা তখন কলমা পড়ায় সাক্ষী-উকিল[৮] ডাকি,
বিয়ে রূপার হয়ে গেল, ক্ষীর-ভোজনী বাকি।
তার মাঝেতে এমন তেমন হয়নি কিছু গোল,
কেবল একটি বিষয় নিয়ে উঠল হাসির রোল।
এয়োরা সব ক্ষীর ছোঁয়ায়ে কনের ঠোঁটের কাছে;
সে ক্ষীর আবার ধরল যখন রূপার ঠোঁটের পাছে;
রূপা তখন ফেলল খেয়ে ঠোঁট ছোঁয়া সেই ক্ষীর,
হাসির তুফান উঠল নেড়ে মেয়ের দলের ভীড়।
ভাব্ল রূপাই – অমন ঠোঁটে যে ক্ষীর গেছে ছুঁয়ে,
দোজখ যাবে না খেয়ে তা ফেলবে যে জন ভূঁয়ে।

ফুটনোট

১. সস্র = সহস্র

২. জুমজুম = আরবের একটি পবিত্র কূপ যা মূলত জমজম নামে পরিচিত

৩. দুলা = বর

৪. পান শরবত ধর = বিবাহের আগে বরকে পান শরবত খাওয়ান হয়

৫. সাদার পাতা = তামাক পাতা

৬. খালু = মেশোমশায়

৭. নওশা = বর

৮. সাক্ষী উকিল = মুসলমানদের বিবাহের সময় বর-কন্যা একস্থানে থাকে না। কন্যাপক্ষের একজন উকিল এবং দুইজন সাক্ষী থাকেন। বাড়ির ভিকরে গিয়ে বিবাহে কন্যার মত আছে কিনা জেনে আসেন। উকিল জিজ্ঞাসা করেন, সাক্ষীরা তা শুনে এসে বাইরে বৈঠকখানায় বিবাহ সভার সকলকে বলেন।